ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঈদের দিনে করণীয় ও বর্জনীয়

ঈদ মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব। উৎসব মানেই হাসি-খুশি আর আনন্দ। ঈদের দিন মুসলমানরা আনন্দ উদযাপন করে থাকেন। পরিবার-পরিজনের সঙ্গে খুশি ভাগাভাগি করেন। উচ্ছ্বাস প্রকাশের মধ্য দিয়ে মেতে ওঠেন ঈদ আনন্দে। প্রায় সাড়ে ১৪০০ বছর আগ থেকে এ উৎসব পালন করে আসছে বিশ্ব মুসলিম সমাজ। হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.) হিজরত করে মদিনায় এসে দেখেন, মদিনাবাসী বছরে দু’দিন আনন্দ-উৎসব পালন করে। সেই উৎসব সম্পর্কে রাসুল (সা.) জানতে চাইলে তারা জানায়, জাহেলি যুগ থেকে আমরা এ দুই দিন উৎসব পালন করে আসছি। রাসুল (সা.) বললেন, ‘আল্লাহতায়ালা তোমাদের এ দুই দিনের বদলে উৎসবের জন্য অন্য উত্তম দুটি দিন দিয়েছেন। তা হলো- ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা।’ (সুনানে আবি দাউদ : ১/১৬১)। সেদিনের পর থেকে মুসলিম জাতি স্বমহিমায়, সগৌরবে বছরে দুটি ঈদ উৎসব পালন করে আসছে। ঈদ যেমন আনন্দের, তেমনি ইবাদতেরও। ঈদের দিন বেশ কিছু আমল রয়েছে, যার মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া যায়। একই সঙ্গে সমাজে প্রচলিত কিছু কাজ রয়েছে, যার সঙ্গে ঈদের কোনো সম্পর্ক নেই; এসব পরিহার করা চাই। ঈদুল ফিতরের এসব করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন- মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
ঈদের দিনে করণীয় ও বর্জনীয়

সকাল সকাল গোসল

ঈদের দিন সকাল সকাল গোসল করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা চাই। কারণ, ঈদের দিন গোসল করে ঈদগাহে যাওয়া মুস্তাহাব। সাহাবায়ে কেরাম গোসল করে ঈদগাহে যেতেন। নাফে (রহ.) বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাওয়ার আগে গোসল করে নিতেন। (মুয়াত্তায়ে মালেক : ৪৮৮)।

উত্তম পোশাক ও সাজসজ্জা

সামর্থ্য অনুযায়ী ঈদের দিন উত্তম পোশাক পরিধান করা এবং বৈধ সাজগোছ গ্রহণ করা মুস্তাহাব। সাহাবায়ে কেরাম এমনটি করতেন। নাফে (রহ.) বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) দুই ঈদে উত্তম পোশাক পরতেন। (সুনানে কোবরা লিল বাইহাকি : ৬১৪৩)। তবে উত্তম পোশাক মানে নতুন পোশাক নয়; বরং নিজের সংগ্রহে থাকা সবচেয়ে ভালো পোশাক পরা চাই। অন্য বর্ণনায় এসেছে, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) ঈদের দিন উত্তমভাবে গোসল করতেন, সুগন্ধি থাকলে তা ব্যবহার করতেন, নিজের সর্বোত্তম পোশাক পরিধান করতেন। এরপর ঈদের নামাজে যেতেন। (শরহুস সুন্নাহ : ৪/৩০২)।

সদকাতুল ফিতর আদায়

সামর্থ্যবান ব্যক্তিদের জন্য নিজের ও অধীনদের পক্ষ থেকে ঈদুল ফিতরে সদকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। অভাবী মুসলমানরা এ সদকার হকদার। সদকাতুল ফিতর আদায়ের উত্তম সময় হলো, ঈদের নামাজে যাওয়ার আগ পর্যন্ত। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রোজাদারকে অর্থহীন ও অশ্লীল কথা-কাজ থেকে পবিত্র করার জন্য এবং মিসকিনদের খাবারের ব্যবস্থা হিসেবে রাসুল (সা.) সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব করেছেন। যে (ঈদের) নামাজের আগে তা আদায় করবে, তা গ্রহণযোগ্য হবে। আর যে নামাজের পর আদায় করবে, তা সাধারণ সদকা হিসেবে বিবেচিত হবে।’ (সুনানে আবি দাউদ : ১৬০৯)। তাই ঈদগাহে যাওয়ার আগেই সদকাতুল ফিতর আদায় করা মুস্তাহাব।

