দেশের অর্থনীতিতে হজের ভূমিকা

মিনহাজুল আরিফীন

প্রকাশ : ০৭ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

দেশের অর্থনীতিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় হয় হজের মৌসুমে। বিরাট এ অর্থবাণিজ?্য সম্পাদিত হয় দেশের ছোট-বড় হজ এজেন্সিগুলোর মাধ?্যমে। এর সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত মেলে করোনার বছরগুলোতে হজ এজেন্সিগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলে। কারণ, করোনাভাইরাসের কারণে ওমরা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং হজ পালন নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়েছিল ওমরা ও হজ এজেন্সিগুলো। অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাওয়ায় হজ বাণিজ?্য প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। ফলে ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়েছিল এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এজেন্সি মালিকসহ বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীর জীবন-জীবিকা। ঠিক সেই দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে সবার সামনে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, হজের মৌসুমটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আশঙ্কা করা হয়েছিল, করোনার কারণে যদি গত বছরও হজ বাতিল হয়ে যেত, তাহলে পুরো বছরে ওমরা ও হজ মিলিয়ে এজেন্সিগুলোর ৬ হাজার ১২৫ কোটি টাকা লোকসান হতো।

হজের কল্যাণে রুটিরুজি

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হজ এজেন্সির মালিক দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘ওমরা ও হজ ব্যবসা করে আমরা পরিবার চালাই। এর আয় দিয়ে সারা বছরের জীবন-জীবিকা নির্বাহ হয়। হজ-ওমরা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং হজ কার্যক্রম সীমিত হয়ে যাওয়ায় কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন দিতে পারছি না। অফিস ভাড়াও বাকি পড়ে আছে। জানি না কি হবে, হজ না হলে আমরা তো মাঠে মারা যাব।’ বাংলাদেশ হজযাত্রী ও হাজি কল্যাণ পরিষদের সভাপতি ড. আবদুল্লাহ আল নাসের জানিয়েছিলেন, এজেন্সিগুলোর অবস্থা শোচনীয়। হজ না হলে না খেয়ে থাকতে হবে। হজ ও ওমরা এজেন্সিসহ এর সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের পরিবারকে বাঁচাতে হলে আর্থিক প্রণোদনা দিতে হবে সরকারকে। হজের কার্যক্রম সীমিত হয়ে যাওয়ায় অধিকাংশ হজ এজেন্সি লোকসানের মুখে পড়ে কর্মচারীদের বেতন এবং অফিস ভাড়া দিতে পারছে না বলেও জানান তিনি।

হজ বন্ধ হলে বাড়বে পরমুখাপেক্ষিতা

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে হজ-ওমরা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং হজ কার্যক্রম সীমিত হয়ে যাওয়ায় বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা করেছিল হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)। আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হাবের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে বিশেষ অর্থনৈতিক প্রণোদনা চেয়ে অর্থমন্ত্রী বরাবর চিঠিও দেয়া হয়েছিল। হাব সভাপতি এম শাহাদত হোসেন তসলিম বলেন, বাংলাদেশের মোট হজযাত্রীর ৯৬ শতাংশ এবং ওমরাযাত্রীর শতভাগ কার্যক্রম হাব সদস্য হজ ও ওমরা এজেন্সির প্রত্যক্ষ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। হাবের সদস্যরা ট্রাভেল ও ট্যুর অপারেশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ফলে করোনাভাইরাসের প্রভাবে তারা বিপুল অঙ্কের অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। আল রাইয়ান এয়ার ইন্টারন্যাশনাল ট্যুর অ্যান্ড ট্রাভেল এজেন্সির স্বত্বাধিকারী সোহানুর রহমান সাঈদি বলেন, এ বছর প্রাক-নিবন্ধন করা অনেকেই বলেছেন, তারা অতিরিক্ত অর্থের ব্যবস্থা করতে পারছেন না। কেউ কেউ বলছেন, জমি-জমা বিক্রির পরও এবার হজের টাকা জোগাড় হচ্ছে না। তারা হজে যেতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন। এদিকে আমরা সারা বছর হজের জন্য অপেক্ষা করি। এখন আমাদের আয়-রোজগারের মৌসুম। এখন যদি কোটা পূরণ করা সম্ভব না হয়, তাহলে এবারও আমাদের বড় লোকসানে পড়তে হবে।

হাবের শীর্ষ নেতারা বলছিলেন, হজ-ওমরা বন্ধ থাকা ও আসন্ন হজ অনুষ্ঠিত না হলে এজেন্সিগুলো সর্বসাকুল্যে ৬ হাজার ১২৫ কোটি টাকা ক্ষতির সম্মুখীন হবে। ব্যবসা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হাজার হাজার কর্মচারীর বেকার হওয়ারও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। সরকারের আর্থিক প্রণোদনা ছাড়া যেটা পূরণ করা তাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। তাই এ বিপুল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হাব নেতারা সরকারের কাছে বিশেষ অর্থনৈতিক প্রণোদনাও চেয়েছিলেন। সেই প্রেক্ষিতে চার দফার বিশেষ অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্রস্তাব দাবি করে অর্থমন্ত্রীর কাছে চিঠি দেয়া হয়েছিল।

হজ বন্ধে ক্ষতির কারণ

করোনাভাইরাসের প্রভাবে হজ, ওমরা, ট্রাভেল ও ট্যুরিজম সেক্টর কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জানতে চাইলে হাব সভাপতি এম শাহাদত হোসেন তসলিম বলেছিলেন, বর্তমানে হাবের সদস্য সংখ্যা ১ হাজার ২৩৮। হজ এজেন্সিগুলোর মালিকসহ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা সর্বসাকুল্যে প্রায় ২০ হাজার। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাসিক বেতন এবং অফিস ভাড়া ও অন্যান্য খরচসহ মাসে প্রায় ৫০ কোটি টাকা খরচ হয়। এ ছাড়া এ পেশার সঙ্গে পরোক্ষভাবে বাংলাদেশ ও সৌদি আরবে আরও প্রায় এক লাখ লোক নিয়োজিত আছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মোট হজযাত্রীর ৯৬ শতাংশ এবং ওমরাযাত্রীর শতভাগ কার্যক্রম হাব সদস্য হজ ও ওমরা এজেন্সির প্রত্যক্ষ ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। হাবের সদস্যরা ট্রাভেল ও ট্যুর অপারেশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ফলে করোনাভাইরাসের প্রভাবে তারা বিপুল অঙ্কের অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।

এ ছাড়া এ অর্থ-বছরের শেষ অর্থাৎ আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত হজ ও ওমরা হজ এজেন্সিগুলোর ওভারহেড খরচ যেমন অফিস ভাড়া ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদি মাসিক প্রায় ৫০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। ফলে অসংখ্য এজেন্সি সারা বছরের অফিস ভাড়া ও কর্মচারীদের বেতন পরিশোধ করার সক্ষমতা হারাবে। করোনাভাইরাসের কারণে এ সেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হলে আগামীতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ১০ হাজার কর্মচারী এবং বাংলাদেশ ও সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশিসহ পরোক্ষভাবে জড়িত ৫০ হাজার ব্যক্তির চাকরি হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ট্রাভেল ট্যুরিজম সেক্টরের ক্ষতির কথা উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, সদস্যদের সবাই ট্রাভেল এজেন্ট, অনেকেই ট্যুর অপারেটর এবং পর্যটন শিল্পের অন্যান্য সেক্টরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। তাদের অনেকেই অ্যাভিয়েশন, দেশি-বিদেশি ট্যুরিজম, হোটেল রিসোর্ট ব্যবসা ও ট্যুরিস্ট ট্রান্সপোর্টেশন ইত্যাদি ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। হাবের অনেক সদস্য এখানেও ব্যবসায়িক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন এবং সেক্টরগুলোতে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরি হারানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। অর্থমন্ত্রীর কাছে দেয়া চিঠিতে চার দফা প্রণোদনা প্রস্তাবের শেষে হাব সদস্য, হজ, ওমরা ও ট্রাভেল এজেন্সির অপারেটরসহ সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এবং এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদানের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে।

ক্ষতির পরিমাণ

অর্থমন্ত্রীর কাছে দেয়া চিঠিতে হাব সভাপতি এরই মধ্যে হাব সদস্যদের হয়ে যাওয়া অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করে বলেন, করোনার কারণে সৌদি সরকার ওমরা বন্ধ ঘোষণার পর ১০ হাজার ওমরাযাত্রীর ভিসা, এয়ার টিকিটের মূল্য বাবদ ১০০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছিল। এ ছাড়া আসন্ন রমজান মাসে ওমরা হজে গমনকারীদের জন্য আরও ২৫ কোটি টাকা মূল্যের ৫ বাজার এয়ার টিকিট অগ্রীম কেনা হয়। এ ছাড়া কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মার্চ মাসের বেতন ও অন্যান্য অফিস খরচসহ প্রায় ৫০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। এ বাবদ লোকসানের পরিমাণ ১৭৫ কোটি টাকা।

সম্ভাব্য ব্যবসায়িক লেনদেনের ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়, আগামী রমজান পর্যন্ত কমপক্ষে আরও ১ লাখ ওমরাযাত্রীর ওমরা করানোর জন্য প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা লেনদেন হতো। এ ছাড়া এ বছর বেসরকারিভাবে ১ লাখ ২০ হাজার হজযাত্রী পবিত্র হজ পালনের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। যদি কোনো কারণে চলতি বছর তারা হজে যেতে না পারেন, তাহলে এ বাবদ ব্যবসায়িক লেনদেনের ক্ষতির পরিমাণ হবে ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। লোকসান পূরণের কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। উল্লিখিত রিপোর্টগুলো দ্বারা সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, হজ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এক বিরাট আশীর্বাদস্বরূপ। হজের সুবাদেই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে এক বিরাট অঙ্কের আয়ের খাত। যার কল?্যাণে হাজার হাজার বাঙালির রুটি-রোজগারের ব?্যবস্থা হচ্ছে।