ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঈদ আমাদের সংস্কৃতির প্রতীক

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী
ঈদ আমাদের সংস্কৃতির প্রতীক

যে কোনো সম্প্রদায়, জাতি বা জনগোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনা, কর্ম ও দীর্ঘদিনের জীবনাচারের বাস্তব রূপকেই যদি সংস্কৃতি বলা হয়, তাহলে নামাজ, রোজা ও ঈদকেই বাঙালি মুসলমানদের জাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে আখ্যায়িত করতে হবে। সত্যিকারার্থে পবিত্র ঈদুল ফিতর ও কোরবানির ঈদের মধ্য দিয়েই আমাদের সাংস্কৃতিক জীবনের বাস্তব প্রতিফলন ঘটে। কারণ, যে কোনো জাতির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রদর্শনী হয় ওই জাতির জাতীয় উৎসবের মাধ্যমে। অর্থাৎ জাতীয় উৎসবগুলোই জাতীয় সংস্কৃতিকে সমাজের সামনে তুলে ধরে। যেসব আচার-অনুষ্ঠান জাতীয় উৎসবে স্থান পায় না, সেগুলোকে ওই জাতির সংস্কৃতি বলে চালিয়ে দেয়ার প্রবণতা সত্যের অপালাপ ছাড়া কিছু নয়।

কাজেই বাঙালি বা বাঙালি মুসলমানদের জাতীয় সংস্কৃতি কোনটি? নামাজ, রোজা, জামাতে নামাজ, জুমা, ঈদের নামাজ, টুপি, পাঞ্জাবি, দান-খয়রাত, জাকাত, প্রেমণ্ডভালোবাসার আদান-প্রদান, মিলাদ মাহফিল ইত্যাদি নাকি নাচগান, বাদ্যযন্ত্র ও বেলেল্লাপনা? এর বিতর্ক নিষ্পত্তির জন্য আমাদের একটি সর্বজনস্বীকৃত মূলনীতির আশ্রয় নিতে হবে। সেই মূলনীতি হলো, জাতীয় উৎসবগুলোতে সর্বস্তরের জনগণ (কোনো বিশেষ শ্রেণি নয়) যে আচার-অনুষ্ঠানের অনুশীলন করে এবং ওই উৎসবে আমরা যে চিত্র দেখতে পাই, সেটিই ওই জাতির সংস্কৃতি।

এ মূলনীতিকে সামনে রেখে এ সত্যটি অস্বীকার করা কারও পক্ষে সম্ভব হবে না যে, রমজান শেষের ঈদ এবং কোরবানির ঈদই হচ্ছে এ দেশ, সমাজ ও মানুষের জাতীয় উৎসব। জাতীয় উৎসব বলতে তাতে সমাজের সর্বস্তরের ছোট-বড়, গরিব-ধনী, শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব মানুষের অংশগ্রহণ চাই। কোনো একটি বিশেষ শ্রেণি বা গোষ্ঠী বিশেষ ধরনের আনন্দ উৎসবের আয়োজন করলে তাকে জাতীয় উৎসব বলা যাবে না। এ আলোচনায় আশা করি এ বিতর্কের সমাধান হয়ে গেছে এবং এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে, বছরে দুই ঈদের মহাজাতীয় উৎসবের মাধ্যমে যে সুন্দর জীবনাচার ফুটে ওঠে, সেটাই আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি।

এ সংস্কৃতিতে নামাজ আছে, জামাত আছে, রোজা আছে, হিংসা-দ্বেষ ভুলে গিয়ে নতুন করে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অনুশীলন আছে। শত্রু-মিত্রে গলাগলি-জড়াজড়ি আছে। এ সংস্কৃতিতে আল্লাহর হুকুম পালনের প্রশিক্ষণ আছে। সেই প্রশিক্ষণে কৃতকার্য হওয়ার আনন্দ আছে। ক্ষুধার্ত অনাহারীকে অন্ন দান, গরিব-দুঃখীকে জাকাত দান, সমাজের সব মানুষের জন্য ঘরের দুয়ার খুলে রাখা, উদার মনে শিরনি-পোলাও বিতরণ, দল বেঁধে মাঠে গিয়ে ইমামের খুতবা শোনা, নামাজে শামিল হয়ে আল্লাহর দাসত্বের প্রশিক্ষণ, আল্লাহর রাহে নিজের সর্বস্ব বিসর্জন দেয়ার প্রমাণস্বরূপ পশু কোরবানি করা, সেই কোরবানির গোশত গরিব ও আত্মীয়স্বজনকে বিলিয়ে দেয়া আর ধনী-গরিবের শ্রেণি সংগ্রামের পরিবর্তে প্রেম ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে সুখী সমাজ গড়ার শিক্ষা আছে এ সংস্কৃতিতে।

ঈদই আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির মূর্ত প্রতীক। এ ঈদে শামিল হয় নিঃস্ব, গরিব আর ধনী ও সামর্থ্যবানরাও; ছোট শিশু থেকে নিয়ে মৃত্যুমুখী বৃদ্ধও। ঈদ অনুষ্ঠানে অংশ নেয় না, ঈদের জামাতে শামিল হয় না, ঈদের আনন্দ উপভোগ করে না- এরূপ একটি লোকও খুঁজে পাওয়া যাবে না বাংলার মুসলিম সমাজে। তাই এ দুই ঈদই হলো আমাদের মহাজাতীয় উৎসব। এর বিপরীতে যারা শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চার নামে এ সমাজে নাচগান ও বাদ্যযন্ত্রের আমদানি করতে চায়, আর এই নাচগানকে জাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে চালিয়ে দিতে চায়, তারা আসলে সংস্কৃতির মানেই বোঝেনি; বরং নফস, শয়তান ও বিজাতীয় শয়তান দ্বারা চালিত হয়ে আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে জাতীয় স্বকীয়তা বিসর্জন দেয়ারই চক্রান্ত করে। বিজাতির কাছ থেকে আমদানি করা চিন্তাধারা নয়; বরং স্বকীয় চিন্তাধারার আলোকে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা জাতীয় জীবনের এসব মৌলিক বিষয় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবেন, এ কামনা করছি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত