মক্কা নগরীর মর্যাদা
মিনহাজুল আরিফীন
প্রকাশ : ০৯ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মক্কা-মদিনার নাম শোনামাত্র মোমিন-হৃদয়ে আনন্দের হিল্লোল ওঠে। মনের কোণে খেলে যায় এক অপার্থিব শিহরণ। হৃদয়ে সৃষ্টি হয় অনিঃশেষ মধুর আমেজ। এক অদৃশ্য আকর্ষণ যেন ক্রমশ তাড়িয়ে নেয় সুদূর মক্কা-মদিনায়। ইসলামের শুভযাত্রা শুরু হয়েছিল এ নগরী থেকেই। এখানেই জন্মগ্রহণ করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মুহাম্মদ (সা.)। জীবনের মহাগুরুত্বপূর্ণ তেপ্পান্নটি বছর এখানেই কাটান তিনি। এখানেই নবুয়ত লাভ করেন। এ শহরেই অবস্থিত মসজিদুল হারাম। এসব কারণে মক্কাকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্রতম নগরী। কোরআনের একাধিক আয়াতে এ পবিত্র নগরীর বর্ণনা এসেছে। সেসব আয়াতে এ নগরীর সম্মান, মর্যাদা, ঐতিহ্য, প্রাচীনত্ব ও গুরুত্ব সবিস্তারে ফুটে উঠেছে। ইতিহাসের পরম্পরায় সর্বযুগেই পৃথিবীর বুকে মানুষ পবিত্র মক্কার বিশেষ মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য অন্তরে পুষে মক্কার প্রতি আলাদা সম্মান প্রদর্শন করে আসছেন।
মক্কার মর্যাদা আল্লাহ প্রদত্ত
এ শহর অন্যান্য শহরের মতো নয় যে, সেখানে যা ইচ্ছে করা যাবে। এর রয়েছে স্বতন্ত্র মর্যাদা। আল্লাহতায়ালা যেদিন জমিন ও আসমান সৃষ্টি করেছেন, সেদিন থেকেই মক্কাভূমিকে বিশেষ মর্যাদাদানে ভূষিত করেছেন। কোরআনে এসেছে, ‘আমি তো আদিষ্ট হয়েছি এ নগরীর মালিকের ইবাদত করতে, যিনি একে সম্মানিত করেছেন।’ (সুরা নামল : ৯১)। অন্য আয়াতে এরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ কাবাকে সম্মানিত ঘর এবং মানুষের কল্যাণের জন্য নির্ধারিত করেছেন।’ (সুরা মায়িদা : ৯৭)। একই কথা প্রতিধ্বনিত হয়েছে রাসুল (সা.)-এর মুখেও। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ের দিন রাসুল (সা.) বললেন, ‘আল্লাহতায়ালা এ শহরকে হারাম করে দিয়েছেন, যখন থেকে তিনি আসমান-জমিন সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ হারাম করার দ্বারা এ নগরী কেয়ামত পর্যন্ত হারাম থাকবে। আমার আগে কারও জন্য এখানে যুদ্ধ করা বৈধ ছিল না, আমার জন্যও বৈধ নয়। তবে দিনের কিছু সময় বৈধতা দেয়া হয়েছিল। এখন থেকে কেয়ামত পর্যন্ত তা হারাম হিসেবে থাকবে।’ (মুসলিম : ১/৪৩৭)। এ হাদিসে হারাম অর্থ সম্মান, অর্থাৎ মক্কা শরিফ হারামের সীমানা সৃষ্টির প্রথম থেকে সম্মানিত। তাতে কোনো ধরনের পাপের কাজ করা যাবে না।
মক্কা সব নগরীর মা
মক্কা নগরী ইসলাম ধর্মের প্রধানতম পবিত্র স্থান। বিশ্বের সব মুসলমান মক্কার কাবা শরিফের দিকে মুখ করেই দৈনিক অন্তত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন। তা ছাড়া সমগ্র আরব উপদ্বীপেরও অন্যতম শহর হিসেবে মক্কাকে বিবেচনা করা হয়। মুসলিম জাতির কাছে এটিই পৃথিবীর পবিত্রতম ভূখণ্ড। ইসলামের সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (সা.) এ ভূখণ্ড থেকেই ইসলামের বাণী প্রচারের সূচনা করেন। মহানবী (সা.)-এর আগেও এ ভূমি ইবরাহিম (আ.) ও তার পুত্র ইসমাঈল (আ.)