ঈদগাহে যাওয়ার আগে খেজুর

ঈদের দিন রোজা রাখা নিষেধ। তাই এর প্রকাশ হিসেবে মুস্তাহাব হলো, ঈদগাহে যাওয়ার আগে কয়েকটি খেজুর খেয়ে যাওয়া এবং এ ক্ষেত্রে বেজোড় সংখ্যার প্রতি লক্ষ্য রাখা। খেজুরের ব্যবস্থা না থাকলে অন্য কোনো মিষ্টান্ন গ্রহণ করা। আনাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ঈদুল ফিতরে খেজুর না খেয়ে ঘর থেকে বেরুতেন না। তিনি বেজোড় সংখ্যক খেজুর খেতেন। (বোখারি : ৯৫৩)। এ আমল হলো ঈদুল ফিতরের জন্য। কেননা, ঈদুল আজহার ক্ষেত্রে মুস্তাহাব হলো, না খেয়ে ঈদগাহে যাওয়া এবং কোরবানির গোশত দিয়ে সর্বপ্রথম আহার গ্রহণ করা। রাসুল (সা.) ঈদুল ফিতরে না খেয়ে বেরুতেন না, আর ঈদুল আজহার দিন ঈদগাহ হতে ফেরার আগে কিছু খেতেন না। ঈদগাহ থেকে ফিরে পশু জবাই করার পর নিজ কোরবানির পশুর গোশত থেকে খেতেন। (মুসনাদে আহমদ : ২২৯৮৪)।

বেশি বেশি তাকবির পাঠ

ঈদগাহে যাওয়ার সময় বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে তাকবির বলতে থাকা চাই। তাকবিরটি হলো, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ। নাফে (রহ.) বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতরের সকালে সশব্দে তাকবির বলতে বলতে ঈদগাহে যেতেন এবং ইমাম আসা পর্যন্ত তাকবির বলতে থাকতেন। (সুনানে দারাকুতনি : ১৭১৬)।

ঈদগাহে ভিন্ন পথে যাতায়াত

সম্ভব হলে ঈদগাহে যাওয়ার সময় এক পথে যাওয়া আর ফেরার সময় ভিন্ন পথে আসা। নবীজি (সা.) এমনটি করতেন। জাবের (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) ঈদের দিন এক পথ দিয়ে ঈদগাহে যেতেন আর ভিন্ন পথ দিয়ে বাড়ি ফিরতেন। (বোখারি : ৯৮৬)।

হেঁটে ঈদগাহে গমন

যথাসম্ভব হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া মুস্তাহাব। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) ঈদগাহে হেঁটে যেতেন এবং হেঁটে ফিরতেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ : ১২৯৫)।

ঈদের নামাজ আদায়

ঈদের দিন সকালে পুরুষদের জন্য ঈদের নামাজ আদায় করা ওয়াজিব। বিশেষ পদ্ধতিতে অতিরিক্ত তাকবিরসহ জামাতে দু’রাকাত নামাজ আদায় করা এবং তারপর ঈদের খুতবা দেয়া ও শোনা চাই। ঈদের নামাজ খোলা ময়দানে আদায় করা উত্তম। কারণ, ঈদের জামাত রাসুল (সা.) সর্বদাই মাঠে গিয়ে আদায় করেছেন। বৃষ্টির কারণে একবার শুধু মসজিদে আদায় করেছেন। যা প্রমাণ করে, ঈদের জামাতের সুন্নাহসম্মত পদ্ধতি হলো মাঠে আদায় করা। বাকি যদি কেউ মসজিদে আদায় করে, তাহলেও তার নামাজ হয়ে যাবে। তবে ইচ্ছাকৃত সুন্নতকে ছেড়ে দেয়া উচিত হবে না। তাই সামর্থ্য থাকাবস্থায় ঈদের জন্য মাঠ রাখাই শরিয়তের নির্দেশ। (ফতোয়ায়ে শামি : ৩/৪৯)।

একে অপরের জন্য দোয়া

ঈদের দিন সাহাবায়ে কেরাম দোয়াসুলভ বাক্যে সৌজন্য বিনিময় করতেন। তাবেয়ি জুবাইর ইবনে নুফাইর (রহ.) বলেন, রাসুল (সা.)-এর সাহাবিরা ঈদের দিন পরস্পর সাক্ষাতে বলতেন, তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম। অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমাদের এবং তোমাদের আমলগুলো কবুল কর। (ফাতহুল বারি : ২/৪৪৬)। এ রকম সৌজন্য বিনিময়ের মাধ্যমে উত্তম আচরণ প্রকাশিত হয় এবং মুসলিম ভ্রাতৃত্ব সুদৃঢ় হয়।

ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়

ঈদে পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানো শরিয়ত অনুমোদিত একটি বিষয়। বিভিন্ন বাক্য দ্বারা এ শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেছেন, সাহাবায়ে কেরাম ঈদের দিন সাক্ষাৎকালে একে অপরকে বলতেন, ‘তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকা।’ অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা আমাদের ও আপনার ভালো কাজগুলো কবুল করুন। ঈদ মোবারক ইনশাল্লাহও বলা যেতে পারে। ঈদুকুম সাঈদ বলেও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়।

এতিম ও অভাবীকে পানাহার

ঈদের দিন এতিমের খোঁজখবর নেওয়া, তাদের খাবার খাওয়ানো এবং সম্ভব হলে তাদের নতুন কাপড়ের ব্যবস্থা করে দেয়া চাই। এটা ঈমানদারদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা খাদ্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও মিসকিন, এতিম ও বন্দিকে খাদ্য দান করে।’ (সুরা দাহর : ৮)।

