ফিলিস্তিন মুক্তির প্রতিশ্রুতি
মুফতি শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী
প্রকাশ : ১৪ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বিংশ শতাব্দীর ৪০-এর দশকে ইহুদিবাদী ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনের ভূমি ও পবিত্র কুদস দখলের পর একটি কঠিন সময়কাল অতিবাহিত হয়েছে। সেখানকার রাজনৈতিক জীবনে অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। ইসরাইলে দখলদার সরকার গঠনের পর আরব বিশ্বের পক্ষে কয়েকটি দেশ (মিশর, সিরিয়া ও জর্ডান) এই শাসনব্যবস্থার মোকাবিলা করতে শুরু করে। কিন্তু ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধ ও ১৯৭৩ সালের রমজানের যুদ্ধে ইসরাইলের কাছে আরব দেশগুলোর হতাশাজনক পরাজয়ের পর কুদস শরিফ ও ফিলিস্তিনের মুক্তির বিষয়টি অস্পষ্টতা ও অচলবস্থার মধ্যে পড়ে। মিসর ও ইসরাইলের মধ্যে ১৯৭৮ সালে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে অধিকৃত ফিলিস্তিন ও এর নিপীড়িত ও বাস্তচ্যুত জনগণের অবস্থা আগের চেয়ে আরও কঠিন হয়ে পড়ে। মিশর ছাড়া আরও কয়েকটি আরব ও ইসলামি দেশের মধ্যে ইহুদিবাদী ইসরাইলকে মোকাবিলার নীতিতে পরিবর্তন আসে। তারা ইসরাইলের সঙ্গে আপোষকামী নীতি গ্রহণ করে।
এ পরিস্থিতি ইহুদিবাদী ইসরাইলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইসলামি বিশ্ব ও মুসলিম জাতিগুলোর ঐক্য ও সংহতিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসলামি সরকারগুলোর মধ্যে বিভেদ ও বিভক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রকৃতপক্ষে এ পরিস্থিতি ও সময়টুকুতে ইসরাইলই ময়দানে বেপরোয়াভাবে আবির্ভূত হয়। তারা নিজেদের অস্তিত্বকে বৈধতা দেয়ার জন্য মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাজনৈতিক আগ্রাসনের সূচনা করে। কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের বিজয় ফিলিস্তিন ইস্যুর পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় একটি টার্নিং পয়েন্ট হয়ে ওঠে। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেইনি (রহ.) দখলদার ইহুদিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পতাকা উড্ডীন করেন। কুদস শরিফ ও ফিলিস্তিনের ইসলামি ও পবিত্র ভূমির মুক্তির বিস্মৃত লক্ষ্য ও আদর্শকে পুনরুজ্জীবিত করেন।
ইমাম খোমেইনি (রহ.)-এর পক্ষ থেকে রমজান মাসের শেষ দশকের শুক্রবারকে আল কুদস দিবস নামকরণ ছিল একটি বৃহৎ বুদ্ধিবৃক্তিক ও গঠনমূলক রাজনৈতিক উদ্যোগ; যা ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক মুক্তি সংগ্রামের পথকে পাল্টে দেয়। এ পথটিকে আলোকিত ও মসৃণ করে তোলে। এ উদ্যোগ ও নামকরণ কয়েকটি দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের সব মুসলমান এমনকি বিশ্বের অন্যান্য মুক্তিকামী জাতির জন্যও এর সুস্পষ্ট বার্তা রয়েছে। পবিত্র রমজান মাসের শেষ শুক্রবারকে ‘বিশ্ব কুদস দিবস’ হিসেবে নামকরণের গুরুত্ব ও এর বার্তা বিভিন্ন দিক থেকে বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করা যেতে পারে। যার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উল্লেখ করা হলো-
প্রথমত, বিশ্ব কুদস দিবসের সর্বাগ্রে যে বার্তা ও অর্জন, তা হলো- পবিত্র কুদস ও ফিলিস্তিনের ভূমির বিষয়টি বিশ্ব জনমতের ইস্যু ও সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। এটি আর ভুলে যাওয়ার নয়। এ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু থেকে বিশ্বের জনমতকে বিচ্যুত করার জন্য ইহুদিবাদী ইসরাইল ও তার মদদদাতা পশ্চিমা শক্তিগুলোর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তাই ফিলিস্তিনের দখলকৃত অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ ঘটনা ও তেলআবিবের কর্মকর্তাদের অপরাধযজ্ঞের বিষয়টি পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো এড়িয়ে গেলেও স্বাধীন গণমাধ্যমগুলো এ বিষয়ে দৃষ্টি রেখেছে।
