ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালির সংস্কৃতি নয়

মিনহাজুল আরিফীন
মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালির সংস্কৃতি নয়

দরজায় কড়া নাড়ছে বাংলা নববর্ষ। প্রতি বাংলা বছরের প্রথম তারিখে বেশ ডামাডোলের সঙ্গে উদযাপিত হয় এই নববর্ষ। বাংলার এ বর্ষবরণ উৎসবে বেশ ঘটা করে পালিত হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। যেখানে বরাবরের মতো প্রদর্শিত হয় বিশালাকৃতির দানব, সরীসৃপ, হাতি, ঘোড়া, বাঘ, ভাল্লুক, লক্ষ্মীপ্যাঁচার মুখোশ, হুতুমপ্যাঁচার মুখোশ, হাতির মুখোশ, মানুষের মুখোশসহ নারীর অঙ্গপ্রতিকৃতির নানা অশ্লীল ও নগ্নতাপূর্ণ প্রদর্শনীর বাহার। আয়োজক এবং উদযাপনকারীদের বিশ্বাস- কলাবিজ্ঞানীদের হাতে বানানো এসব বাঘ, ভাল্লুক, দানব, হাতি, ঘোড়া অমঙ্গলকে তাড়িয়ে মঙ্গল বয়ে আনবে। (নাউজুবিল্লাহ)। পৌত্তলিকতার ছাঁচে ঢালা এহেন উদযাপনের কারণে ঢাকার মঙ্গল শোভাযাত্রাকে পুজোমণ্ডপের সঙ্গে তুলনা করেছে আনন্দবাবাজার পত্রিকা। পত্রিকাটির জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক দেবদূত ঘোষঠাকুর বেশ উৎফুল্লতার সঙ্গে লিখেছেন, ঢাকার পয়লা যেন অষ্টমীর একডালিয়া। কার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে! কখনও মনে হচ্ছিল কলকাতার কলেজ স্কোয়ার বা একডালিয়ার পুজোমণ্ডপ, কখনও বা শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসবের চেহারা। (দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা : ১৪ এপ্রিল ২০২২)। আসলে বর্ষবরণের হাল-সুরত কি আদৌ এমন হওয়ার কথা? এগুলোই কি হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি?

বাংলার হাজার বছরের সংস্কৃতি কী?

ইতিহাস বলে, বাংলার সংস্কৃতি হলো আবহমান গ্রামবাংলার সংস্কৃতি। লোকগীতি, পল্লীগীতি, ভাটিয়ালি, নদীর গান, গাঁয়ের মানুষের গান, রাখালের সুরেলা বাঁশি, জারিসারি, নবান্নের হরেক রকমের পিঠা, কৃষকের লাঙল টানা, কুটির শিল্পের সৃষ্টিশীলতা, শীতের সকালে কুয়াশাজড়ানো পরিবেশে খেজুরের রস, পল্লীবধূর নকশি কাঁথা, পল্লীকবি জসিম উদ্দীনের কাব্যে রচিত পল্লীজীবনের অপরূপ সৌন্দর্য-সুষমা, জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা, নজরুলের কাব্যে দ্রোহের বহ্নিশিখা, মধুসূদনের দেশটান ইত্যাদি হচ্ছে আবহমান গ্রাম-বাংলার সংস্কৃতি। যুগ যুগ ধরে এই বাংলার নববর্ষ কীভাবে উদযাপিত হয়ে আসছে, সেদিকটাতেও দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাই, গ্রামীণ গম্ভীরা, জারি, লোকগীত ছাড়াও রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত ও দেশাত্মবোধক গানই ছিল বাংলা নববর্ষ উদযাপনের মূল উপাদান। বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ব্যাপ্তি বিশাল। গ্রামে-গঞ্জে, হাট-বাজার, ঢাকার রমনা বটমূল, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, পুরান ঢাকাসহ সারাদেশের গ্রাম-শহরে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা এ দিনে সকাল থেকে মেতে ওঠে নাচণ্ডগান, কবিতা, নাটক, হাডুডু খেলা, গ্রাম্য মেলা, নাগরদোলা ও ঘুড়ি উড়ানো ও হালখাতা উৎসবে। নতুন সাজে, রং-বেরঙের পোশাকে উৎসবে মেতে ওঠে সবাই। তাহলে মঙ্গল শোভাযাত্রা হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি হলো কবে থেকে? ইতিহাস কী বলে?

