আল্লাহতায়ালা মোমিনের জন্য রমজান উপহার দিয়েছেন একটি বিশেষ উদ্দেশ্যে। তা হলো, তাকওয়া অর্জন করা। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর; যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।’ (সুরা বাকারা : ১৮৩)। তাকওয়ার সরল অর্থ হলো, আল্লাহর আদেশগুলো যথাযথভাবে মানা এবং নিষেধগুলো থেকে পরিপূর্ণরূপে বিরত থাকা। রমজান এসে আমাদের এ দুটি জিনিসের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। রোজা, নামাজ, তেলাওয়াত, দোয়া, দান, সহমর্মিতা, সংযম ও সততার গুণে গুণান্বিত হওয়ার ওপর উদ্বুদ্ধ করেছে। পাপাচার, অশ্লীলতা, মিথ্যা ও পরনিন্দাসহ যাবতীয় মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকতে অভ্যস্ত করেছে। সুতরাং রমজান শেষে শাওয়ালের এ প্রহরে অবশ্যই একটু গভীরভাবে ভাবতে হবে, রমজানের উদ্দেশ্য অর্জন হয়েছে কি-না? সামনের দিনে রমজানের দেয়া শিক্ষাগুলো ধরে রাখার দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ করতে হবে।
রোজার রাখার ধারাবাহিকতা
দীর্ঘ ৩০ দিন আমরা রোজা রেখেছি। আল্লাহর এক মহান বিধান ও বিরাট ফজিলতপূর্ণ এ আমলে আমরা কিছুটা হলেও অভ্যস্ত হয়েছি। সুতরাং রমজান শেষ হলেও যেন এ রোজা রাখার ধারাবাহিকতা বন্ধ না হয়ে যায়। রাসুল (সা.) রমজানের পরের মাসেই ছয়টি রোজা রাখতেন, যা শাওয়ালের ছয় রোজা হিসেবে পরিচিত। প্রতি চান্দ্র মাসের আইয়ামে বিজ তথা ১৩, ১৪, ১৫ তারিখে রোজা রাখতেন। প্রতি সপ্তাহে সোম ও বৃহস্পতিবার রোজা রাখতেন। এ ছাড়া মহররমের রোজা, জিলহজের রোজা, শাবানের রোজাসহ বিভিন্ন সময়ে রোজা রাখতেন। রোজার রাখার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে আমাদেরও রাসুল (সা.) এর অনুসরণ করতে হবে।
নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত
রমজানে কমবেশি সবাই কোরআন তেলাওয়াত করেছি, অনেকেই খতম করেছি, তারাবিতে কোরআন শুনেছি, কোরআনের তাফসিরে বসেছি। এর দ্বারা কোরআনের সঙ্গে আমাদের হৃদ্যতা তৈরি হয়েছে। এ পবিত্র হৃদ্যতা অটুট রাখা আমাদের কর্তব্য। তাই রমজানের পরও প্রতিদিন কিছু সময় বের করে কোরআন তেলাওয়াত করা চাই। তা হোক ২০মিনিট, কিংবা ১৫ ও দশ মিনিট। নিয়মিত হলে কোরআনের প্রকৃত স্বাদ আসতে শুরু করবে। মাঝে মাঝে নির্ভরযোগ্য অনুবাদ খুলে দেখা যেতে পারে। পাশাপাশি তাফসিরে চোখ বুলানোর সুযোগ হলে খুবই ভালো।
দানের হাত প্রসারিত
রমজান আমাদের সহমর্মিতা শিক্ষা দিয়েছে। রোজা রাখার মধ্য দিয়ে অনাহারে দিনাতিপাত করার কষ্টটা কিছুটা হলেও টের পেয়েছি আমরা। তাই সবাই সাধ্যমতো অসহায়কে সহযোগিতা করেছি। জাকাত দিয়েছ, ফিতরা দিয়েছি। সাধারণ দানের হাতও বাড়িয়েছি প্রচুর। এটা রমজানের মহৎ এক শিক্ষা। তাই তো নবীজি (সা.) রমজান এলে রহমতের বায়ুর চেয়েও অধিক দানশীল হতেন। সুতরাং রমজানের এ মহান শিক্ষাটুকু নিজের মাঝে জাগরুক রাখতে হবে সারাজীবন। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-পড়শি, মহল্লার হতদরিদ্র ও সমাজের খেটে খাওয়া মানুষগুলোর প্রতি সদা দয়ার দৃষ্টি দিতে হবে। সুযোগ পেলেই তাদের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিতে হবে। দানের হাত প্রসারিত করতে হবে।
দোয়ার পূর্ণ এহতেমাম
ব্যক্তিগত কিংবা সম্মিলিতভাবে কত দোয়া করেছি রমজানজুড়ে! নিজের জন্য, মা-বাবার জন্য, ছেলে-সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনের জন্য দোয়া করেছি। কত চোখের পানি ঝরিয়েছি মুসলিম উম্মাহ ও মসজিদুল আকসার জন্য! কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত মানুষগুলোর জন্য! রাতের শেষ প্রহরে, ইফতারের আগমুহূর্তে, জুমার দিনে, কোরআন তেলাওয়াত শেষে নামাজের মুসল্লায় হৃদয় উজাড় করে আল্লাহর কাছে চেয়েছি। রমজানের পরও যেন বান্দা ও রবের মাঝের এ সকাতর আলাপন জারি থাকে। আল্লাহর কাছে চাইলেই তিনি খুশি হন। কারণ, তিনি দিতে ভালোবাসেন। তাই রমজানের বাইরেও দোয়া করা অব্যাহত রাখতে হবে।
অবক্ষয় ও অশ্লীলতা রোধ
রমজান আমাদের উত্তম ও সুন্দর চরিত্রের সবক দিয়েছে। মিথ্যা পরিহার করতে বলেছে। অন্যথায় এত কষ্টের রোজা সম্পূর্ণ বৃথা সাব্যস্ত করেছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও সে অনুযায়ী আমল বর্জন করেনি, তার এ পানাহার পরিত্যাগ করায় আল্লাহ?র কোনো প্রয়োজন নেই।’ (বোখারি : ১৯০৩)। ঝগড়া-বিবাদ থেকে দূরে থাকার অনুশীলন করিয়েছে রমজান। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সিয়াম ঢালস্বরূপ। সুতরাং অশ্লীলতা করবে না এবং মূর্খের মতো কাজ করবে না। যদি কেউ তার সঙ্গে ঝগড়া করতে চায়, তাকে গালি দেয়, তবে সে যেন বলে, আমি রোজা রেখেছি।’ (বোখারি : ১৮৯৪)। সুতরাং মিথ্যা বলা ও ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হওয়ার মতো হীন কাজ সব সময়ের জন্য পরিত্যাগ করাই মোমিনের পরিচয়।
প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে মুক্ত থাকা
রমজান আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু শয়তান ও তার কুমন্ত্রণা থেকে দূরে রেখেছে। পানাহার ও সহবাস থেকে বিরত রাখার মাধ্যমে নিজের কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে চলার প্রশিক্ষণ দিয়েছে। সংযমের গুণ ধারণ করতে বলেছে। সুতরাং রমজানের বাইরেও সারা বছর শয়তান ও প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে বেঁচে থাকতে হবে। মহান আল্লাহর আনুগত্যের মধ্যে পুরো সময় পার করতে হবে। রমজানের পরও রমজানকে ধরে রাখতে হবে। তবেই তার আগমন-নির্গমন, রাত্রি জাগরণ ও দিনভর অনাহারে থাকা সার্থক হবে।