-এর পদধূলিতে ধন্য হয়। পবিত্র কোরআনে মক্কা নগরীকে একাধিক নামে সম্বোধন করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে ‘উম্মুল কোরা’ বা ‘জনপদের মা’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি আপনার প্রতি কোরআন অবতীর্ণ করেছি আরবি ভাষায়, যাতে আপনি সতর্ক করতে পারেন নগরগুলোর মা মক্কা ও তার চতুর্দিকের লোকজনকে।’ (সুরা শূরা : ৭)। অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ মক্কাকে ‘উম্মুল কোরা’ আখ্যায়িত করে মহানবী (সা.)-কে সম্মোধন করে বলেছেন, ‘এ কোরআন এমন গ্রন্থ, যা আমি অবতীর্ণ করেছি পূর্ববর্তী কিতাবের সত্যতা প্রমাণকারী হিসেবে এবং যাতে আপনি উম্মুল কোরা বা মক্কাবাসী ও পার্শ্ববর্তীদের সতর্ক করেন। যারা পরকালে বিশ্বাস স্থাপন করে, তারা এর প্রতিও বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তারা স্বীয় নামাজ সংরক্ষণ করে।’ (সুরা আনআম : ৯২)।
নিরাপদ নগরী মক্কা
কোনো কিছুতে আল্লাহর শপথ করা তার সম্মানের প্রমাণ। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ এ মক্কার কসম খেয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কসম তিন ও জাইতুনের, কসম সিনাই পর্বতের এবং কসম এ নিরাপদ শহরের।’ (সুরা তিন : ১-৩)। এ আয়াতে ‘এ নিরাপদ শহর’ বলে মক্কা নগরীকে বোঝানো হয়েছে। আরেক আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি কসম করছি এ শহরের। আর আপনি এ শহরের অধিবাসী।’ (সুরা বালাদ : ১-২)। এমনকি এ শহরে প্রবেশকারীর জন্য রয়েছে বিশেষ নিরাপত্তা দান। অর্থাৎ পবিত্র এ নগরীতে যে-ই প্রবেশ করবে, সে নিরাপত্তা লাভ করবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যে কেউ সেখানে (মক্কায়) প্রবেশ করে, সে-ই নিরাপদ।’ (সুরা আলে ইমরান : ৯৭)।
সম্মান রক্ষায় নবীজির হুঁশিয়ারি
বিশ্ব মুসলমানের সম্মিলন স্থল পবিত্র নগরী মক্কা। আল্লাহতায়ালার ঘর কাবা সব মুসলমানের হৃদয়ের স্পন্দন। যারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হজ-ওমরা ও পরিদর্শনে এ পবিত্র নগরীতে প্রবেশ করবে, তাদের উচিত এ নগরীর পবিত্রতা, আদব ও সম্মান রক্ষা করা। এ পবিত্র নগরী মক্কা ও কাবার আদব এবং সম্মানের ব্যাপারে হাদিসে সুস্পষ্ট নির্দেশনা এসেছে। সুতরাং হজ-ওমরা ও জেয়ারত উপলক্ষে যারা পবিত্র নগরী মক্কা ও বাইতুল্লায় আগমন করবে, তারা সুন্নত আদায়ে গোসল করে এ নগরীতে প্রবেশ করবে। যদি কেউ এ পবিত্র নগরী ও বাইতুল্লাহর সম্মানে মক্কায় প্রবেশের আগে গোসল করে রওনা দেয়, তবে তার সুন্নত আদায় হয়ে যাবে। মহানবী (সা.) পবিত্র মক্কা নগরীর সম্মান রক্ষার ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘আমার উম্মত ততদিন পর্যন্ত নিরাপদ থাকবে, যতদিন তারা মক্কার যথার্থ সম্মান করবে। যখন তারা এর বিপরীত করবে, তখন তারা ধ্বংস হয়ে যাবে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩১১০)।
জ্ঞান ও ঈমানের আঁতুড়ঘর
পবিত্র মক্কা জ্ঞানের শহর। এটি এমন এক বরকতময় শহর, যেখান থেকে ইসলামের আলো প্রজ্বলিত হয়েছিল এবং এখানেই এসে শেষ হবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘স্বল্পসংখ্যক ও অপরিচিত অবস্থায় ইসলামের সূচনা হয়েছিল, অচিরেই তা আবার সূচনার মতো গরিব অবস্থায় ফিরে আসবে এবং তা উভয় মসজিদের (মক্কা ও মদিনার) মধ্যবর্তী এলাকায় গুটিয়ে আসবে, যেমন সাপ তার গর্তের দিকে গুটিয়ে আসে।’ (মুসলিম : ১/১৩৩)। আরেক হাদিসে ঈমান মদিনার দিকে ফিরে আসবে বলা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় (কেয়ামতের পূর্বক্ষণে) ঈমান মদিনার দিকে এমনভাবে ফিরে আসবে, যেমন সাপ তার গর্তের দিকে ফিরে আসে।’ (বোখারি : ১৮৭৬)।
মক্কার জন্য জাতির পিতার প্রার্থনা
মক্কা নগরী মর্যাদাবানই নয়, এ নগরীতে যারা বাস করবেন, তাদের জন্য আল্লাহর নবী ইবরাহিম (আ.) অনেক গুরুত্বপূর্ণ দোয়া করেছেন। মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম (আ.) মক্কাকে হারাম হওয়ার ঘোষণা দেন। এরপর আল্লাহর নির্দেশে তিনি আল্লাহর ঘর কাবা নির্মাণ করেন এবং একে পবিত্র ঘোষণা করেন। এর পর মানুষের উদ্দেশ্যে তিনি হজের ঘোষণা দেন এবং মক্কা নগরীর জন্য দোয়া করেন। যেই দোয়ার কল্যাণে মক্কা আজ বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ ও শান্তির স্থান। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘স্মরণ করুন যখন ইবরাহিম বলেছিল, হে আমার রব! এ শহরকে নিরাপদ করুন এবং আমাকে ও আমার পুত্রদের মূর্তি পূজা হতে দূরে রাখুন।’ (সুরা ইবরাহিম : ৩৫)। মক্কা নগরীর অধিবাসীদের জীবন-জীবিকার প্রাচুর্যের জন্য ইবরাহিম (আ.) দোয়ায় বলেছিলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! একে আপনি নিরাপদ নগরী করুন এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখেরাতে ঈমান আনে, তাদের ফলমূল থেকে জীবিকা দান করুন।’ (সুরা বাকারা : ১২৬)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় ইবরাহিম (আ.) মক্কাকে হারাম ঘোষণা করেন এবং শহরটির জন্য দোয়া করেন।’ (বোখারি : ১৮৮৩, মুসলিম : ১৩৮৩)।
আল্লাহপ্রেমীদের তীর্থভূমি
যুগ যুগ ধরে মক্কা আল্লাহপ্রেমীদের তীর্থভূমি। এ জন্য আল্লাহতায়ালা ইবরাহিম (আ.) ও তার ছেলে ইসমাঈল (আ.)-কে ইবাদতকারীদের জন্য এ নগরকে প্রস্তুত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা দুইজন পবিত্র কর আমার ঘরকে তাওয়াফকারী, ইতেকাফকারী ও রুকুণ্ডসেজদাকারীদের জন্য।’ (সুরা বাকারা : ১২৫)। এ ছাড়া মক্কা নগরী আল্লাহতায়ালার নানা নিদর্শনে ভরপুর। বিশেষভাবে রয়েছে জমজম কূপ, জান্নাত থেকে প্রেরিত দুটি পাথর- হাজরে আসওয়াদ ও মাকামে ইবরাহিম। এরশাদ হয়েছে, ‘তাতে (মক্কায়) অনেক সুস্পষ্ট নিদর্শন আছে। (যেমন) মাকামে ইবরাহিম।’ (সুরা আলে ইমরান : ৯৭)। কাতাদা ও মুজাহিদ (রহ.) বলেন, ‘প্রকাশ্য নিদর্শনগুলোর একটি হলো, মাকামে ইবরাহিম।’ (তাফসিরে তাবারি : ৪/৮)।
মক্কায় দাজ্জাল ঢুকতে পারবে না
কেয়ামতের আগে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে দাজ্জাল সদম্ভ বিচরণ করবে। শুধু মক্কা-মদিনায় এ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী ঢুকতে পারবে না। তার নৈরাজ্য ও অরাজকতা থেকে মক্কা নগরী নিরাপদ থাকবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘এমন কোনো ভূখণ্ড নেই, যা দাজ্জালের পদভারে মথিত হবে না। তবে মক্কা-মদিনায় সে প্রবেশ করতে পারবে না।
সেখানকার প্রতিটি গলিতে ফেরেশতারা সারিবদ্ধভাবে পাহারায় নিয়োজিত থাকবে। এর পর মদিনা তার অধিবাসীসহ তিনটি ঝাঁকুনি দেবে। যার ফলে আল্লাহ (মদিনা থেকে) সব কাফের ও মোনাফেককে বের করে দেবেন।’ (বোখারি : ১৮৮১, মুসলিম : ২৯৪৩)।