মঙ্গল শোভাযাত্রার ইতিহাস

১৯৮৫ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রা নামক এই বিদঘুটে আয়োজনের আবিষ্কার করা হয় যশোরে। এর আগে ১৯৮০ সালে ঢাবির কলা বিভাগের প্রবর্তিত নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। আর ঢাকাতে আমদানি হয় ১৯৮৯ সালে। (বিবিসি বাংলা : ১৩ এপ্রিল ২০১৭)। আরেকটু ভেঙে বললে, ১৯৮০-এর দশকে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ঐক্য এবং একই সঙ্গে শান্তির বিজয় ও অপশক্তির অবসান কামনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রবর্তন হয়। অর্থাৎ ১৯৮৫ সালে যশোরে শুরু হওয়া সংস্কৃতিকে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি বলে এখন জাতিকে গেলানো হচ্ছে। আর ১৯৮০ সালে ঢাবির কলা বিভাগের প্রবর্তিত আনন্দ শোভাযাত্রা, যা নব্বই দশকে মঙ্গল শোভাযাত্রা নাম নেয়, সেটাকে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি নাম দেওয়াটা একটা চরম পর্যায়ের মূর্খতা।

ইতিহাস থেকে ইতিহাসে

আরও পেছনে দৃষ্টি রাখলে জানা যায়, মোঘল সম্র্রাট আকবরের সময় থেকে বাংলা সাল গণনা শুরু হয়। আধুনিক নববর্ষ উদযাপনের খবর প্রথম পাওয়া যায় ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয়তা পায়নি। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে ছায়ানট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এই সংস্থা রমনার বটমূলে নববর্ষ উদযাপনের অনুষ্ঠান সূচনা করে। বাংলাদেশে সাঁওতাল, চাকমা, মারমা, ওঁরাও, গারো, মো, মোরাং, হাজং ইত্যাদি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ তাদের নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতি অনুসারে নববর্ষ পালন করে থাকে। এখন বাঙালি সংস্কৃতির নামে চর্চিত হচ্ছে যতসব উলঙ্গ পাশবিকতার। অধিকন্তু সেই পশুসুলভ গলিত আয়োজনকেই চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে সংস্কৃতি বলে।

নব্য সভ্যতার ফেরিওয়ালাদের বাক্যবুলি

এর প্রতিবাদে কিছু লোক চিৎকার-চেঁচামেচি জুড়ে দেয়। আঙুল তুলে বলে ওঠে- ওরা সেকেলে, গোঁড়াপন্থি, মৌলবাদী, ধর্মান্ধ। বাংলার মাটিতে যুগে যুগে গড়ে ওঠা আসল সংস্কৃতিকে ঝেটিয়ে তাড়িয়ে মাত্র কয়কে দশক আগে গজিয়ে ওঠা এসব হিন্দুয়ানি সংস্কৃতিকে বাংলার মুসলমানদের ওপর জগদ্দল পাথরের মতো চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সংস্কৃতি চর্চার নামে পৌত্তলিকতাকে গলাধঃকরণ করানো হচ্ছে অবলীলায়। মঙ্গল শোভাযাত্রার এই মোটিভ ইসলামের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। সাংস্কৃতিক বা ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশ ও দেশের মানুষের সঙ্গে এই চেতনা-বিশ্বাসের দূরতম কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা মুসলমান। এক আল্লাহতে বিশ্বাসী। ইসলামি আদর্শের অনুসারী। এরপরও কীভাবে ধুতি পরে, মাথায় সিঁদুর মেখে বাঙালিপনার চর্চা করি! হিন্দুরসে সিঞ্চিত এ বাঙালিত্বে লীন হয়ে যাচ্ছে আমাদের মুসলমানিত্ব। এ কথা একবার ভেবে দেখেছি? সময়টা মুসলমানদের জন্য বড় দুর্দিনের। সঠিক আকিদা-বিশ্বাস, সভ্যতাণ্ডসংস্কৃতি, জীবন ও অস্তিত্ব সবকিছুই এখন লীন হওয়ার পথে। দিন দিন অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছি আমরা। এক ভয়াল তমসাচ্ছন্ন রাত যেন ক্রমেই গিলে খাচ্ছে আমাদের। কিন্তু এই তিমির রজনী কি ফুরোবে না? আঁধার চিড়ে ভোরের আলো কি আর ফুটে উঠবে না? সুবহে উম্মিদ আর কত দূর? রাত পোহাবার আর কত দেরি পাঞ্জেরী!

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত