ইসলামের সর্বোত্তম আমল হজ
ইলিয়াস মশহুদ
প্রকাশ : ২৬ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
হজ আরবি শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ হলো- সংকল্প করা, ইচ্ছা করা, সফর করা। পরিভাষায়- হজের নিয়তসহ ইহরাম ধারণ করে নির্দিষ্ট দিনে আরাফার ময়দানে অবস্থান করা ও কাবা শরিফ তওয়াফ করাকে হজ বলে। (ফতোয়ায়ে শামি : ২/৪৫৪)। হজের নির্দিষ্ট সময় হলো আশহুরুল হুরুম তথা শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজের প্রথম ১০ দিন; বিশেষত জিলহজের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত পাঁচ দিন। এই পাঁচ দিনই মূলত হজ পালন করা হয়। হজের নির্ধারিত স্থান হলো পবিত্র কাবা, সাফা-মারওয়া, মিনা, আরাফা ও মুজদালিফা। দূরের হাজিদের জন্য মদিনা মুনাওয়ারায় রাসুল (সা.)-এর রওজা জেয়ারত করা ওয়াজিব। আর হজের কার্যাবলির মধ্যে রয়েছে ইহরাম, তালবিয়া, তওয়াফ ও সাঈ, উকুফে আরাফা, উকুফে মুজদালিফা, উকুফে মিনা, কংকর নিক্ষেপ, দম ও কোরবানি, হলক ও কসর এবং জেয়ারতে মদিনা, রওজাতুল রাসুল (সা.) ইত্যাদি।
হজের বিধান
হজ ইসলামি শরিয়তের অন্যতম স্তম্ভ ও রোকন। আর্থিক ও দৈহিকভাবে সামর্থ্যবান নারী-পুরুষের ওপর জীবনে একবার হজ করা ফরজ। মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো হজ। কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘প্রত্যেক সামর্থ্যবান মানুষের ওপর আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বাইতুল্লাহর হজ করা ফরজ।’ (সুরা আলে ইমরান : ৯৭)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘লোকসকল! আল্লাহতায়ালা তোমাদের ওপর হজ ফরজ করেছেন।’ আকরা ইবনে হাবিস (রা.) দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এটা কি প্রত্যেক বছর ফরজ?’ উত্তরে রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমি যদি হ্যাঁ বলতাম, তবে ফরজ হয়ে যেত। আর প্রতি বছর হজ ফরজ হলে তা তোমরা সম্পাদন করতে সক্ষম হতে না। এ জন্য হজ জীবনে একবারই ফরজ। কেউ যদি একাধিকবার করে, তবে তা হবে নফল হজ।’ (বোখারি : ৭২৮৮)। এ ছাড়া হাদিসে হজের অসংখ্য সওয়াব ও ফজিলত বর্ণিত হয়েছে।
হজের ধরন
হজ তিন ধরনের- হজ্জে ইফরাদ, হজ্জে তামাত্তু, হজ্জে কিরান।
১. হজ্জে ইফরাদ : শুধু হজের নিয়তে ইহরাম ধারণ করে ওই ইহরামেই হজের সব আমল সম্পন্ন করাকে হজ্জে ইফরাদ বলে।
২. হজ্জে তামাত্তু : শুধু ওমরাহর নিয়তে ইহরাম ধারণ করে ওমরাহর কাজ সমাপ্ত করা, এরপর মাথা মু-িয়ে ইহরাম থেকে মুক্ত হওয়া, অতঃপর ওই সফরেই হজের নিয়তে ইহরাম বেঁধে হজের সব আমল সম্পাদন করাকে তামাত্তু হজ বলে।
৩. হজ্জে কিরান : একসঙ্গে ওমরাহ ও হজের নিয়তে ইহরাম ধারণ করে ওই (একই) ইহরামেই ওমরাহ ও হজ পালন করাকে কিরান হজ বলে।
এ তিন ধরনের হজের মধ্যে সওয়াবের দিক দিয়ে সর্বাধিক উত্তম হলো কিরান, এরপর তামাত্তু, এরপর ইফরাদ। তবে আদায়ের ক্ষেত্রে সহজতার বিবেচনায় প্রথমে তামাত্তু, এরপর ইফরাদ, এরপর কিরান হজ উত্তম। যেহেতু হজ্জে তামাত্তু পালন করা সবচেয়ে সহজ, তাই অধিকাংশ বাংলাদেশি তামাত্তু হজ আদায় করে থাকেন। আর যারা অন্যের বদলি হজ করতে যান বা যাদের অবস্থান মিকাতের মধ্যে, তারা সাধারণত ইফরাদ হজ করেন। এ ছাড়া কিছুসংখ্যক হাজি কিরান হজ করেন, তবে এদের সংখ্যা খুব কম। (ফতোয়ায়ে শামি : ২/৫২৯)।
যাদের ওপর হজ ফরজ
পাঁচটি শর্তসাপেক্ষে হজ ফরজ- ১. মুসলমান হওয়া, ২. আকল থাকা বা বিবেকবান হওয়া অর্থাৎ পাগল না হওয়া, ৩. বালেগ বা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া, ৪. স্বাধীন হওয়া, অর্থাৎ কারও গোলাম না হওয়া এবং ৫. দৈহিক ও আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান হওয়া। তবে নারীদের ক্ষেত্রে আরেকটি শর্ত যুক্ত হবে, সেটি হলো- সঙ্গে ‘মাহরাম’ (যেসব পুরুষের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ বৈধ) থাকা। স্মরণ রাখতে হবে, জাকাত ফরজ না হয়েও কারও ওপর হজ ফরজ হতে পারে। কেননা, হজ ও জাকাতের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। যেমন- জাকাতের সম্পর্ক নির্ধারিত নেসাবের সঙ্গে। হজের সম্পর্ক মক্কায় আসা-যাওয়ার খরচের সঙ্গে। সুতরাং স্থাবর সম্পত্তির কিছু অংশ বিক্রি করে কেউ যদি হজ আদায় করতে সক্ষম হয় এবং হজ থেকে ফিরে এসে বাকি সম্পত্তি দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে, তাহলে তার ওপর হজ ফরজ। (আহসানুল ফাতাওয়া : ৪/৫১৬)। একইভাবে ব্যবসায়ীর দোকানে যে পরিমাণ পণ্য আছে, তার কিছু অংশ বিক্রি করলে যদি হজ করা সম্ভব হয় এবং ফিরে এসে যদি বাকি পণ্য দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা যায়, তাহলে তার ওপরও হজ ফরজ। (ইমদাদুল আহকাম : ২/১৫৩)।
