সত্যের জয় যেমন অবশ্যম্ভাবী, মিথ্যার পরাজয়ও তেমন সুনিশ্চিত। দিন শেষে সত্যই মানুষের গলায় পরিয়ে দেয় চূড়ান্ত বিজয়ের ফুলের মালা। সব প্রতিকূলতা জয় করে আপন বিভায় জ্বলে ওঠে সত্যের আলোকবর্তিকা। মিথ্যার অন্ধকারকে বিদূরিত করে হকের আলো ছড়িয়ে দেয় পৃথিবীর দিগ-দিগন্তে। সত্যবাদিতার মহৎ এ গুণ মানব চরিত্রকে যেমন সৌকর্যময়, শুভমণ্ডিত ও ঈর্ষণীয় করে তোলে, তেমনি তনুমনকে করে উদ্বেলিত, স্পন্দিত, সুরভিত ও প্রফুল্লিত। সত্যবাদী সবখানেই নন্দিত হয়, হয় সবার জন্য অনুপম আদর্শ। সত্যের মহিমা, কর্মের দীপ্তি ও সফলতার স্নিগ্ধ আলোয় উদ্ভাসিত হয় চারপাশ। সৎ ব্যক্তির জীবন হয় ঈমানি আবেশে প্রাণময়, নৈতিক ভাবাবেগে মধুময়। সে সবার কাছে যেমন গ্রহণযোগ্য, মাননীয় এবং শ্রদ্ধেয় হয়, তেমনি হয় সবখানে বরিত, প্রশংসিত এবং সমাদৃত। পক্ষান্তরে মিথ্যুক সব জায়গায় নিন্দিত, ঘৃণিত এবং প্রত্যাখ্যাত হয়। যার রক্ত-মাংসে মিথ্যার কদর্যতা মিশে যায়, সে নীচতা, হীনতা ও ইতরতার চরমে পৌঁছে যায়। ফলে মিথ্যার অসহনীয় দুর্গন্ধে তার জীবন যেমন বিষিয়ে ওঠে, তেমনি তলিয়ে যায় সে অপমান, লাঞ্ছনা ও বঞ্চনার চোরাবালিতে।
কোরআনের ভাষায় সত্যবাদীর সংজ্ঞা
সত্যবাদিতা ও সততা শুধু জবানের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়; এর বলয় অত্যন্ত ব্যাপক, সুদূরপ্রসারী। হৃদয়ের পবিত্রতা ও কর্মের স্বচ্ছতাও এর অন্তর্ভুক্ত। অন্তরের সততা হলো, একে কপটতা, ছলনা, প্রতারণা, ধোঁকা ও দ্বিমুখী মানসিকতা থেকে পবিত্র রাখা। আর কর্মের সত্যতা হলো, কথা ও কাজে মিল থাকা; কর্মস্থলে ফাঁকিবাজি না করা; নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা; হালাল পন্থায় উপার্জন এবং সৎকাজে ব্যয় করা। এ কাঙ্ক্ষিত গুণ যাদের মধ্যে পরিপূর্ণরূপে পাওয়া যায়, কোরআন মাজিদের পরিভাষায় তাদের প্রকৃত সত্যবাদী বলা হয়। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ প্রকৃত সত্যবাদী ও মুত্তাকিদের সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে, ‘পুণ্য তো শুধু এটাই নয় যে, তোমরা নিজেদের চেহারা পূর্ব বা পশ্চিম দিকে ফেরাবে; বরং পুণ্য হলো (সেই ব্যক্তির), যে ঈমান রাখে আল্লাহর শেষ দিনের ও ফেরেশতাদের প্রতি এবং (আল্লাহর) কিতাব ও নবীদের প্রতি। আর আল্লাহর ভালোবাসায় নিজ সম্পদ দান করে আত্মীয়-স্বজন, এতিমণ্ডমিসকিন, যাচনাকারীদের, দাসমুক্তিতে এবং সালাত কায়েম করে ও জাকাত দেয় এবং যারা কোনো প্রতিশ্রুতি দিলে তা পূরণে যত্নবান থাকে এবং সংকটে-কষ্টে ও যুদ্ধকালে ধৈর্যধারণ করে, এরাই প্রকৃত সত্যবাদী (নামে অভিহিত হওয়ার উপযুক্ত) এবং মুত্তাকি।’ (সুরা বাকারা : ১৭৭)। অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে, ‘মোমিন তো তারা, যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলকে অন্তরে স্বীকার করেছে, অতঃপর কোনো রকম সন্দেহ-সংশয়ে পতিত হয়নি এবং আল্লাহর পথে নিজের জানমালের দ্বারা পুরোপুরি চেষ্টা-প্রয়াস চালিয়েছে। শুধু তারাই হলো সত্যিকারের সত্যবাদী।’ (সুরা হুজুরাত : ১৫)। সত্যবাদিতার বিপরীত হলো কপটতা বা মোনাফেকি। তাই তো ঐশীগ্রন্থে সত্যবাদীদের বিপরীতে আনা হয়েছে মোনাফেকদের আলোচনা। এরশাদ হয়েছে, ‘যাতে আল্লাহতায়ালা সত্যনিষ্ঠদের তাদের সততার পুরস্কার দান করেন এবং ইচ্ছে করলে মোনাফেকদের শাস্তি দেবেন অথবা তাদের তওবা কবুল করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা আহজাব : ২৪)। যুগে যুগে নবী-রাসুলরা ছিলেন পরম সত্যবাদী। তারা হৃদয়ের ডানা মেলে মানুষের সামনে সত্যই উপস্থাপন করতেন। আল্লাহর প্রিয় মুত্তাকি বান্দাদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তারা সদা সত্য কথা বলেন এবং সত্যকে সত্যায়ন করেন। পবিত্র কোরআনের বাণী, ‘যে ব্যক্তি সত্য কথা নিয়ে আসে এবং নিজেও তা বিশ্বাস করে, এরূপ লোকেরাই মুত্তাকি। তারা তাদের প্রতিপালকের কাছে পাবে সবকিছু। এটাই সৎকর্মশীলদের প্রতিদান।’ (সুরা যুমার : ৩৩-৩৪)।
সত্যবাদিতা নবী-রাসুলদের বিশেষ গুণ
মানবজাতির হেদায়েতের লক্ষ্যে আল্লাহতায়ালা যত নবী-রাসুল দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন, সবাই ছিলেন আপন যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সত্যবাদী। সত্যের সুবাসিত ফুল ফুটিয়ে তারা মানবমণ্ডলীকে ইহ-পারলৌকিক সুখ, সাফল্য ও সমৃদ্ধিময় সর্বব্যাপী জীবনব্যবস্থা উপহার দিয়েছেন। পাপাচারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত জাতির দুষ্কৃতি, কুসংস্কার, দুষ্টু স্বভাব ও নিকৃষ্ট ক্রিয়াকর্মের দুর্বার প্রতিযোগিতাকে নস্যাৎ করতে সক্ষম হয়েছিলেন সত্যের মহিমায়। তাই তো তারা এখনও অমর হয়ে আছেন ঐশীগ্রন্থের বর্ণিল পাতায়। দয়াময় আল্লাহ বলেন, ‘আপনি এ কিতাবে ইবরাহিমের বৃত্তান্তও বিবৃত করুন, নিশ্চয় তিনি ছিলেন সত্যনিষ্ঠ নবী।’ (সুরা মারইয়াম : ৪১)। আরও বলেন, ‘এ কিতাবে ইসমাঈলের বৃত্তান্ত বিবৃত করুন, নিশ্চয় তিনি ছিলেন প্রতিশ্রুতি পালনে সত্যাশ্রয়ী এবং তিনি ছিলেন রাসুল ও নবী।’ (সুরা মারইয়াম : ৫৪)। এমনিতে প্রত্যেক নবীই ওয়াদা রক্ষায় সত্যনিষ্ঠ হয়ে থাকেন। তা সত্ত্বেও ইসমাঈল (আ.)-কে বিশেষভাবে এ বিশেষণে বিশেষিত করা হয়েছে এ সম্পর্কিত তার এক অসাধারণ ঘটনার কারণে। যখন আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে তাকে জবাই করার হুকুম দেয়া হয়েছিল, তখন তিনি পিতার সঙ্গে ওয়াদা করেছিলেন, জবাইকালে তিনি পরিপূর্ণ ধৈর্যধারণ করবেন। পিতা যখন আল্লাহতায়ালার নির্দেশ মতো তাকে জবাই করতে উদ্যত হন এবং তিনি সাক্ষাৎ মৃত্যুর সম্মুখীন হন, তখনও নিজ ওয়াদার কথা ভোলেননি; বরং ধৈর্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেছিলেন। মুফাসসিররা তার ওয়াদা রক্ষার এ ছাড়া আরও কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। (তাফসিরে তাওযিহুল কোরআন : ২/২৯৯)। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এ কিতাবে ইদরিসের বৃত্তান্তও বিবৃত করুন, নিশ্চয় তিনি ছিলেন একজন সত্যবাদী নবী।’ (সুরা মারইয়াম : ৫৬)। কোরআনে কারিমে এমন আরও অনেক আল্লাহর প্রিয় বান্দার বিশেষ গুণ হিসেবে সত্যবাদিতা, সততা ও বিশ্বস্ততার কথা আলোচনা করা হয়েছে। তাই আল্লাহর প্রিয় ও নৈকট্যশীল বান্দা হতে চাইলে অবশ্যই যাবতীয় মিথ্যা পরিত্যাগ করতে হবে। জীবনের অঙ্গনে সাধনার প্রাঙ্গণে সত্যের চর্চা করতে হবে।
নবীজির সত্যবাদিতা
বিশ্ব মানবতার অনুপম রূপকার প্রিয় নবীজি (সা.) ছিলেন সত্যবাদিতা ও সততার মূর্ত প্রতীক। জীবনে কোনোদিন তিনি মিথ্যার আশ্রয় নেননি। প্রতি মুহূর্তে তিনি সত্যকে লালন করেছেন মনের গভীরে। পুরো পৃথিবী যখন দুর্নীতি, ধোঁকাবাজি ও প্রতারণার অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল, চারদিকে জাহেলিয়াতের জুলুমণ্ডনির্যাতনের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছিল, বর্বরতার লু-হাওয়া যখন পৃথিবীকে ভারী করে তুলেছিল, এমন সময় তিনি অমানিশার অন্ধকার দূরে ঠেলে বিশ্বভুবনে সত্যের আলো জ্বেলে দিয়েছিলেন। তাই তো নবুয়ত লাভের আগেই তাঁকে মক্কার মুশরিকরা ‘আল আমিন’ (পূর্ণ বিশ্বস্ত) উপাধিতে ভূষিত করেছিল। তাঁর কাছেই লোকেরা নিজেদের মূল্যবান ধন-সম্পদ গচ্ছিত রাখত এবং নিরাপদ মনে করত। আবু সুফিয়ান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার আগে ব্যবসার উদ্দেশে কোরাইশদের কাফেলায় শামে (বর্তমান সিরিয়ায়) গিয়েছিলেন। শাম ওই সময় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। সম্রাট কোনো কারণে শামে অবস্থান করছিলেন। তখন রাষ্ট্রপ্রধান হিরাক্লিয়াস সে কাফেলাকে রাজদরবারে ডেকে এনে দোভাষীর মাধ্যমে আবু সুফিয়ানকে কিছু প্রশ্ন করেন। এর মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল, তার নবুয়তের দাবির আগে তোমরা কি কখনও তাকে মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছ? তিনি অকপটে বললেন, না। (বোখারি : ৭)। এটি হচ্ছে তার সম্পর্কে এমন ব্যক্তির সাক্ষ্য, যিনি ওই সময় পর্যন্ত নবীজি (সা.)-এর প্রাণের দুশমন ছিলেন এবং তার মর্যাদাহানির সুবর্ণ সুযোগ খুঁজছিলেন। কিন্তু নবীজি (সা.)-এর সত্যবাদিতার স্বীকারোক্তির ব্যাপারে সামান্যতম ইতস্ততাবোধেরও সুযোগ পাননি।
নবীজির সত্যবাদিতার অকুণ্ঠ স্বীকৃতি
নবীজি (সা.) কর্তৃক মানবগোষ্ঠীকে আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি আহ্বানের প্রথম দিকের ঘটনা। বোখারি শরিফে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত; কোরআন মাজিদে নিকটাত্মীয়দের দাওয়াতের আদেশ তথা ‘আপনি আপনার নিকটস্থ জ্ঞাতি-গোষ্ঠীকে সতর্ক করুন’ (সুরা শূরা : ২১৪) নাজিল হওয়ার পর নবীজি (সা.) সাফা পাহাড়ে উঠলেন। উচ্চ স্বরে বললেন, ‘ইয়া সাবাহাহ!’ অর্থাৎ বিপদ! বিপদ! কোরাইশের লোকেরা পাহাড়ের সামনে উপস্থিত হলো। তিনি তাদের লক্ষ্য করে বললেন, ‘আমি যদি তোমাদের বলি যে, একটি শত্রুদল এ পাহাড়ের ওপার থেকে তোমাদের ওপর আক্রমণ করবে, তোমরা কি আমার কথা বিশ্বাস করবে?’ সবাই সমস্বরে বলল, ‘আমরা আপনাকে কখনও মিথ্যা বলতে দেখিনি।’ তখন তিনি বললেন, ‘আমি তোমাদের জন্য এক কঠিন আজাবের সতর্ককারী।’ (বোখারি : ৪৯৭১)। বলাবাহুল্য, একজন মানুষ হঠাৎ করে সবার মাঝে বরিত ও গ্রহণযোগ্য হয় না। যাপিত জীবনের দীর্ঘ সময়ে তার আচার-ব্যবহারে যখন সততা, বিশ্বস্ততা, পূর্ণ বিভায় ফুটে ওঠে, তখনই সবাই তাকে সাদরে গ্রহণ করে নেয়। আরবের কোরাইশের মাঝে নবীজি (সা.)-এর দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়েছে। তার শৈশব-কৈশোর-যৌবন সবই ছিল তাদের সামনে। তারা জীবনের বাঁকে বাঁকে নবীজি (সা.)-কে নিষ্ঠা ও সততার কষ্টিপাথরে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে যাচাই করেছে। কিন্তু তার মাঝে কখনও অসত্য, কপটতা, ছলনার আভাস পরিলক্ষিত হয়নি।
সত্যবাদিতায় মেলে জান্নাত
সিদক বা সত্যবাদিতা মহান আল্লাহর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুণ। তিনিই সবচেয়ে বড় সত্যবাদী। কোরআন মাজিদে তাঁর দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা, ‘যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, আমি তাদেরকে এমন সব বাগানে প্রবিষ্ট করাব, যার তলদেশে নহর প্রবাহিত থাকবে। তারা তাতে সর্বদা থাকবে। এটা আল্লাহর ওয়াদা, যা সত্য। আর কথায় আল্লাহ অপেক্ষা বেশি সত্যবাদী কে হতে পারে?’ (সুরা নিসা : ১২২)। তাই যারা এ মহাগুণে গুণান্বিত হতে পারে, তিনি তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান এবং ইহ-পরকালে নানা পুরস্কারে ভূষিত করেন। সত্যবাদিতা একদিকে যেমন মানুষের ইহকালীন জীবনে সুখ, সমৃদ্ধি ও সফলতা বয়ে আনে, তেমনি পরকালে আকাশের ওপারে অনিন্দ্য সুন্দর জান্নাতেরও নিশ্চয়তা দান করে। পবিত্র কোরআনের হৃদয়স্পর্শী বাণী, ‘এ হচ্ছে সেই দিন, যেদিন সত্যবাদীরা তাদের সত্যবাদিতার জন্য কল্যাণ লাভ করবে। তাদের জন্য রয়েছে এমন জান্নাত, যার তলদেশ থেকে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত। তাতে তারা সর্বদা থাকবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। এটাই মহাসাফল্য।’ (সুরা মায়িদা : ১১৯)। সত্যের ক্ষয় নেই। এটি সর্বদা মানুষকে সুপথে পরিচালিত করে, কল্যাণের পথ দেখায়, নাজাতের সন্ধান দেয়। সত্যবাদিতা শুধু দুনিয়াতে নয়, আখেরাতেও মহাপুরস্কার এনে দেবে। জাহান্নামের লেলিহান শিখা থেকে পরিত্রাণ দেবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যদি আল্লাহর সঙ্গে কৃত ওয়াদা তারা সত্যে পরিণত করত, তবে তা তাদের জন্য কল্যাণকর হতো।’ (সুরা মুহাম্মদ : ২১)।
সন্দেহ নেই, সত্য হৃদয়ের শান্তি ও স্বস্তি এনে দেয়। দূর করে দেয় দ্বিধা-সংশয় ও অস্বস্তি। আবুল হাওরা আস সাদি (রহ.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, হাসান ইবনে আলী (রা.)-কে আমি প্রশ্ন করলাম, আপনি রাসুল (সা.) থেকে কোন কথাটি মনে রেখেছেন? তিনি বললেন, আমি রাসুল (সা.)-এর এ কথাটি মনে রেখেছি, ‘যে বিষয়ে তোমার সন্দেহ হয়, তা ছেড়ে দিয়ে তা-ই গ্রহণ কর, যাতে সন্দেহের সম্ভাবনা নেই। যেহেতু সত্য হলো শান্তি ও স্বস্তি এবং মিথ্যা হলো দ্বিধা-সন্দেহ।’ (তিরমিজি : ২৫১৮)।
সত্যবাদিতা পুণ্যের পথ দেখায়
সততা এমন এক গুণ, যা মানুষকে মানবীয় সব গুণাবলি অর্জনের প্রতি উৎসাহিত করে। এটি কর্তব্যপরায়ণতা, ন্যায়-নিষ্ঠা, আমানতদারী, সাহসিকতা, একনিষ্ঠতা, দয়াশীলতা, স্নেহপরায়ণতা, সত্য প্রকাশে নির্ভীকতা, ন্যায়ের ওপর অবিচলতা, প্রতিশ্রুতি রক্ষা ইত্যাদি গুণাবলি অর্জনে অত্যন্ত সহায়ক। আবদুল্লাহ (রা.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে নবীজি (সা.) বলেন, ‘সত্য নেকির দিকে পরিচালিত করে, আর নেকি জান্নাতে পৌঁছায়। মানুষ সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থেকে অবশেষে সিদ্দিক তথা মহাসত্যবাদীর মর্যাদা লাভ করে। আর মিথ্যা মানুষকে পাপের দিকে নিয়ে যায়। পাপ তাকে জাহান্নামে নিয়ে যায়। আর মানুষ মিথ্যা বলতে বলতে অবশেষে আল্লাহর কাছে মহামিথ্যাচারী প্রতিপন্ন হয়ে যায়।’ (বোখারি : ৬০৯৪)। সত্যবাদিতার দ্বারা যেমন চারিত্রিক অবক্ষয় প্রতিরোধ করা যায়, তেমনি নৈতিক উৎকর্ষও সাধিত হয়। ফলে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আইন লঙ্ঘনের প্রবণতাও হ্রাস পায়। কেননা, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ এসব অনৈতিক কাজ ও আচরণ ঢাকার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে থাকে।
সুশৃঙ্খল জীবনযাপনে চাই সত্যবাদিতা
নিঃসন্দেহে আমরা জীবনকে ফলে ফুলে সুশোভিত করতে চাই। আলোকিত করতে চাই কর্মের দীপ্তি আর সফলতার স্নিগ্ধ আভায়। নীতি-নৈতিকতা ও সমাজ-সভ্যতার কল্পনার তুলিতে আঁকি স্বপ্নের প্রাসাদ। কিন্তু দুষ্কৃতি, কুসংস্কার ও দুষ্টু স্বভাবে আমাদের সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। যাপিত জীবন হয়ে যায় বিশৃঙ্খল, এলোমেলো অগোছালো। এ অগোছালো জীবনে শৃঙ্খলার মালা পরাতে চাইলে সত্যকে আঁকড়ে ধরতে হবে। সততা, বিশ্বস্ততা ও সত্যবাদিতার ভূষণে ভূষিত হতে হবে। তবেই আমাদের জীবন হয়ে উঠবে ঈর্ষায়-ঈর্ষায় ছাওয়া। বস্তুত সত্যবাদিতা মোমিন হৃদয়ে ছড়িয়ে দেয় পবিত্রতার মধুময় আবেশ। মুখরিত করে তোলে পরিবেশ। জীবন-কাননে ফোটায় আলোর ফুল। শুধরে দেয় মানুষের অনাকাঙ্ক্ষিত ভুল। পবিত্র কোরআনের বর্ণনা কত উদ্দীপক! মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মোমিনরা! আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্য সঠিক কথা বল; তাহলে আল্লাহ তোমাদের কার্যাবলি শুধরে দেবেন এবং তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করে, সে মহাসাফল্য অর্জন করল।’ (সুরা আহজাব : ৭০-৭১)। তাই তো বলা হয়, ‘সৎসঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।’
সত্যবাদী হওয়ার উপায়
মনে রাখতে হবে, সত্য সব সময় মানুষকে কল্যাণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে, আর মিথ্যা অন্যায়ের দিকে ধাবিত করে। তাই তো আল্লাহতায়ালা তাকওয়া অর্জনের জন্য সত্যবাদীদের সাহচর্যে থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘হে মোমিনরা! আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাক।’ (সুরা তওবা : ১১৯)। এটিই এ গুণ অর্জনের অনন্য উপায়। সত্যবাদীদের সান্নিধ্য, সত্য মুখরিত পরিবেশে বসবাস, আমৃত্যু মিথ্যা বর্জনের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, সর্বোপরি মহান রবের সাহায্য প্রার্থনার মাধ্যমে সত্যবাদিতার কাঙ্ক্ষিত ভূষণে ভূষিত হওয়া সম্ভব। সেই সঙ্গে মানব-বাগানের সুরভিত ফুল কোমলমতি শিশুদের শৈশব থেকেই সত্য ও সত্যবাদিতার শিক্ষা দিতে হবে। তাদের হৃদয়-কাননে রোপণ করতে হবে সত্যবাদিতার ফুলেল বীজ। পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আচরণে ও উচ্চারণে প্রাকটিক্যালি তাদের এর প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সত্যের মহিমা, ফজিলত, গুরুত্ব ও উপকারিতা কোমল ভাষায় তাদের বোঝাতে হবে। তবেই তারা বড় হয়ে জাতির কল্যাণে নিয়োজিত থাকবে। শান্তি প্রতিষ্ঠায় যথার্থ অবদান রাখতে সক্ষম হবে। সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে বিশ্বজয়েও সক্ষম হবে।
লেখক : সিনিয়র মুফতি, জামিয়া ইসলামিয়া হেমায়াতুল ইসলাম, কৈয়গ্রাম, পটিয়া, চট্টগ্রাম