সময় নদীর স্র্রোতধারার মতো বয়ে যায়। কখনও কারও জন্য থেমে থাকে না। রবের ইবাদতের জন্য জীবনের এ সময় মহামূল্যবান। জীবনের প্রতিটি সেকেন্ড পেরিয়ে যাচ্ছে, আর আমরা কবরের পথে এগোচ্ছি। সে-ই বড় ভাগ্যবান, যে নেক আমল করেছে, বিশেষ সময়ে ইবাদতের জন্য সময়ের গুরুত্ব অনুধাবন করে নিজেকে সঁপে দিয়েছে। পক্ষান্তরে যে সময় অপচয় করেছে এবং অনর্থ সময়ের অপব্যয় করেছে, সে বড় দুর্ভাগা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সেদিন (আমলসমূহের) ওজন (করার বিষয়টি) অকাট্য সত্য। সুতরাং যাদের পাল্লা ভারী হবে, তারাই হবে কৃতকার্য; আর যাদের পাল্লা হালকা হবে, তারা সেসব লোক, যারা আমার আয়াতসমূহের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করে নিজেদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।’ (সুরা আরাফ : ৮-৯)।
ইসলামের বিশেষ নিদর্শন
আল্লাহতায়ালা ইসলামকে পরিবর্তন ও বিকৃতির কবল থেকে হেফাজতের দায়িত্ব নিয়েছেন। দ্বীন রক্ষার উদ্দেশ্যে কিছু উপকরণের ব্যবস্থা করেছেন। যাকে পরিভাষায় নিদর্শন বলা হয়, যা ইসলামের আবহমানকাল থেকে উত্তরাধিকার হিসেবে আমাদের কাছে চলে এসেছে। ইসলামের মূল কথা হচ্ছে, এক আল্লাহর ইবাদত করা। আর নিদর্শনগুলোর মানে হচ্ছে, আল্লাহতায়ালাকে সর্বোত্তম সম্মান প্রদর্শন, তাঁর জিকির ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা। মানুষের মাঝে দ্বীনের নিদর্শন বেঁচে থাকলে ইসলাম বেঁচে থাকবে; আর যেখানে তার নিদর্শনকে সবচেয়ে বেশি মূল্যায়ন করা হবে, সেখানে আল্লাহর তাজিম ও জিকির বিদ্যমান থাকবে। দ্বীনের নিদর্শনের প্রতি সম্মান প্রদর্শনকে আল্লাহতায়ালা অন্তরের ভয় ও তাকওয়ার আলামত সাব্যস্ত করেছেন। ঈমান যত মজবুত হবে, দ্বীনের নিদর্শন তত প্রকাশ পাবে। মোমিন বান্দারা নিদর্শনকে বেশি সম্মান করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কেউ আল্লাহর নিদর্শনকে সম্মান করলে তা অন্তরের তাকওয়া থেকেই অর্জিত হয়।’ (সুরা হজ : ৩২)।
হজ-ওমরাহ ইসলামের নিদর্শন
আল্লাহতায়ালার নিদর্শন হলো, তাঁর দ্বীনের বাহ্যিক চিহ্ন ও কর্ম। সার্বক্ষণিক আমরা তাঁরই নিদর্শন ও বিধি-নিষেধের মাঝে দিনাতিপাত করছি। কালিমায়ে তাইয়্যেবা ও শাহাদত হলো ঈমানের শর্ত ও তার নিদর্শন; যা আজান-ইকামতে প্রতিদিন উচ্চারিত হয়। আর আজান হলো নামাজের নিদর্শন। যে ব্যক্তি নামাজ নষ্ট করল, সে যেন আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন নষ্ট করল। নামাজের মতো সওম, জাকাত এবং বিশেষ করে হজ-ওমরাহ ইসলামের নিদর্শন। ইমাম আওজায়ি (রহ.) বলেন, ওমর (রা.) তার শাসনকালে শাসকদের কাছে এ বলে চিঠি লিখেছেন, নামাজের সময় সব ব্যস্ততা থেকে মুক্ত থাকুন। যে ব্যক্তি নামাজ পরিত্যাগ করল, সে যেন ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন নষ্ট করে ফেলল। সওম, জাকাতের মতো বাইতুল্লাহ, মাকামে ইবরাহিম, মুলতাজাম, সাফা-মারওয়া, মিনা-মুজদালিফা- এগুলোও ইসলামের অন্যতম নিদর্শন।
হারাম শরিফের মর্যাদা
আল্লাহতায়ালা মসজিদে হারামে নামাজ পড়াকে এক লাখ রাকাত নামাজের সওয়াব ধার্য করেছেন। শুধু তা-ই নয়, মক্কা শহরকে অন্য সব শহর থেকে বেশি মর্যাদা দান করেছেন। অন্যসব শহর থেকে বেশি সম্মানিত করেছেন। ফলে এ শহরটি সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু, সব হৃদয়ের উদ্দিষ্ট স্থান। আমাদের পূর্বপুরুষরা এ হারাম শরিফের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। যথাযথ সম্মানের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। হারাম শরিফ থেকেই নবীজি (সা.) মেরাজে গমন করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘পবিত্র সেই সত্তা, যিনি নিজ বান্দাকে রাতারাতি মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় নিয়ে যান তাকে আমার কিছু নিদর্শন দেখানোর জন্য, যার চারপাশকে আমি বরকতময় করেছি। নিশ্চয় তিনি সবকিছুর শ্রোতা এবং সবকিছুর জ্ঞাতা।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ১)। যারা মক্কার সফরকারী ও জেয়ারতকারী হচ্ছেন, তারা অবশ্যই আল্লাহতায়ালার হেফাজতে অবস্থান করছেন। বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ। যেন এখানে কোনো অসম্মান না হয়, সতর্ক থাকতে হবে। নবীজি (সা.) বলেন, ‘এ (মক্কা) শহরকে আল্লাহ সম্মানিত করেছেন। এর একটি কাঁটাও কর্তন করা যাবে না। এতে বিচরণকারী শিকারকে তাড়া করা যাবে না। এখানে পড়ে থাকা বস্তু সংগ্রহ করে মালিকদের কাছে পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে ঘোষণা দেয়া ছাড়া কোনো বস্তু কেউ তুলে নেবে না।’ (বোখারি : ১৫৮৭)। এখন হারাম শরিফে হারাম মাসে দিনাতিপাত করছি, যা বছরের উৎকৃষ্ট দিনগুলোর অন্যতম। আল্লাহতায়ালা কোরআনে যার শপথ করেছেন। অন্যান্য দিনের ওপর তার প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘শপথ ফজরের, দশ রজনীর এবং জোড়-বেজোড়ের।’ (সুরা ফজর : ১-৩)।
জিলহজের বিশেষ আমল
জিলহজ মাসে অনেক আমল এক সঙ্গে করার সুবর্ণ সুযোগ হয়, যা অন্য সময়ে সম্ভব হয় না। এ মাসে হজের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের সুযোগ আসে, তেমনি কোরবানিও দেয়া যায়। তদ্রƒপ নফল নামাজ-রোজা, দান-সদকা করার অপূর্ব সুযোগ হয়। এ দিনগুলোর ইবাদত-বন্দেগি অন্য সময়ের ইবাদতের তুলনায় অধিক সওয়াবপূর্ণ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘এ দিনগুলো থেকে অন্য কোনো দিন আল্লাহর কাছে এত প্রিয় নয়। তোমরা এ দিনগুলোতে বেশি বেশি জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিলে মগ্ন থাক।’ (মুসনাদে আহমদ : ৫৪৪৬)। ওমর (রা.) ও আবু হুরায়রা (রা.) একই সঙ্গে বাজারে যেতেন এবং তাকবির বলতে বলতে রাস্তা পেরুতেন। এসব দেখে অন্যান্য সাধারণ মানুষও তাকবির বলত। (বোখারি : ৯৬৯)।
২৬ জিলকদ ১৪৪৪ (১৬ জুন ২০২২) তারিখে মক্কার মসজিদে হারামের জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন মুহাম্মাদুল্লাহ ইয়াসিন