মক্কা শরিফের জুমার খুতবা
উত্তম আচরণে ইসলামি নীতিমালা
শাইখ ড. ফয়সাল বিন জামিল গাজাবি
প্রকাশ : ০৬ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মানুষের নানান বর্ণ ও বৈচিত্র্য স্বভাব
হজরত আবু মুসা আশআরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহতায়ালা আদমকে সৃষ্টি করেছেন এমন মাটি দিয়ে, যা তিনি নিয়েছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। তাই তাঁর বংশধররা বিভিন্ন ধরনের মাটির পরিমাণ অনুযায়ী গড়ে উঠেছে। তাদের কেউ হয়েছে লাল বর্ণের, কেউ সাদা, কেউ কালো আর কেউ এসবের মাঝামাঝি। স্বভাবের দিক দিয়ে তাদের মধ্যে রয়েছে সহজ-সরল, কেউ কঠিন হৃদয়ের, কেউ দুষ্ট প্রকৃতির, কেউ আবার এর মাঝামাঝি। যেহেতু মানুষ অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং চলাফেরা ছাড়া একা থাকতে পারে না, তাই সে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কেমন আচরণ করবে, তা জানা দরকার। মানুষের সঙ্গে আচরণ ও চলাফেরার জন্য চিরন্তন কিছু নিয়মণ্ডনীতি রয়েছে, যা একজন মানুষের অবশ্যই জানা উচিত।
ব্যবহারের মূলনীতি
হে আল্লাহর বান্দারা! যেহেতু মানুষের মধ্যে দুর্বলতা আছে, সেই কারণে সঠিকভাবে মানুষের সঙ্গে চলাফেরা করার জন্য কতগুলো নিয়মণ্ডনীতি আপনাদের সামনে উপস্থাপন করছি। এই মূলনীতিগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি মূলনীতি হচ্ছে মহান আল্লাহতায়ালার বাণী : তিনি বলেন, আর ক্ষমা করার অভ্যাস গড়ে তুলুন, সৎকাজের নির্দেশ দিন এবং মূর্খ জাহেলদের থেকে দূরে সরে থাকুন। (সুরা আলআরাফ : ১৯৯)। হজরত সা’দি (রহ.) বলেন, মানুষের সঙ্গে উত্তম চরিত্র বজায় রাখা এবং তাদের সঙ্গে চলাফেরার ক্ষেত্র সম্পর্কে এই আয়াতটি একটি ব্যাপক অর্থবোধক আয়াত। সুতরাং মানুষের সঙ্গে যে আচরণ করা উচিত তা হলো ক্ষমা করে দেয়ার মনোভাব লালন করা। মানুষের অন্তর যা অনুমোদন করে এবং তাদের স্বাভাবিক স্বভাব-চরিত্রের সঙ্গে যা খাপ খায়, তাদের জন্য যা সহজ হয় তা করা। তাদের স্বভাবের সঙ্গে যা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তা চাপিয়ে দেয়া যাবে না। বরং প্রত্যেকেই তার কথা, কাজ ও আচরণের দ্বারা প্রশংসার যোগ্য হবে। এক্ষেত্রে তাদের যে ভুলত্রুটি হবে তা পাশ কাটিয়ে যেতে হবে। তাদের ত্রুটি থেকে নিজের দৃষ্টি সংযত করতে হবে। বয়সে ছোট কারো সঙ্গে তার ছোট হওয়ার কারণে, কম বুদ্ধিওয়ালার সঙ্গে তার বুদ্ধির কমতির কারণে, দরিদ্রদের সঙ্গে তার দরিদ্রতার কারণে অহংকার করা যাবে না। বরং সবার সঙ্গে এমন আচরণ করবে যাতে তারা খুশি হয়ে যায়। আয়াতে বর্ণিত আপনি সঙ্গত বিষয়ের আদেশ করুন এর অর্থ হচ্ছে, তাদের সঙ্গে ভালো কথা এবং ভালো কাজ করতে হবে এবং সবার সঙ্গে উত্তম চরিত্র মাধুর্য প্রদর্শন করতে হবে। সুতরাং আপনার পক্ষ থেকে কোনো কথা এবং কাজ যাই হোক না কেন তা যেন হয় সুন্দর এবং তা যেন হয় ভালো, সবার জন্য অনুসরণীয়। অপরের অধিকার রক্ষা, পিতা-মাতার সঙ্গে সদাচরণ, অন্যকে সংশোধন, উপকারী পরামর্শ, সঠিক চিন্তা, সৎ ও পূর্ণ কাজে পারস্পরিক সহযোগিতা প্রদান, অশ্লীলতা থেকে বারণ, দ্বীনি ও দুনিয়াবি কল্যাণের জন্য উপদেশ দান। আর মূর্খ ব্যক্তির থেকে যখন কোন কষ্টকর বিষয় আসবে তখন আল্লাহর আদেশ অনুসারে এই মূর্খ মানুষদের থেকে দূরে থাকতে হবে। তার মূর্খতার জবাব মূর্খতাপূর্ণ আচরণ দিয়ে না দেওয়ার জন্য আল্লাহতায়ালা নির্দেশ দিয়েছেন। সুতরাং আপনাকে কথায়-কাজে যে কষ্ট দিয়েছে, তাকে আপনি কষ্ট দেবেন না। যে আপনাকে বঞ্চিত করেছে, তাকে আপনি বঞ্চিত করবেন না। আপনার সঙ্গে যে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, তার সঙ্গে আপনি সম্পর্ক অটুট রাখুন। যে আপনার ওপর জুলুম করেছে, তার সঙ্গে আপনি ন্যায় বিচার করুন।
