হজের ধর্মীয় ও সামাজিক গুরুত্ব
হজ একটি ফরজ ইবাদত। সামর্থ্যবান ব্যক্তিকে জীবনে একবার তা আদায় করতে হয়। ইসলামের পঞ্চ ভিত্তির মধ্যে এটি আদায়েই বেশি জটিলতা। প্রচুর অর্থ ব্যয়ের সঙ্গে শারীরিক কষ্টও রয়েছে অনেক। থাকা-খাওয়ার সমস্যা, সফরের ক্লান্তি, নির্ঘুম ও শীত-গরমের তীব্রতা সহ্য করে খালি মাথায় খালি পায়ে সেলাইহীন কাপড় পরে কাবার তওয়াফ, সাফা-মারওয়ার সায়ি, মিনায় কঙ্কর নিক্ষেপ, মুজদালিফায় খোলা আকাশের নিচে শুয়ে রাত কাটানো, কোরবানি করা ও মাথা মুণ্ডানোসহ নানা কাজের মধ্য দিয়ে একজন হজ আদায়কারী হজের বিধানগুলো পালন করেন। নামাজ, রোজা ও জাকাতের মতো শারীরিক এবং আর্থিক ইবাদত থাকতে হজের এত গুরুত্ব কেন? এর উত্তর আল্লাহতায়ালা নিজেই কোরআনে দিয়েছেন, ‘হে ইবরাহিম! মানুষের মাঝে হজের ঘোষণা দাও; যাতে তারা তাদের কল্যাণের জন্য সেখানে উপস্থিত হতে পারে।’ (সুরা হজ : ২৭-২৮)। সব তাফসির গ্রন্থে ‘কল্যাণ’ বলতে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণের কথা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সুতরাং ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে হজের যে গুরুত্ব রয়েছে, তা এ আয়াতে স্পষ্ট। এ বিষয়ে লিখেছেন- আবদুল আউওয়াল
প্রকাশ : ২৬ মে ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
হজের ধর্মীয় গুরুত্ব
১. আল্লাহর নির্দেশ পালন : মানুষ ও জিনকে আল্লাহতায়ালা সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য। ইবাদতের মূলকথা হলো আল্লাহর নির্দেশ পালন করা। সেটা হতে পারে করণীয় কিংবা বর্জনীয়। হজের ক্ষেত্রে আল্লাহতায়ালার নির্দেশ হলো, ‘তোমরা আল্লাহর জন্য হজ ও ওমরা পূর্ণ কর।’ (সুরা বাকারা : ১৯৬)। অন্যত্র এরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বাইতুল্লাহর হজ ওই ব্যক্তির ওপর ফরজ, যে সেখানে আসার সামর্থ্য রাখে।’ (সুরা আলে ইমরান : ৯৭)। হাদিসে এসেছে, ‘জীবনে একবার হজ পালন করা ফরজ।’ (সুনানে আবি দাউদ : ১৭২১)।
২. আল্লাহর সান্নিধ্য ও সন্তুষ্টি অর্জন : আল্লাহতায়ালা সব সময় বান্দার কাছেই থাকেন। এরপরও কাবা যেহেতু তাঁর ঘর, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম জায়গা এবং সেখানকার ভূমি যেহেতু বরকতময়, নিরাপদ, সঙ্গে রয়েছে নবী-রাসুলদের স্মৃতিবিজড়িত অনেক স্থান ও স্থাপনা, তাই সেখানে কেউ প্রবেশ করলে সে বিশেষভাবে আল্লাহতায়ালার সান্নিধ্য, সন্তুষ্টি ও নিরাপত্তা লাভ করে। এরশাদ হয়েছে, ‘মানুষের ইবাদতের জন্য নির্মিত সর্বপ্রথম ঘর যা মক্কায় অবস্থিত, সেটি বিশ্ববাসীর জন্য পথপ্রদর্শক। সেখানে রয়েছে মাকামে ইবরাহিমের মতো অনেক প্রকৃষ্ট নিদর্শন। যে সেখানে প্রবেশ করবে, সে নিরাপত্তা লাভ করবে।’ (সুরা আলে ইমরান : ৯৬-৯৭)। হাদিসে এসেছে, ‘হজ ও ওমরাহ পালনকারীরা আল্লাহর মেহমান (বিশেষ মর্যাদা ও সান্নিধ্যপ্রাপ্ত)। তাই তারা আল্লাহর কাছে কিছু আবেদন করলে তিনি তা কবুল করেন। ক্ষমা চাইলে ক্ষমা করেন।’ (সুনানে ইবনে মাজা : ২৮৯৮)।
৩. পাপ মোচন ও পুণ্য অর্জন : হাদিসে এসেছে, ‘ হজ তার আগের সব পাপ ধ্বংস করে দেয়।’ (মুসলিম : ১২১)। অন্য হাদিসে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে হজ করে এবং সে হজের মধ্যে অশ্লীল কথাবার্তা বলে না ও অশ্লীল কাজও করে না, সে ব্যক্তি হজ থেকে সেদিনের মতো ফিরবে (নিষ্পাপ অবস্থায়), যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল।’ (বোখারি : ১৫২১)। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি বাইতুল্লাহর সাতটি তাওয়াফ করবে, সে সময় প্রতিটি পদক্ষেপে আল্লাহ তার জন্য একটি করে নেকি লিখবেন এবং একটি গোনাহ মোচন করবেন ও এক গুণ মর্যাদা বাড়িয়ে দেবেন।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ : ২৫২৮)। এ ছাড়া হজের প্রত্যেকটি কাজের বিনিময়ে আলাদা আলাদা নেকি রয়েছে। নবীজি (সা.) বলেন, যখন তুমি বাইতুল হারামের তাওয়াফের উদ্দেশ্যে বের হও, তখন তোমার এবং তোমার উটের প্রতিটি পদক্ষেপের জন্য আল্লাহতায়ালা একটি করে নেকি লেখেন ও একটি করে গোনাহ মিটিয়ে দেন। তাওয়াফের পর তোমার দুই রাকাত নামাজ বনি ইসমাইল গোত্রের একটি গোলাম স্বাধীন করার সমতুল্য। সাফা-মারওয়ার সায়ি সত্তরটি গোলাম মুক্ত করার তুল্য। যেদিন সন্ধ্যায় তোমার অবস্থান আরাফায় হয়, সেদিন আল্লাহতায়ালা প্রথম আকাশে নেমে আসেন এবং ফেরেশতাদের সঙ্গে গর্ব করে বলতে থাকেন, ‘আমার বান্দারা দূর-দূরান্ত থেকে এলোমেলো হয়ে আমার কাছে এসেছে। তারা আমার রহমতের আশা করে। (সুতরাং হে আমার বান্দারা!) যদি তোমাদের গোনাহের পরিমাণ বালু কিংবা বৃষ্টির ফোঁটা অথবা সমুদ্রের ফেনা পরিমাণও হয়, তবু আমি তা ক্ষমা করে দেব। হে আমার বান্দারা! তোমরা কল্যাণের দিকে এসো, তোমাদের জন্য ক্ষমা রয়েছে। তাদের জন্যও ক্ষমা রয়েছে, যাদের জন্য তোমরা সুপারিশ করবে।’ আর তোমার নিক্ষিপ্ত প্রতিটি কঙ্কর ধ্বংসাত্মক আমলের জন্য কাফফারাস্বরূপ। তোমার কোরবানি আল্লাহর কাছে তোমার ভান্ডার। তোমার মাথা মুণ্ডানো প্রতিটি চুলের জন্য রয়েছে একটি নেকি ও একটি পাপের মোচন। আর বাইতুল্লাহর বিদায়ি তাওয়াফ তোমার গোনাহকে নিঃশেষ করে দেবে। ফেরেশতা এসে তোমার কাঁধে হাত রেখে বলবে, ‘ভবিষ্যতের জন্য আমল করতে থাক। কারণ, তোমার অতীতের সব গোনাহ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে।’ (সহিহ আত তারগিব : ১১১২)।
৪. জাহান্নাম থেকে মুক্তি ও জান্নাত প্রাপ্তি : হজের বিধান অস্বীকার করলে ঈমান থাকবে না। সে নিশ্চিত জাহান্নামি। আর সামর্থ্যবানরাও হজ না করলে জাহান্নামে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কেউ যদি হজের বিধান অস্বীকার করে, তার জানা উচিত, আল্লাহতায়ালা সৃষ্টিজগতের প্রতি মুখাপেক্ষী নন।’ (সুরা আলে ইমরান : ৯৭)। হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি বান্দার শরীর সুস্থ রাখলাম, তার জীবিকায় প্রশস্ততা দিলাম, এরপর পাঁচ বছর গেল, এর মধ্যে সে আমার ঘরে হজের উদ্দেশ্যে এলো না, তাহলে সে বড়ই হতভাগা!’ (তাবারানি : ৪৯০)। পক্ষান্তরে হজ আদায়কারীর ব্যাপারে নবীজি (সা.) সুসংবাদ দিয়ে বলেন, ‘কবুল হজের প্রতিদান হলো একমাত্র জান্নাত।’ (বোখারি : ১৭৭৩)।
