মদিনা শরিফের জুমার খুতবা
ঈমান ও আমল মুক্তির সোপান
শায়খ ড. আলী বিন আবদুর রহমান আল হুজাইফি
প্রকাশ : ০৯ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আল্লাহতায়ালা মানবজাতির ইহ-পরকালীন সৌভাগ্য ও সফলতা অর্জনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব সম্পর্কে সম্যক অবগত। মানুষ জ্ঞান-গরিমা, বুদ্ধি-বিবেক এবং যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতায় যতই উৎকর্ষ সাধন করুক, উভয়কালীন সৌভাগ্য অর্জনের মাধ্যম কী হতে পারে, তা কখনোই তাদের বিবেক দিয়ে জানা সম্ভব নয়। এ কারণে আল্লাহতায়ালা দুনিয়া ও আখেরাতের সৌভাগ্য অর্জনের উপকরণ নিজেই বাতলে দিয়েছেন। উভয় জগতের অকল্যাণ ও মন্দের উপকরণ বিষয়ে সতর্ক করেছেন। সৌভাগ্যের সোপান কী হবে, একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ ঐশীবাণী ছাড়া কারও পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তোমার প্রতি কিতাব ও হেকমত অবতীর্ণ করেছেন। আর তুমি যা জানতে না, তা তোমাকে শিখিয়েছেন। তোমার প্রতি আল্লাহর মহা-অনুগ্রহ রয়েছে।’ (সুরা নিসা : ১১৩)। তাই বুদ্ধিমত্তায়, বিদ্যা-বিভায় মানবজাতি যতই উৎকর্ষ সাধন করুক না কেন, সৌভাগ্য ও সফলতা অর্জনের উপকরণ পেতে হলে একমাত্র ঐশীবাণী ছাড়া বিকল্প কল্পনা করা অসম্ভব।
সফলতা ও সৌভাগ্য কীসে?
আল্লাহতায়ালা উভয় জাহানে মানবজাতির সফলতা ও কামিয়াবি হাসিলের উপকরণ ও মাধ্যম রেখেছেন দুটি কথায়- ১. আল্লাহর কালাম তথা ঐশীবাণীর প্রতি ঈমান আনয়ন, ২. আল্লাহর কালামের বিধিবিধান ও অনুসরণগুলো পুরোপুরি মেনে চলা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা উভয়ে একইসঙ্গে জান্নাত হতে নেমে যাও। তোমরা একে অপরের শত্রু। পরে আমার পক্ষ হতে তোমাদের কাছে সৎপথের নির্দেশ এলে যে আমার পথ অনুসরণ করবে, সে বিপথগামী হবে না ও দুঃখণ্ডকষ্ট পাবে না।’ (সুরা তহা : ১২৩)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার পথনির্দেশ মেনে চলবে, সে দুনিয়া ও আখেরাতে পথভ্রষ্ট ও লাঞ্ছিত হবে না।’
সফলতা ও সৌভাগ্যের প্রতিদান
মানবেতিহাস ও সব জাতির নবীদের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সৌভাগ্যশীল ও সফল ব্যক্তি এবং সমাজ সংস্কারক দুনিয়ার অপদস্থতা থেকে সংরক্ষিত। তারা আখেরাতের আজাব থেকে পরিত্রাণ পাবে। তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ মহান ব্যক্তি হলেন নবীরা ও তাদের অনুসারীরা। যারা আল্লাহর কালামের প্রতি ঈমান এনেছেন এবং তার অনুশাসন মেনে চলেছেন। সর্বপ্রথম আদম (আ.) তার ভুলের পর একমাত্র আল্লাহর বাণীর প্রতি ঈমান ও তাঁর অনুশাসন মেনে চলার কারণে আল্লাহর মনোনীত বান্দা হয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আদম নিজ পালনকর্তার কাছ থেকে কয়েকটি কথা শিখে নিল। অতঃপর আল্লাহ তার প্রতি (করুণাভরে) তাকালেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল ও অসীম দয়ালু।’ (সুরা বাকারা : ৩৭)। আদম (আ.)-এর পর আল্লাহতায়ালা পরবর্তী নবী-রাসুলদের তাঁর ওহির মাধ্যমে অনুগ্রহ করেছেন। একমাত্র আল্লাহর কালামের প্রতি ঈমান ও আমলের কারণে তাদের অনুসারীদের প্রশংসা করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এরাই তারা, নবীদের মধ্য থেকে যাদেরকে আল্লাহ নেয়ামত দান করেছেন। এরা আদমের বংশধর; যাদেরকে আমি নুহের সঙ্গে নৌকায় আরোহণ করিয়েছিলাম। তাদের বংশধর, ইবরাহিম ও ইসরাইলের বংশধর, যাদেরকে আমি পথপ্রদর্শন করেছি ও মনোনীত করেছি। এরা তাদের বংশোদ্ভূত, যাদের কাছে দয়াময় আল্লাহর আয়াতগুলো যখন পাঠ করা হতো, তখন তারা সেজদায় লুটিয়ে পড়ত এবং কান্না করত।’ (সুরা মারইয়াম : ৫৮)।
সফলতা ও মুক্তির সোপান
আল্লাহর ঐশীবাণীর প্রতি ঈমান আনয়নকারী ও অনুশাসন পালনকারী ব্যক্তিদের আল্লাহ গুণকীর্তন করেছেন। বিশেষ করে, সৃষ্টির সেরা মহামানব মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রশংসা করেছেন। তাই আল্লাহতায়ালার প্রতি ঈমান আনা ও সে অনুযায়ী আমল করাই সফলতা ও মুক্তির সোপান। আসমানি কিতাবগুলোর প্রতি ঈমান আনয়ন এবং ঈমানের অন্যান্য রোকনের প্রতি ঈমান আনয়ন ছাড়া আল্লাহতায়ালা কারও ইবাদত কবুল করেন না। এসব ছাড়া কেউই পরকালের শাস্তি থেকে রক্ষা পাবে না। আর এ ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করেছিলেন নবী-রাসুলরা ও তাদের খাঁটি অনুসারীরা। কোনো জনপদ, কোনো সংস্থা, কোনো দল আল্লাহর কালাম ও বিধান পালন ছাড়া পরিশুদ্ধ হতে পারে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যদি তারা তাওরাত, ইঞ্জিল এবং তাদের প্রতি তাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে যে কিতাব নাজিল করা হয়েছে, তার যথাযথ অনুসরণ করত, তবে তারা তাদের ওপর-নিচ ও সবদিক থেকে (আল্লাহর দেয়া রিজিক) খেতে পেত। যদিও তাদের মধ্যে একটি দল সরল পথের অনুসারী; কিন্তু তাদের অধিকাংশই এমন, যাদের কার্যকলাপ মন্দ।’ (সুরা মায়িদা : ৬৬)।
দ্বীন ইসলামের পূর্ণতা
ইসলাম ধর্মের পূর্ণতার বিশেষত্ব হলো, মানবজীবন সব প্রয়োজন নিষ্ঠার সঙ্গে পূর্ণ করে থাকে। কারও কাছে দ্বীনের অপূর্ণতা থাকলে সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার; দ্বীনের অপূর্ণতা নয়, বরং তার মেধা-বুদ্ধির স্বল্পতার বিষয়। ইসলাম উম্মতের সব জটিল ও কঠিন বিষয়ে সমাধান দিতে সক্ষম। কেননা, শরিয়তের বিধিবিধানের উৎস হলো কোরআনুল কারিম। যাতে কোনো পরিবর্তন নেই। যাতে কোনো মিথ্যা মিশ্রিত হওয়ার সুযোগ নেই। শরয়ি বিধান সর্বপ্রথম আল্লাহর কোরআন থেকে গ্রহণ করা হয়। সেখানে তা পাওয়া না গেলে সুন্নাহ থেকে গৃহীত হয়। অতঃপর উম্মাহর ঐক্যমত থেকে। উম্মাহর ঐক্যমত না পাওয়া গেলে কিয়াসের সহায়তায় সমাধান করা হয়। সাহাবায়ে কেরামও কিয়াস দ্বারা দ্বীনের কাজ সমাধা করেছেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) কিয়াস সম্পর্কে সুন্দর বর্ণনা করেছেন, ‘কিয়াস হলো, আল্লাহর পক্ষ থেকে তার বিশ্বস্ত বান্দাদের কোনো বিষয়ে জানিয়ে দেয়া; যে বিষয়ে এর আগে কোনো সমাধান দেয়া হয়নি।’ মোটকথা, ইসলামি শরিয়ত হলো, একটি পূর্ণাঙ্গ দ্বীন; যা মানুষের দুনিয়া ও আখেরাতের সব কল্যাণে জিম্মাদারি গ্রহণ করেছে। এ শরিয়তের মূলভিত্তি হলো কোরআন-সুন্নাহ। সুতরাং যারা কোরআন-সুন্নাহ আঁকড়ে ধরবে, তারা নাজাত ও মুক্তি পাবে। পক্ষান্তরে যারা এর থেকে দূরে থাকবে, তাদের ধ্বংস অনিবার্য।
সফলতা ও ব্যর্থতার মানদণ্ড
আল্লাহতায়ালা এ কোরআনের মাধ্যমে কাউকে সম্মানিত করেছেন, আবার কেউ তা পরিত্যাগ করার ফলে তাকে লাঞ্ছিত করেছেন। যেমনিভাবে আল্লাহতায়ালা ঈমানদারদের জন্য, কোরআনের বিধিবিধান পালনকারীর জন্য সফলতা ও কামিয়াবির ব্যবস্থা করেছেন, তদ্রƒপ কোরআন পরিত্যাগকারী ও বর্জনকারীর জন্য রেখেছেন দুনিয়া ও আখেরাতে চরম শাস্তি ও স্থায়ী জাহান্নামের বিধান। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তুমি কি তাদের দেখনি, যারা আল্লাহর আয়াতগুলোতে বিতর্ক সৃষ্টি করে? কে কোথা হতে তাদের মুখ ফিরিয়ে দেয়? এরাই তারা, যারা অস্বীকার করেছে এ কিতাব এবং আমার রাসুলদের; যা-সহ প্রেরণ করেছিলাম তা-ও। সুতরাং তারা অচিরেই জানতে পারবে, যখন বেড়ি ও শৃঙ্খল তাদের গলদেশে পড়বে। তাদের টেনে নিয়ে যাওয়া হবে ফুটন্ত পানিতে। এরপর এদের দগ্ধ করা হবে আগুনে।’ (সুরা মোমিন : ৬৯-৭২)।
পূর্ববর্তী জাতি ধ্বংসের কারণ
আল্লাহর আয়াতগুলোকে অস্বীকার করাই আগেকার উম্মতদের ধ্বংস হওয়ার একমাত্র কারণ ছিল। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আদজাতি তাদের প্রতিপালকের নিদর্শনাবলি অস্বীকার করেছিল। তাঁর রাসুলদের অবাধ্যতা করেছিল। এমন সব ব্যক্তির আনুগত্য করেছিল, যারা ছিল চরম স্পর্ধিত ও সত্যের ঘোর দুশমন। এ দুনিয়ায় তাদের পেছনে লানত রয়েছে এবং কেয়ামতের দিনেও। জেনে রাখ, আদজাতি তাদের পালনকর্তাকে অস্বীকার করেছে। আর হুদজাতি ও আদজাতির প্রতি অভিসম্পাত রয়েছে।’ (সুরা হুদ : ৫৯-৬০)। আমাদের সামনে সফল ও সুপথপ্রাপ্ত কামিয়াব ব্যক্তিদের পথনির্দেশ স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে; আবার বিপথগামী ও পথভ্রষ্টদের পথও স্পষ্ট। তাই আল্লাহর মনোনীত ও সৌভাগ্যবান বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হতে হবে; পথহারা ও বিপথগামী হয়ে দুনিয়া ও আখেরাতকে ধ্বংস করা যাবে না।
১২ জিলকদ ১৪৪৪ (২ জুন ২০২৩) তারিখে মদিনার মসজিদে নববির জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন মুহাম্মাদুল্লাহ ইয়াসিন