দ্বিতীয়ত বিশ্ব কুদস দিবস নামকরণের আগ পর্যন্ত ফিলিস্তিন ইস্যুটি ছিল সরকারি সম্পর্কের কাঠামোর মধ্যে। তাও আবার কয়েকটি প্রভাবশালী আরব রাষ্ট্রকেন্দ্রিক। কিন্তু বিশ্ব কুদস দিবস ফিলিস্তিন ইস্যুকে একটি সরকারি ফাইলবন্দি বিষয় থেকে জনগণের ইস্যুতে পরিণত করেছে ও জাতিগুলোকে একত্রিত করেছে। এই অর্জন কিছু আরব ও ইসলামি সরকারের আপস প্রক্রিয়াকে প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। ফিলিস্তিন সংকট নিরসনের বিষয়টি সরকারগুলো থেকে জাতিগুলোর প্রধান দাবিতে পরিণত হয়েছে।
তৃতীয়ত, আজ ফিলিস্তিন ইস্যু ও কুদস শরিফের ভাগ্য শুধু একটি ফিলিস্তিনি এমনকি একটি আরবীয় ইস্যু নয়, এটি সমগ্র ইসলামি বিশ্বের ও সব মুসলমানের বিষয়। এ ভাবনা থেকে ফিলিস্তিনি আদর্শ ও এর মুক্তি আন্দোলনকে ঘিরে ইসলামি বিশ্বের সব সক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধাকে একত্রিত করা সম্ভব। এ প্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিনে দখলদারিত্বের অবসান এবং ফিলিস্তিনিদের পূর্ণ অধিকার নিশ্চিত হওয়ার মাধ্যমে পরিণতি লাভ করতে পারে।
চতুর্থত, বিশ্ব কুদস দিবসের আন্দোলন ফিলিস্তিনের ইসলামি দিকগুলো ছাড়াও এর অন্যান্য মানবিক ও আইনগত দিকগুলোও উত্থাপন এবং বিশ্ব জনমতের কাছে তা অনুসরণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাথমিক দৃষ্টিতে বিশ্বের কোনো কোনো জাতির জন্য ফিলিস্তিন ইস্যুটি শুধু একটি আরবীয় বা ইসলামি সমস্যা ছিল। কিন্তু কুদস দিবসের বৈশ্বিক আন্দোলন একে একটি সর্বজনীন ইস্যুতে পরিণত করেছে। এর মানবিক ও আইনগত দিকগুলোও তুলে ধরছে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে আজ বিশ্বের কোনো কোনো অমুসলিম জাতিও ফিলিস্তিন সমস্যা এবং ফিলিস্তিনি জনগণের কঠিন পরিণতির বিষয়টি উপলব্ধি করছে। মানবিক ও আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে ফিলিস্তিনের মজলুম জনগণকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
নিঃসন্দেহে এ ভূখণ্ডের দখলদাররা ফিলিস্তিনি জনগণের প্রাথমিক মানবাধিকার হরণ করেছে। তাদের আল্লাহপ্রদত্ত স্বাধীনতা ও স্বাভাবিক জীবন যাপনের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। এ কারণে মুসলিমণ্ডঅমুসলিম জাতি নির্বিশেষে বিশ্বের সব মানুষ ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীনতা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসছে। এটি বিশ্ব কুদস দিবস আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা ও অর্জন।
পঞ্চমত, বিশ্ব কুদস দিবসের নামকরণ ও এর বড় অর্জন সম্পর্কে চূড়ান্ত ও শেষ কথা হলো, এই রাজনৈতিক উদ্যোগ ফিলিস্তিনি জাতি এবং বিশ্বের অন্যান্য ইসলামি ও স্বাধীনতাকামী জাতির মুক্তি সংগ্রামের পথে একটি সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছে। তাদেরকে ফিলিস্তিনের নিপীড়িত জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং দখলদার ইহুদিবাদীদের হাত থেকে এই পবিত্র ভূমিকে মুক্ত করতে আশাবাদী করেছে।
অন্যকথায় আজকের বিশ্ব কুদস দিবস ফিলিস্তিনের মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেয়। এই উজ্জ্বল পথের ধারাবাহিকতা নিশ্চিতভাবে আল কুদসের আদর্শের উপলব্ধি এবং দখলদার ইহুদিবাদীদের হাত থেকে ফিলিস্তিনের ভূমিকে মুক্ত করার মধ্য দিয়ে শেষ হবে। এটি এমন এক প্রত্যয়, যার লক্ষণগুলো এখন অতীতের তুলনায় আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তেলআবিব ও অধিকৃত অঞ্চলের বর্তমান ঘটনাবলি তারই সূচনা ও আভাস হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
লেখক : যুগ্ম মহাসচিব, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি; সহকারী অধ্যাপক, আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট
অব সুফিজম