হজের সামাজিক গুরুত্ব
একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি আদর্শের সমাজ গঠনের জন্য যে গুণগুলো এর সদস্যদের মধ্যে থাকা দরকার, সবগুলোর চর্চাই মোটামুটিভাবে হজের মধ্যে হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো-
১. ধৈর্য ও ত্যাগ : শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক- তিনটি বিষয়ের যৌথ প্রয়াসে পালিত হয় হজ। এ ক্ষেত্রে ধৈর্য ও ত্যাগের মানসিকতা না থাকলে শীত-গরমের তীব্রতা উপেক্ষা করে, মানুষের ভিড় ঠেলে একটি ইবাদত সম্পন্ন করা কখনও সম্ভব হতো না। তাওয়াফ, সায়ি, কঙ্কর নিক্ষেপসহ সব কাজই মোটামুটি কষ্টের। সুতরাং হজ থেকে মানুষ ধৈর্য ও ত্যাগের মতো মহৎ গুণাবলি শিক্ষা লাভ করে।
২. সাম্য ও সম্প্রীতি : হজ রাজা-প্রজা, ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু, আরব-অনারব, নারী-পুরুষ সবার মধ্যে একটি সাম্যভাব প্রতিষ্ঠা করে। সঙ্গে সঙ্গে হজ আদায়কারীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভালোবাসাবোধ জাগ্রত করে। সবার কাজ এক, পোশাক এক, ধ্বনি এক, লক্ষ্য এক। একই দেহ আর একই প্রাণের উৎসব যেন কাবার প্রান্তরে চলে। ইসলাম মুসলমানদের এ রূপটিই সব সময় কামনা করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় সব মোমিন ভাই ভাই।’ (সুরা হুজুরাত : ১০)। হজ যেন সে দৃশ্যটিই ফুটিয়ে তোলে। এ যেন প্রিয়নবী (সা.)-এর সেই বাণীর শোভন, ‘মোমিনরা একই প্রাচীরের ইটের মতো, যারা একে অপর থেকে শক্তি সঞ্চার করে।’ (বোখারি : ২৬৪৬)।
৩. একতা ও ঐক্য : একতা শক্তির মূল। বিচ্ছিন্নতা দুর্বলতার কারণ। তাই আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর, বিভক্ত হয়ো না।’ (সুরা আলে ইমরান : ১০৩)। হজ যেন সেই একতার দৃশ্যই ফুটিয়ে তোলে। এক ইমামের অনুসরণ করে মুসলমানরা বিশ্বকে জানিয়ে দেয়, আমরা এখনও ঐক্যবদ্ধ।
৪. বৈষম্যহীনতা ও সম্মান প্রদান : আদমের সন্তান হিসেবে মানুষ সবাই সমান। কারও ওপর কারও প্রাধান্য নেই। হজ মানুষের মাঝে বর্ণ ও শ্রেণি বৈষম্য দূর করে প্রত্যেককে সম্মান প্রদর্শনের শিক্ষা দেয়। যে গুণের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে নবীজি (সা.) বলেন, ‘জেনে রেখ, অনারবের ওপর আরব ও আরবের ওপর অনারব লোকের কোনো প্রাধান্য নেই। কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গ আর শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গ লোকের কোনো প্রাধান্য নেই। প্রাধান্য শুধু তাকওয়ার ভিত্তিতে হয়।’ (মুসনাদে আহমদ : ২৩৪৮৯)।