আত্মীয়স্বজনের খোঁজ নেয়া

ঈদের দিন আত্মীয়স্বজনের খোঁজখবর নেয়া ও তাদের বাড়ি বেড়াতে যাওয়া চাই। পাশাপাশি প্রতিবেশীরও খোঁজখবর নিতে হবে।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা ইবাদত কর আল্লাহর, তাঁর সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করো না। আর সদ্ব্যবহার কর মাতাপিতার সঙ্গে, নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে, এতিমণ্ডমিসকিন, প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী পড়শী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাসদাসীদের সঙ্গে। নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদের, যারা দাম্ভিক, অহঙ্কারী।’ (সুরা নিসা : ৩৬)।

মনোমালিন্য দূরীকরণ

জীবন চলার পথে বিভিন্ন পর্যায়ে কারও কারও সম্পর্কের অবনতি হতে পারে। ঈদের সময় পারস্পরিক মনোমালিন্য দূর করা ও সম্পর্ক সুদৃঢ় করার উত্তম সময়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোনো মুসলমানের জন্য বৈধ নয় যে, তার ভাইকে তিন দিনের বেশি সময় সম্পর্ক ছিন্ন রাখবে। তাদের অবস্থা এমন যে, দেখা-সাক্ষাৎ হলে একজন অন্যজনকে এড়িয়ে চলে। এ দু’জনের মাঝে ওই ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ, যে আগে সালাম দেয়।’ (মুসলিম : ৬৬৯৭)।

আনন্দ প্রকাশ করা

ইসলাম এমন একটি জীবনব্যবস্থা, যেখানে সুষ্ঠু বিনোদনের সুযোগ রয়েছে। আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) ঈদের দিন আমার ঘরে এলেন, তখন আমার কাছে দু’জন কিশোরী বুয়াস যুদ্ধের বীরদের স্মরণে গান গাচ্ছিল। তারা পেশাদার গায়িকা ছিল না। এরই মধ্যে আবু বকর (রা.) ঘরে প্রবেশ করে এ বলে আমাকে ধমকাতে লাগলেন যে, নবীজি (সা.)-এর ঘরে শয়তানের বাঁশি? রাসুল (সা.) তার কথা শুনে বললেন, ‘ওদের গাইতে দাও হে আবু বকর! প্রত্যেক জাতির ঈদ আছে, আর এটি আমাদের ঈদের দিন।’ (বোখারি : ৯৫২)।

রোজা না রাখা

রমজানের পুরো মাস রোজা রাখার পর ঈদ মোমিন বান্দার জন্য আনন্দের দিন। তাই আল্লাহতায়ালা ঈদের দিন রোজা রাখা হারাম করেছেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) দু’দিন রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন। তা হলো- ঈদুল ফিতরের দিন এবং কোরবানির ঈদের দিন। (মুসলিম : ১১৩৮)।

বিজাতীয় আচরণ প্রদর্শন না করা

ঈদকে কেন্দ্র করে বিজাতীয় আচরণ মুসলিম সমাজে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। পোশাক-পরিচ্ছদে, চাল-চলনে, শুভেচ্ছা বিনিময়ে অমুসলিমদের অনুকরণে লিপ্ত হয়ে পড়েছে মুসলমানদের অনেকেই। আবদুল্লাহ বিন আমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি অন্য জাতির সঙ্গে সাদৃশ্য রাখবে, সে তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য হবে।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪০৩৩)।

খোলামেলা পোশাক না পরা

ঈদের দিন নারীরা ব্যাপকভাবে বেপর্দা অবস্থায় রাস্তাঘাটে খোলামেলা ঘোরাফেরা করে। এ থেকে বিরত থাকতে হবে। নিজের অধীন মেয়েদেরও বিরত রাখতে হবে। এ বিষয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা নিজ ঘরে অবস্থান করবে এবং প্রাচীন মুর্খতার যুগের মতো নিজেদের প্রদর্শন করে বেড়াবে না।’ (সুরা আহজাব : ৩৩)।

অপচয়-অপব্যয় না করা

ঈদের কেনাকাটা থেকে শুরু করে এ উপলক্ষে সবকিছুতেই অপচয়-অপব্যয় করা হয়। অথচ আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা কোনোভাবেই অপব্যয় করো না, নিশ্চয় অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৬-২৭)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘তোমরা পানাহার কর, কিন্তু অপচয় করো না।’ (সুরা আরাফ : ৩১)।

মদ ও আতশবাজি না করা

ঈদের আনন্দে মদ খাওয়া, জুয়া খেলা, আতশবাজি করা শরিয়তবিরোধী কাজ। শুধু ঈদ নয়, অন্য কোনো দিনও এসব করা যাবে না।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনরা! নিশ্চয় মদণ্ডজুয়া, প্রতিমা-বেদি ও ভাগ্যনির্ধারক তিরগুলো তো নাপাক শয়তানের কর্ম। সুতরাং তোমরা তা পরিহার কর; যাতে সফলকাম হও।’ (সুরা মায়িদা : ৯০)।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত