পার্থিব জীবনে বিভিন্নজনের সঙ্গে চলাফেরা ও ওঠাবসা করে থাকি। যদি এমন কোনো ব্যক্তি পাই, যিনি আমাদের সঙ্গে আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহার করেন, তাহলে তার আচরণে মুগ্ধ হই। তাকে ভালোবাসি ও তার সঙ্গে হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে তুলি। ঠিক তেমনি কোনো বান্দা যখন আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য ইখলাসের সঙ্গে কোনো আমল করে, তখন আল্লাহতায়ালাও মুগ্ধ হন। মহান আল্লাহ এই ব্যক্তিকে ভালোবাসেন ও তার আমল গ্রহণ করে নেন। পক্ষান্তরে যদি কোনো ব্যক্তি লোক দেখানোর জন্য কিংবা পার্থিব স্বার্থ অর্জন করার উদ্দেশে আমল করে, তাহলে তা আল্লাহতায়ালার দরবারে গৃহীত হয় না। বান্দা যত আমল করে, সব আমলের প্রতিদান নিয়তের ওপর নির্ভরশীল। বান্দার আমল নির্ভেজালভাবে আল্লাহর জন্য হলে আল্লাহর কাছ থেকে সওয়াব পাওয়া যাবে। অন্যথায় আমলের সওয়াব ও প্রতিদান থেকে বঞ্চিত হতে হবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক আমলের প্রতিদান নিয়তের ওপর নির্ভরশীল।’ (মুসলিম : ৪৮২১)।
একনিষ্ঠভাবে ইবাদতের নির্দেশ
বান্দা হিসেবে আল্লাহতায়ালা আমাদের ওপর বিভিন্ন বিধি-নিষেধ আরোপ করেছেন। বহু ইবাদত আমাদের ওপর বাধ্যতামূলক করেছেন। মহান আল্লাহ যেসব ইবাদত আমাদের ওপর অবধারিত করেছেন, সেগুলো একনিষ্ঠভাবে তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্য আদায় করতে হবে। ফরজ বা নফল ইবাদত আদায় করার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের লৌকিকতা অবলম্বন করা যাবে না। মহাগ্রন্থ কোরআনে কারিমে আল্লাহতায়ালা তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য ইবাদত করার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘তাদেরকে এ ছাড়া কোনো নির্দেশ করা হয়নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে, নামাজ কায়েম করবে এবং জাকাত প্রদান করবে। এটাই সঠিক ধর্ম।’ (সুরা বায়্যিনাহ : ৫)।
অন্তরের প্রতি আল্লাহর দৃষ্টি
আমরা আল্লাহর মুখাপেক্ষী। আল্লাহ কোনো বান্দার মুখাপেক্ষী নন। সমগ্র পৃথিবীর প্রতিটি ব্যক্তিও যদি আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগিতে লেগে যায়, তাহলে তাঁর কোনো লাভ হবে না। অনুরূপ সবাই যদি তাঁর নাফরমানি করতে শুরু করে, তাহলেও তাঁর কোনো ক্ষতি হবে না। আল্লাহতায়ালা শুধু মানুষের অন্তরের অবস্থা দেখেন যে, ইবাদত-বন্দেগি করার মাধ্যমে কে তাঁকে সন্তুষ্ট করতে চায়। মহান আল্লাহ কোরবানির বিধানের আলোচনায় মানুষের অন্তরের অবস্থা দেখেন মর্মে বলেন, ‘এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু পৌঁছে তার কাছে তোমাদের মনের তাকওয়া।’ (সুরা হজ : ৩৭)। মানুষের মধ্যে কে সুন্দর, কে অসুন্দর এবং কার ধন-সম্পদ বেশি, কার ধন-সম্পদ কম, সেদিকে মহান আল্লাহ লক্ষ্য করেন না; বরং তিনি লক্ষ্য করেন মানুষের অন্তরের প্রতি। রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের বাহ্যিক চাল-চলন ও বিত্ত-বৈভবের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন না; বরং তিনি দেখেন তোমাদের অন্তর ও আমল।’ (মুসলিম : ৬৪৩৭)।
প্রতিদান পাবে একনিষ্ঠ যোদ্ধা
যদি কখনও মুসলমান ও কাফেরদের মধ্যে ধর্মযুদ্ধ সংঘটিত হয়, তাহলে মুসলমানদের জন্য সমীচীন হলো, শুধু আল্লাহতায়ালার দ্বীনকে সমুন্নত করার জন্য জিহাদ, সংগ্রাম ও লড়াই করা। যদি কোনো মুসলমান সৈনিক গনিমত লাভ করার জন্য কিংবা প্রসিদ্ধি অর্জন করার উদ্দেশে অথবা বীরত্ব দেখানোর জন্য জিহাদে অংশগ্রহণ করে, তাহলে আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে সে কোনো প্রতিদান পাবে না। আবু মুসা (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর কাছে এসে বলল, একজন গনিমতের জন্য, একজন প্রসিদ্ধির জন্য এবং একজন বীরত্ব দেখানোর জন্য জিহাদে শরিক হলো। তাদের মধ্যে কে আল্লাহর পথে জিহাদ করল? তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর কালেমা বুলন্দ থাকার উদ্দেশে যুদ্ধ করল, সে-ই আল্লাহর পথে জিহাদ করল।’ (বোখারি : ২৮১০)। যদি কোনো ব্যক্তি জিহাদ করার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধলব্ধ সম্পদও অর্জন করতে চায়, তাহলে তাকে কোনো নেকি দেয়া হবে না। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! একজন আল্লাহর পথে জিহাদের ইচ্ছে করেছে এবং সে এর দ্বারা পার্থিব সম্পদও অর্জন করতে চায়, (এ ব্যক্তির কি হবে)? মহানবী (সা.) বললেন, ‘সে কোনো নেকি পাবে না।’ লোকেরা এতে অবাক হলো। তারা তাকে বলল, তুমি আবার রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করে দেখ। হয়তো তুমি তাকে বুঝিয়ে বলতে পারোনি। সে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর পথে জিহাদের ইচ্ছে করেছে এবং সে এর দ্বারা পার্থিব সম্পদও অর্জন করতে চায়। তিনি বললেন, ‘সে কোনো নেকি পাবে না। লোকেরা বলল, তুমি বিষয়টি আবারও রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস কর। লোকটি তৃতীয়বার তাকে জিজ্ঞেস করল। তিনি বললেন, ‘সে কোনো নেকি পাবে না।’ (সুনানে আবি দাউদ : ২৫১৬)।
হত্যার চেষ্টাকারী জাহান্নামি
কোনো মুসলমানের জন্য সমীচীন নয় অপর কোনো মুসলমানকে হত্যা করা। যদি কোনো মুসলমান অপর কোনো মুসলমানকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করে, তাহলে সে চিরকাল জাহান্নামে থাকবে। কোনো মুসলমান অপর কোনো মুসলমানকে হত্যা করলে হত্যাকারী ব্যক্তি জাহান্নামে যাওয়ার বিষয়টি যুক্তিসম্মত। কিন্তু একটি হাদিসে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি নিহত হয়েছে, সেও জাহান্নামে যাবে। এক ব্যক্তি মহানবী (সা.)-কে জিজ্ঞেস করল, নিহত ব্যক্তি জাহান্নামে যাবে কেন? নবীজি (সা.) বললেন, ‘কারণ সে তার প্রাণ সংহারকারীকে হত্যা করার নিয়ত করেছিল।’ (সুনানে নাসায়ি : ৪১২০)।
লোক দেখানোর পরিণাম
আল্লাহতায়ালা আমাদের ওপর যত আমলের নির্দেশ দিয়েছেন, তা শুধু তাঁরই সন্তুষ্টির জন্য সম্পাদন করতে হবে। মানুষকে দেখানোর জন্য কোনো আমল করা যাবে না। যদি কোনো ব্যক্তি ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করে, তাহলে সেই জ্ঞানকে বিলিয়ে দিতে হবে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশে। সুনামণ্ডসুখ্যাতি অর্জন করা কিংবা লোকদের সঙ্গে গর্ব করার জন্য ইলম অর্জন করা যাবে না। কোনো ব্যক্তি যদি সম্পদশালী হয় এবং ধর্মীয় বিভিন্ন খাতে দান করে, তাহলে তাকে এ দান করতে হবে মহান আল্লাহকে রাজি করার জন্য। লোকে আমাকে ‘দানবীর’ বলুক এই কামনায় দান করা যাবে না। যদি এসব আমল নিরেট আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য সম্পাদন করা না হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি জাহান্নামের ইন্ধন হবে। এমন ব্যক্তিকে উপুড় করে হেঁচড়ে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে। সুলাইমান ইবনে ইয়াসার (রহ.) বলেন, একবার লোকজন আবু হুরায়রা (রা.)-এর কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছিল, তখন সিরিয়ার অধিবাসী নাতিল (রহ.) বললেন, হে শায়খ! আপনি রাসুল (সা.)-এর কাছ থেকে শুনেছেন এমন একখানা হাদিস আমাদের শোনান। তিনি বললেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম একজন শহীদের বিচার হবে। তাকে উপস্থিত করা হবে। আল্লাহ তাঁর নেয়ামতরাশির কথা তাকে বলবেন। সে তার সবটাই চিনতে পারবে। যথারীতি স্বীকারোক্তিও দেবে। তখন আল্লাহ বলবেন, ‘এর বিনিময়ে? কী আমল করেছিলে?’ সে বলবে, আমি তোমারই পথে যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত শহীদ হয়েছি। আল্লাহ বলবেন, ‘তুমি মিথ্যা বলছ; বরং এ জন্যই যুদ্ধ করেছিলে, যাতে লোকে তোমাকে বীর বলে। তা বলা হয়েছে।’ এরপর নির্দেশ দেয়া হবে। সে মতে তাকে উপুড় করে হেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এর পর এমন এক লোকের বিচার হবে, যে জ্ঞান অর্জন ও বিতরণ করেছে এবং কোরআনে কারিম অধ্যয়ন করেছে। তাকে হাজির করা হবে। আল্লাহ তাকে দেয়া নেয়ামতের কথা বলবেন। সে তা চিনতে পারবে। যথারীতি স্বীকারও করবে। তখন আল্লাহ বলবেন, ‘এত বড় নেয়ামত পেয়ে বিনিময়ে তুমি কী করলে?’ জবাবে সে বলবে, আমি জ্ঞান অর্জন করে তা অন্যদের শিখিয়েছি। তোমারই সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশে কোরআন অধ্যয়ন করেছি। জবাবে আল্লাহ বলবেন, ‘তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি এ জন্য জ্ঞান অর্জন করেছিলে, যাতে লোকে তোমাকে জ্ঞানী বলে। কোরআন তেলাওয়াত করেছিলে এ জন্য, যাতে লোকে তোমাকে কারি বলে। তা বলা হয়েছে।’ এর পর নির্দেশ দেয়া হবে। সে মতে তাকেও উপুড় করে হেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হবে। জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। তারপর এমন এক ব্যক্তির বিচার হবে, যাকে আল্লাহতায়ালা সচ্ছলতা এবং সর্ববিধ বিত্ত-বৈভব দান করেছিলেন। তাকে উপস্থিত করা হবে এবং প্রদত্ত নেয়ামতগুলোর কথা বলা হবে। সে তা চিনতে পারবে। স্বীকারোক্তিও দেবে। তখন আল্লাহ বলবেন, ‘এসব নেয়ামতের বিনিময়ে তুমি কী আমল করেছ?’ জবাবে সে বলবে, সম্পদ ব্যয়ের এমন কোনো খাত নেই, যাতে সম্পদ ব্যয় করা তুমি পছন্দ কর, আমি সে খাতে তোমার সন্তুষ্টির জন্য ব্যয় করেছি। তখন মহান আল্লাহ বলবেন, ‘তুমি মিথ্যা বলছ। বরং এ জন্য দান করেছিলে, যেন লোকে তোমাকে দানবীর বলে। তা বলা হয়েছে।’ তারপর নির্দেশ দেয়া হবে। সে মতে তাকেও উপুড় করে হেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হবে এবং জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (মুসলিম : ৪৮১৭)।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা