১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। টাকা-পয়সা, সোনা-রুপা, অলঙ্কার, বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজনে আসে না- এমন জমি, প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় আসবাবপত্র (যেমন- টেলিভিশন, রেডিও, ক্যাসেট, খেলনার সরঞ্জামাদি) কোরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য। (আল মুহিতুল বোরহানি : ৮/৪৫৫, ফতোয়ায়ে তাতারখানিয়া : ১৭/৪০৫)।
যতটুকু সম্পদে কোরবানি
কোরবানির নেসাব হলো- সোনার ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি, রুপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি, টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। আর সোনা বা রুপা কিংবা টাকা-পয়সার কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে; কিন্তু প্রয়োজনের অতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমমূল্যের হয়, তাহলেও তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। (ফতোয়ায়ে শামি : ৫/২২২, ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া : ৫/২৯২)।
নেসাবে বছরের প্রসঙ্গ
কোরবানির নেসাব পুরো বছর থাকা জরুরি নয়; বরং কোরবানির তিন দিনের মধ্যে যে কোনো দিন থাকলেই কোরবানি ওয়াজিব হবে। (বাদায়েউস সানায়ে : ৪/১৯৬, রদ্দুল মুহতার : ৬/৩১২)। বরং ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা অথবা সে পরিমাণ নগদ টাকার সম্পদের মালিকের ওপর কোরবানি ওয়াজিব; বছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩১১৪)।
হারাম সম্পদে কোরবানি
হারাম সম্পদের ওপর ভিত্তি করে কোরবানি ওয়াজিব হয় না। তাই কোরবানিদাতা হালাল সম্পদ না থাকলে সন্দেহমূলক অর্থ হলেও ধার করে কোরবানি করবে এবং নিজ হালাল অর্থ দিয়ে ঋণ পরিশোধ করবে। (ফতোয়ায়ে শামি : ২/২৫, আপকে মাসাইল আওর উনকা হল : ৬/২৫২)।
ব্যাংকের বেতনে কোরবানি
সুদভিত্তিক ব্যাংকের সাধারণ কর্মচারী লেভেলের চাকরিজীবীর বেতন হারাম নয়, তবে সন্দেহযুক্ত। তাই সে কারও কাছ থেকে অর্থ ধার নিয়ে কোরবানি করবে। (আপকে মাসাইল আওর উনকা হল : ৬/২৫২)।
মুসাফিরের কোরবানি
যে ব্যক্তি কোরবানির দিনগুলোতে মুসাফির থাকবে (অর্থাৎ ৪৮ মাইল বা প্রায় ৭৮ কিলোমিটার দূরে যাওয়ার নিয়তে নিজ এলাকা ত্যাগ করবে), তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব নয়।
(ফতোয়ায়ে কাজিখান : ৩/৩৪৪, বাদায়েউস সানায়ে : ৪/১৯৫)। ইবরাহিম নাখায়ি (রহ.) বলেন, ‘মুসাফিরের জন্য কোরবানির ব্যাপারে ছাড় দেয়া হয়েছে।’ (মুসান্নাফে আবদির রাজ্জাক : ৪/৩৮২)।
মুসাফির ও মুকিমের বিধান
কোরবানির সময়ের প্রথম দিকে মুসাফির থাকার পরে তৃতীয় দিন কোরবানির সময় শেষ হওয়ার আগে মুকিম হলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হবে। পক্ষান্তরে প্রথম দিকে মুকিম ছিল, এর পর তৃতীয় দিনে মুসাফির হয়ে গেছে; এ ক্ষেত্রে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব থাকবে না। অর্থাৎ সে কোরবানি না দিলে গোনাহগার হবে না। (বাদায়েউস সানায়ে : ৪/১৯৬, ফতোয়ায়ে খানিয়া : ৩/৩৪৬, আদ্দুররুল মুখতার : ৬/৩১৯)।
শিশু-কিশোর ও পাগলের বিধান
নাবালেগ শিশু-কিশোর ও যে সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন নয়, নেসাবের মালিক হলেও তাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। অবশ্য তাদের অভিভাবক নিজ সম্পদ দ্বারা তাদের পক্ষ থেকে কোরবানি করলে তা সহিহ হবে। (বাদায়েউস সানায়ে : ৪/১৯৬, রদ্দুল মুহতার : ৬/৩১৬)। তবে নিজের সম্পদ থেকে নাবালেগের নামে কোরবানি দেয়া অভিভাবকের ওপর ওয়াজিব নয়; বরং মুস্তাহাব। (রদ্দুল মুহতার : ৬/৩১৫)।
দরিদ্র ব্যক্তির কোরবানি
দরিদ্র ব্যক্তির ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব নয়; কিন্তু সে যদি কোরবানির নিয়তে কোনো পশু ক্রয় করে, তাহলে তা কোরবানি করা ওয়াজিব হয়ে যায়। (বাদায়েউস সানায়ে : ৪/১৯২)।
একান্নভুক্ত পরিবারে কোরবানি
একান্নভুক্ত পরিবারে একাধিক ব্যক্তির ওপর কোরবানি ওয়াজিব হওয়ার শর্ত পাওয়া গেলে (অর্থাৎ তাদের কাছে নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে) তাদের প্রত্যেকের ওপর ভিন্ন ভিন্ন কোরবানি ওয়াজিব। পরিবারের যত সদস্যের ওপর কোরবানি ওয়াজিব, তাদের প্রত্যেককেই একটি করে পশু কোরবানি করতে হবে কিংবা বড় পশুতে পৃথক পৃথক অংশ দিতে হবে। একটি কোরবানি সবার জন্য যথেষ্ট হবে না। (ফতোয়ায়ে শামি : ৫/২২০, ফতোয়ায়ে আলমগিরি : ৫/২৯২)।
পিতার নামে কোরবানি
ছেলে কোরবানির পশু ক্রয় করে পিতার (নামে) পক্ষ থেকে কোরবানি দিলে পিতার ওয়াজিব কোরবানি আদায় হবে না। বরং পিতার জন্য পৃথকভাবে পশু ক্রয় করে বা ওই পশুতে নিজের মালিকানার অর্থ দিয়ে শরিক হয়ে কোরবানি আদায় করতে হবে। (ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া : ৫/৩০২)।
নবীজির নামে কোরবানি
সামর্থ্যবান ব্যক্তির রাসুল (সা.)-এর পক্ষ থেকে কোরবানি করা উত্তম। এটি বড় সৌভাগ্যের বিষয়। হানশ (রহ.)-সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন- আমি আলী (রা.)-কে দেখলাম, তিনি দুটি বকরি কোরবানি করলেন। তাকে বললাম, ‘এটি কি? (আপনার ওপর তো একটি কোরবানি করা আবশ্যক ছিল; কিন্তু দুটি করলেন কেন?)’ বললেন, ‘রাসুল (সা.) আমায় অসিয়ত করেছেন, যেন আমি তার পক্ষ থেকে কোরবানি করি। এ কারণে আমি তার পক্ষ থেকে (একটি) কোরবানি করেছি।’ (সুনানে আবি দাউদ : ২৭৯০, তিরমিজি : ১/২৭৫, ইলাউস সুনান : ১৭/২৬৮)।
অন্যের কোরবানি আদায়
অন্যের ওয়াজিব কোরবানি দিতে চাইলে সে ব্যক্তির অনুমতি নিতে হবে। নইলে তার কোরবানি আদায় হবে না। অবশ্য স্বামী বা পিতা যদি স্ত্রী বা সন্তানের অনুমতি ছাড়াই তাদের পক্ষ থেকে কোরবানি করে, তাহলে দেশীয় সামাজিক প্রচলনের কারণে তাদের কোরবানি আদায় হয়ে যাবে। তবে অনুমতি নিয়ে আদায় করা ভালো। (বাদায়েউস সানায়ে : ৪/২১১)।
মৃতের পক্ষ থেকে কোরবানি
মৃতের পক্ষ থেকে কোরবানি করা জায়েজ। মৃত ব্যক্তি যদি অসিয়ত না করে থাকে, তাহলে সেটি নফল কোরবানি হিসেবে গণ্য হবে। কোরবানির স্বাভাবিক গোশতের মতো তা নিজেরাও খেতে পারবে এবং আত্মীয়-স্বজনকেও দিতে পারবে। আর যদি মৃতব্যক্তি কোরবানির অসিয়ত করে যায়, তাহলে এর গোশত নিজেরা খেতে পারবে না; বরং গরিব-মিসকিনদের মাঝে সদকা করে দিতে হবে। (মুসনাদে আহমদ : ৮৪৫, ইলাউস সুনান : ১৭/২৬৮, রদ্দুল মুহতার : ৬/৩২৬, ফতোয়ায়ে কাজিখান : ৩/৩৫২)।
জীবিতের পক্ষ থেকে কোরবানি
মৃতের পক্ষ থেকে যেমনি ইসালে সওয়াবের উদ্দেশ্যে কোরবানি করা জায়েজ, তেমনি জীবিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে তার ইসালে সওয়াবের জন্য নফল কোরবানি করা জায়েজ। এ কোরবানির গোশত কোরবানিদাতা ও তার পরিবারও খেতে পারবে। (রদ্দুল মুহতার : ৬/৩২৬)।