ইতেকাফ আত্মার খোরাক
এনায়েতুল্লাহ ফাহাদ
প্রকাশ : ১৪ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ইতেকাফ মাহে রমজানের বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ইবাদত। কদরের রাত হাসিল করার অন্যতম উপায়। ইতেকাফের মাধ্যমে মানুষ দুনিয়ার সবকিছু ছেড়ে আক্ষরিক অর্থে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যায়। রমজানের শেষ দশক তথা বিশ রমজান সূর্যাস্তের আগ থেকে ঈদের চাঁদ তথা শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা পর্যন্ত ইতেকাফ করা সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ কিফায়াহ। রাসুল (সা.) জীবনে ইতেকাফ বাদ দেননি। তিনি হৃদয়ে প্রশান্তির জন্য ইতেকাফ করতেন। ব্যক্তিজীবনে এ ত্যাগ-তিতীক্ষার মহৎ উদ্দেশ্য হলো লাইলাতুল কদর সন্ধান করা, হাজার রাতের সেরা রাত প্রাপ্তির মাধ্যমে মহান আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্য লাভ করা। ইতেকাফের মাধ্যমে শবেকদর তালাশ করেছেন রাসুল (সা.)। তিনি বলেছেন, ‘আমি প্রথম দশকে ইতেকাফ করেছি কদর রজনী খোঁজ করার উদ্দেশ্যে। অতঃপর ইতেকাফ করেছি মাঝের দশকে। এরপর মাঝ দশক পেরিয়ে এলাম, আমাকে বলা হলো, কদর তো শেষ দশকে। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ তাকওয়া অর্জন করতে চায়, সে যেন ইতেকাফ করে।’ (মুসলিম : ১১৬৭)।
কোরআন-হাদিসে ইতেকাফ
ইতেকাফের আদেশ কোনো মানুষের পক্ষ থেকে নয়; বরং এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি বিশেষ নির্দেশ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার ঘর তওয়াফকারী, ইতেকাফকারী ও রুকুণ্ডসেজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখ।’ (সুরা বাকারা : ১২৫)। অসংখ্য হাদিসেও রাসুল (সা.)-এর ইতেকাফ পালন সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। আয়েশা (রা.) বলেন, ‘ইন্তেকাল পর্যন্ত রাসুল (সা.) শেষ দশকে ইতেকাফ করেছেন। এরপর তার স্ত্রীগণ ইতেকাফ করেছেন।’ (বোখারি ১৮৬৮, মুসলিম : ২০০৬)। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘রাসুল (সা.) প্রতি রমজানে ১০ দিন ইতেকাফ করতেন। তবে যে বছর তিনি পরলোকগত হন, সে বছর তিনি ২০ দিন ইতেকাফে কাটান।’ (বোখারি : ১৯০৩)।
মনীষীদের চোখে ইতেকাফ
ইতেকাফ হলো রবের নৈকট্য লাভের সাধনা। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, ‘ইতেকাফ হলো আল্লাহর প্রতি মন নিবিষ্ট করা, তাঁর সঙ্গে নির্জনে বাস করা এবং স্রষ্টার উদ্দেশ্যে সৃষ্টি থেকে দূরে অবস্থান করা, যাতে তাঁর চিন্তা ও ভালোবাসা মনে স্থান করে নিতে পারে।’ আল্লামা হাফেজ ইবনে রজব (রহ.) বলেন, ‘ইতেকাফের উদ্দেশ্য হলো সৃষ্টির সঙ্গে সাময়িকভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করে স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা। আল্লাহর সঙ্গে পরিচয় যত দৃঢ় হবে, সম্পর্ক ও ভালোবাসা তত গভীর হবে এবং তা বান্দাকে আল্লাহর কাছে নিয়ে যাবে।’
ইতেকাফের ফজিলত
রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় ফেরেশতারা তোমাদের একজনের জন্য দোয়া করতে থাকেন, যতক্ষণ সে কথা না বলে, নামাজের স্থানে অবস্থান করে। তারা বলতে থাকে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিন, আল্লাহ তার প্রতি দয়া করুন, যতক্ষণ তোমাদের কেউ নামাজের স্থানে থাকবে এবং নামাজ তাকে আটকে রাখবে, তার পরিবারের কাছে যেতে নামাজ ছাড়া আর কিছু বিরত রাখবে না, ফেরেশতারা তার জন্য এভাবে দোয়া করতে থাকবে।’ (মুসলিম : ৬০১১)।
ইতেকাফের উপকারিতা
মানবজীবনকে সোনার অক্ষরে সাজাতে হলে ইচ্ছাশক্তি প্রবল করা এবং প্রবৃত্তিকে খারাপ অভ্যাস থেকে বিরত রাখার অভ্যাস গড়ে তোলা চাই। আর তা হতে পারে ইতেকাফের মতো পুণ্যময় ইবাদতের মাধ্যমে। ইতেকাফ তার জন্য সুবর্ণ সুযোগ করে দেয়। ইতেকাফ ধৈর্যের গুণে গুণান্বিত হতে শেখায়। ইতেকাফ থেকে একজন মানুষ সম্পূর্ণ নতুন মানুষ হয়ে বেরিয়ে আসার সুযোগ পায়, যা পরকালে উপকারে আসবে। এ ছাড়া ইতেকাফের মাধ্যমে অন্তরে প্রশান্তি আসে। বেশি বেশি কোরআন তেলাওয়াতের সুযোগ হয়। ঐকান্তিকভাবে তওবা করার সুযোগ হয়। তাহাজ্জুদে অভ্যস্ত হওয়া যায়। সময়কে সুন্দরভাবে কাজে লাগানো যায়। আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় হয়। আল্লাহর দিকে আকৃষ্ট হওয়ায় অন্তর সংশোধিত হয়। বান্দা ঈমানি দৃঢ়তা অর্জনের পথ খুঁজে পায়। কেয়ামতের দিন তার মুক্তির পথ এটাই।
স্বচ্ছ ও নিখুঁত ইবাদত ইতেকাফ
ইতেকাফরত অবস্থায় এমন সব কথা ও কাজ না করা, যাতে কোনো গোনাহ হয়। তবে প্রয়োজনীয় সাংসারিক কথাবার্তা বলতে নিষেধ নেই; অহেতুক অযথা বেহুদা অনর্থক কথাবার্তা দ্বারা পুণ্য নষ্ট হয়। ইতেকাফের মাধ্যমে একমাত্র আল্লাহর জন্য নিজেকে আবদ্ধ করে নেওয়া চাই। মুসলমানের অন্তরের কঠোরতা দূর করা চাই। দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসার প্রাচীর ছেদ করা উচিত। যাতে আত্মিক উন্নতি প্রাপ্ত হয়। এ নিগূঢ় সম্পর্ক দীর্ঘ সময় মসজিদে অবস্থানের ফলে হয়। বান্দার অন্তর মসজিদের সঙ্গে জুড়ে যায়। মসজিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার অভ্যাস গড়ে ওঠে। হাদিস অনুযায়ী যে সাত ব্যক্তিকে আল্লাহতায়ালা তাঁর নিজের ছায়ার নিচে স্থান দান করবেন, তাদের মধ্যে একজন হলেন ওই ব্যক্তি, মসজিদের সঙ্গে যার হৃদয় ছিল বাঁধা। (বোখারি : ৬২০)।
ইতেকাফ যেখানে করবেন
পুরুষদের ইতেকাফ মসজিদে, নারীদের নির্দিষ্ট ঘরে বা নির্ধারিত কক্ষে। প্রাকৃতিক প্রয়োজন ও একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ওই ঘর বা কক্ষ থেকে বের হওয়া নিষেধ। অজু-ইস্তেঞ্জা বা পাক-পবিত্রতার জন্য বাইরে বেরুতে পারবে। তবে কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলবে না। প্রয়োজনে ভেতর থেকে বাইরের কাউকে ডাকতে পারবে। কেউ ভেতরে এলে তার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারবে। একই কক্ষে বা একই বিছানায় অন্য যে কেউ অবস্থান করলে কোনো সমস্যা নেই। এমনকি স্বামীও পাশে থাকতে পারবেন। তবে স্বামী-স্ত্রীসুলভ আচরণ ইতেকাফ অবস্থায় নিষিদ্ধ। এর দ্বারা ইতেকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যখন তোমরা ইতেকাফরত থাকবে, তখন তোমাদের স্ত্রীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ো না।’ (সুরা বাকারা : ১৮৭)।