আমাদের সমাজে একটি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে, তা হলো- আগে মাতাপিতার হজ করাবে, পরে নিজের কথা চিন্তা করবে; এটি সঠিক নয়, বরং সামর্থ্য থাকলে তাদের নিয়ে একসঙ্গে হজ করবে। অন্যথায় আগে নিজের ফরজ আদায় করবে। (ফতোয়ায়ে রহিমিয়া : ৮/২৮২)। আবার অনেকে মনে করেন, সন্তানের বিয়ে দেয়ার পর হজ আদায় করতে হয়। অথচ এ কথা ইসলাম সমর্থিত নয়। ইসলামের দৃষ্টিতে সন্তানের বিয়ের জন্য হজে বিলম্ব করা যাবে না। (ফতোয়ায়ে রহিমিয়া : ৮/২৭৬)। যাদের ওপর হজ ফরজ, যত দ্রুত সম্ভব হজ আদায় করা উত্তম। যেখানে মানুষের জীবন-মরণের এক সেকেন্ডের নিশ্চয়তা নেই, সেখানে এক বছর অনেক দীর্ঘ সময়। তাই রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি হজ করার ইচ্ছে করেছে, সে যেন তাড়াতাড়ি তা করে নেয়।’ (সুনানে আবি দাউদ : ১৭৩২)।
হজ ইসলামের শ্রেষ্ঠ আমল
যে কাজে কষ্ট বেশি, তার সওয়াব ও ফজিলত তত বেশি। তাই রাসুল (সা.)-এর প্রতি ঈমান আনার পর জিহাদ ও হজকে সর্বোত্তম আমল বলা হয়েছে। একবার রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘সর্বোত্তম আমল কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি ঈমান আনা।’ প্রশ্ন করা হলো, ‘তারপর কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা।’ আবার প্রশ্ন করা হলো, ‘এরপর কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘হজ্জে মাবরুর তথা মকবুল হজ।’ (বোখারি : ১৫১৯)।
নিষ্পাপ হওয়ার মাধ্যম হজ
রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে হজ করল এবং এ সময় অশ্লীলতা ও গোনাহের কাজ থেকে বিরত থাকল, সে যেন নবজাতক শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরল।’ (বোখারি : ১৫২১)।
হজের বিনিময় জান্নাত
আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘এক ওমরাহ থেকে আরেক ওমরাহ পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময়ের গোনাহের ক্ষতিপূরণ হয়ে যায়। আর হজ্জে মাবরুরের প্রতিদান তো জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়।’ (বোখারি : ১৭৭৩, মুসলিম : ১৩৪৯)।
হজ না করার পরিণাম
সামর্থ্য থাকার পরও হজ না করার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। ফরজ হজ ত্যাগ করলে ইহুদি-নাসারার মতো মৃত্যু হবে বলে হাদিসে সতর্ক করা হয়েছে। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি হজ করার সামর্থ্য রাখে, তবু হজ করে না, সে ইহুদি না খ্রিষ্টান হয়ে মৃত্যুবরণ করল, তার কোনো পরোয়া আল্লাহর নেই।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির : ১/৫৭৮)। আর কেউ যদি হজ অস্বীকার করে বা কোনো ধরনের অবহেলা প্রদর্শন করে, তবে সে আল্লাহর জিম্মার বাইরে বলে বিবেচিত হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মানুষের মধ্যে যারা সেখানে (বাইতুল্লাহ) পৌঁছার সামর্থ্য রাখে, তাদের ওপর আল্লাহর উদ্দেশে সেই ঘরের হজ করা ফরজ। আর কেউ যদি অস্বীকার করে, তাহলে জেনে রাখা উচিত, আল্লাহতায়ালা সৃষ্টিজগতের প্রতি মুখাপেক্ষী নন।’ (সুরা আলে ইমরান : ৯৭)। এ ছাড়া হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ হজ না করার পরিণতি সম্পর্কে বলেছেন, ‘যে বান্দাকে আমি দৈহিক সুস্থতা দিয়েছি এবং আর্থিক প্রাচুর্য দান করেছি, অতঃপর (গড়িমসি করে) তার পাঁচ বছর অতিবাহিত হয়ে যায়, অথচ আমার দিকে (হজব্রত পালন করতে) আগমন করে না, সে অবশ্যই বঞ্চিত।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান : ৩৭০৩)।