জিলহজ মাসের আমল
জিলহজ মাসের প্রথম দশকের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহতায়ালা কোরআনে কারিমে এ দশ রাতের শপথ করেছেন। এ দশ দিনের নেকআমল আল্লাহর কাছে অত্যধিক প্রিয়। যার বর্ণনা বিভিন্ন হাদিসে এসেছে। তাই এ গুরুত্বপূর্ণ দশ দিনের জন্য রয়েছে বিশেষ কিছু আমল। সেগুলো নিয়ে মক্কা শরিফ থেকে লিখেছেন- মিনহাজুল আরিফীন
প্রকাশ : ১৬ জুন ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নখ ও চুল না কাটা
জিলহজ মাসের চাঁদ ওঠার আগেই চুল, গোঁফ কাটা এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের পশম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা চাই। তেমনি হাত-পায়ের নখ কাটতে হবে। এরপর কোরবানির দিন কোরবানি আদায় করার পর তা পরিষ্কার করতে হবে। মধ্যবর্তী সময়ে এগুলো কাটা থেকে বিরত থাকা চাই। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোরবানি করার ইচ্ছে করবে, সে যেন জিলহজের নতুন চাঁদ দেখার পর থেকে কোরবানি করা পর্যন্ত তার চুল ও নখ না কাটে।’ (তিরমিজি : ১৫২৩, সুনানে আবি দাউদ : ২৭৯১)। আর যে ব্যক্তি কোরবানি করতে সক্ষম নয়, সে-ও এ আমল করবে। আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.) সূত্রে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আমাকে কোরবানির দিনে ঈদ (পালনের) আদেশ করা হয়েছে; যা আল্লাহ এ উম্মতের জন্য নির্ধারণ করেছেন।’ এক সাহাবি আরজ করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! যদি আমার কাছে শুধু একটি মানিহা থাকে (অর্থাৎ অন্যের থেকে নেয়া দুগ্ধ দানকারী উটনী), আমি কি তা কোরবানি করব?’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘না। তবে তুমি চুল, নখ ও গোঁফ কাটবে এবং নাভির নিচের পশম পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহর দরবারে তোমার পূর্ণ কোরবানি বলে গণ্য হবে।’ (সুনানে আবি দাউদ : ২৭৮৯)।
রোজা রাখা
জিলহজের প্রথম নয় দিন রোজা রাখা উত্তম। রাসুল (সা.) জিলহজের নয় দিন রোজা রাখতেন। (সুনানে আবি দাউদ : ২৪৩৭)। এ নয় দিনের মধ্যে ৯ জিলহজের রোজাকে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কারণ, এ দশক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার বড় কারণ হলো, এ দশকে আরাফার দিন রয়েছে। যা বছরের গুরুত্ব ও ফজিলতপূর্ণ দিন। এ দিনের ব্যাপারে হাদিস শরিফে পৃথক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। আবু কাতাদা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘আরাফার দিনের (৯ জিলহজ) রোজার বিষয়ে আমি আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা করি, (এর দ্বারা) আগের এক বছরের এবং পরের এক বছরের গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (মুসলিম : ১১৬২)। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, কাতাদা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেন, ‘আরাফার দিনের একটি রোজার দ্বারা আগের ও পরের এক বছরের গোনাহ মাফ হয়ে যায়। আশুরার রোজার দ্বারাও পূর্ববর্তী এক বছরের গোনাহ মাফ হয়ে যায়।’ (তিরমিজি : ১৫৭, মুসনাদে আহমদ : ২২৫৩৫)। তবে আরাফায় অবস্থানকারী হাজিদের জন্য রোজা রাখা মুস্তাহাব নয়। কেননা, মহানবী (সা.) আরাফায় অবস্থান করেছিলেন রোজাবিহীন অবস্থায়। এ ছাড়া ভিন্ন এক বর্ণনায় এসেছে, আরাফা তথা ৯ জিলহজ আল্লাহতায়ালা বছরের অন্য দিনের তুলনায় অধিক সংখ্যক জাহান্নামিকে মুক্তি দেন। সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যাব (রহ.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, আয়েশা (রা.) বলেছেন, রাসুল (সা.) বলেন, ‘আরাফা দিবসের তুলনায় এমন কোনো দিন নেই, যেদিন আল্লাহতায়ালা সর্বাধিক লোককে দোজখের আগুন থেকে মুক্তি দান করেন। আল্লাহতায়ালা নিকটবর্তী হন, অতঃপর বান্দাদের সম্পর্কে ফেরেশতাদের সামনে গৌরব করেন। বলেন, তারা কী উদ্দেশ্যে সমবেত হয়েছে (বা তারা কী চায়)?’ (মুসলিম : ৩১৭৯)।
তাকবিরে তাশরিক পাঠ
৯ জিলহজ ফজর থেকে ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত প্রত্যেক ফরজ নামাজের পর তাকবিরে তাশরিক বলা। তাকবিরে তাশরিক বিষয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহকে স্মরণ কর।’ (সুরা বাকারা : ২০৩)। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘এখানে নির্দিষ্ট দিনগুলো দ্বারা উদ্দেশ্য, তাকবিরে তাশরিক পাঠের দিনগুলো।’ (বোখারি : ১০৮৭২)। ৯ জিলহজ ফজর থেকে ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্তের নামাজের পর একবার করে তাকবিরে তাশরিক বলা ওয়াজিব। জামাতে নামাজ পড়া হোক বা একাকী, পুরুষ বা নারী, মুকিম বা মুসাফির- সবার ওপর ওয়াজিব। এমনকি ৯ তারিখ থেকে ১৩ তারিখ আসর পর্যন্ত কোনো নামাজ কাজা হয়ে গেলে এবং ওই কাজা এ দিনগুলোতে আদায় করলে সে কাজা নামাজের পরও তাকবিরে তাশরিক পড়বে। পুরুষরা তাকবির বলবে উচ্চ আওয়াজে, আর নারীরা নিম্নস্বরে।
কোরবানি করা
প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন যেসব মুসলিম নর-নারী ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে, তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোরবানির দিনের আমলগুলোর মধ্য থেকে পশু কোরবানি করার চেয়ে কোনো আমল আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় নয়। কেয়ামতের দিন এ কোরবানিকে তার শিং, পশম ও ক্ষুরসহ উপস্থিত করা হবে। আর কোরবানির রক্ত জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহর কাছে কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা সন্তুষ্ট মনে কোরবানি কর।’ (তিরমিজি : ১৪৯৩)।
ঈদের দিন রোজা না রাখা
১০ জিলহজ (ঈদুল আজহার দিন)-সহ আইয়ামে তাশরিকের (১১, ১২ ও ১৩ জিলহজ) দিনগুলোতে কোনো ধরনের রোজা না রাখা। হাদিসে এসেছে, আইয়্যামে তাশরিক পানাহার ও আল্লাহর জিকিরের দিন। (সহিহুল জামে : ২৬৮৯)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা এ দিনগুলোতে রোজা রেখ না। কেননা, এগুলো পানাহারের দিন।’ (মুসনাদে আহমদ : ১০৬৬৪)।
নফল ইবাদতে যত্নবান হওয়া
জিলহজের পথম দশকে বেশি বেশি নফল ইবাদত করা চাই। সালাত, সাওম, তসবি-তাহলিল ইত্যাদি যে কোনো নফল হতে পারে। নবীজি (সা.) বলেন, ‘জিলহজ মাসের প্রথম দশ দিনের আমলের চেয়ে অন্য কোনো দিনের আমল উত্তম নয়।’ সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘জিহাদও (উত্তম) নয়?’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘জিহাদও নয়। তবে সে ব্যক্তি ছাড়া, যে নিজের জানমাল নিয়ে জিহাদে যায় এবং কিছুই নিয়ে ফিরে আসে না।’ (বোখারি : ৯৬৯)। বিশেষ করে, এ দশকের প্রতিটি রাতকে নফল ইবাদতের মাধ্যমে পার করা চাই।
বেশি বেশি জিকির করা
এ মাসে অধিক পরিমাণ জিকির করা আবশ্যক। বিশেষ করে, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার এবং আলহামদুলিল্লাহ পড়া। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর কাছে জিলহজের প্রথম দশকের আমলের চেয়ে অধিক মহৎ এবং প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। সুতরাং তোমরা এ দিনগুলোতে বেশি বেশি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার এবং আলহামদুলিল্লাহ পড়।’ (মুসনাদে আহমদ : ৫৪৪৬)।