হে আল্লাহর বান্দারা! মানুষের সঙ্গে চলাফেরার ক্ষেত্রে আরেকটি মূলনীতি হচ্ছে মহান আল্লাহতায়ালার বাণী; তিনি বলেন, আমার বান্দাদের বলে দিন, তারা যেন যা উত্তম এমন কথাই বলে। শয়তান তাদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধায়। নিশ্চয় শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু। (সুরা আল ইসরা : ৫৩)। আল্লাহ আমাদের আলোচনা ও কথাবার্তায় সুন্দর শব্দ ও সর্বোত্তম বাক্য ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছেন। যদি আমরা তা না করি, তাহলে শয়তান আমাদের মাঝে শত্রুতা সৃষ্টি করবে, আমাদের খারাপ কথার দ্বারা শয়তান আমাদেরকে অকল্যাণ, ঝগড়া ও লড়াইয়ের দিকে টেনে নেবে।
জীবনের নানান ধাপ
আল্লাহর বান্দারা! মানুষ জীবনে বিভিন্ন ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করে। ব্যস্ততা, দুর্বলতা, ভুলে যাওয়া, অসুস্থতা এবং বার্ধক্যের মতো অনেক কঠিন পরিস্থিতি মানুষের মাঝে বিরাজ করতে পারে; যেগুলো কখনো কখনো তাদের চালচলন ও আচরণে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। সুতরাং তাদের প্রতি সুধারণা পোষণ করুন। নিশ্চিত না হয়ে তাদের বক্তব্যের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। বিশেষত শয়তান যেখানে মানুষে মানুষে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তৎপর থাকে, শয়তান আপনার এবং আপনার ভাইয়ের মাঝে কোনো শত্রুতার জন্ম দিয়ে দেবে, মনে ঢুকিয়ে দেবে বিদ্বেষ এবং এ কারণে আপনি হয়তো তার ব্যাপারে কোনো ধরনের খারাপ ধারণা পোষণ করবেন, যেমন : আপনার কোন দাবি-দাওয়ার ক্ষেত্রে সে হয়তো সুপারিশ করল না, আপনার চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপারে সে হয়তো গুরুত্ব দিল না, আপনার ডাকে হয়তো সে সাড়া দিল না অথবা আপনার অসুস্থতার সময় সে আপনার খোঁজখবর নেয়নি অথবা আপনার কোন কথা বা মেসেজের উত্তর সে দিল না অথবা আপনাকে হয়তো সে তার কোনো বিবাহের অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয়নি অথবা আপনার কোনো এচিভমেন্টে সে শুভেচ্ছা জানায়নি অথবা আপনার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আপনাকে সে সালাম জানায়নি অথবা আপনাকে দেওয়া কোনো প্রতিশ্রুতি সে রক্ষা করেনি অথবা কোনো মজলিসে আপনার প্রতি চোখ পড়া সত্ত্বেও ভালো করে তাকায়নি অথবা আপনার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলেছে যাতে আপনি বিরক্ত হয়েছেন এভাবে আরো নানাভাবে আপনি হয়তো তার প্রতি বিরক্ত বা কষ্ট পেয়েছেন।
মিথ্যা ধারণা বর্জনীয়
ইনসাফ ও দায়মুক্তির ক্ষেত্রে আপনি কখনোই কারো প্রতি মিথ্যা ধারণা পোষণ করবেন না। আর এভাবে খারাপ ধারণার বশবর্তী হয়ে আপনি যদি আপনার কোনো বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে রাগ করেন অথবা দূরত্ব সৃষ্টি করেন তার বাহ্যিক ওই আচরণের কারণে, তাহলে সেটা হবে আপনার জন্য ন্যায়ের পরিপন্থি কাজ, যা আপনার জন্য ক্ষতিকর। তাই আপনি তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলুন অথবা সে যা করেছে তার ব্যাপারে আপনি ব্যাখ্যা জানতে চান, তাহলে আপনার কাছে তার ওজর স্পষ্ট হবে, উদ্দেশ্য প্রকাশিত হবে, পরিষ্কার হবে এবং আপনার মন প্রশান্ত হবে।
ভালো আচরণে শত্রুও বন্ধু হয়
হে আল্লাহর বান্দারা! মানুষের সঙ্গে উত্তম আচরণের ক্ষেত্রে আরেকটি সুন্দর ও গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি হলো, আল্লাহতায়ালার বাণী; আল্লাহ বলেন, ‘সমান নয় ভালো ও মন্দ। জবাবে তাই বলুন যা উৎকৃষ্ট। তখন দেখবেন আপনার সঙ্গে যে ব্যক্তির শুত্রুতা রয়েছে, সে যেন অন্তরঙ্গ বন্ধু।’ (সুরা ফুসসিরাত : ৩৪)। আপনার সহনশীলতার কারণে আপনার সঙ্গে যারা অজ্ঞতাপূর্ণ আচরণ করে, তাদের প্রতিহত করুন। তাদের এই মন্দ আচরণ প্রতিহত করুন ক্ষমা দ্বারা এবং উত্তম আচরণ দ্বারা। অপছন্দনীয় বিষয়গুলোর ওপরে ধৈর্য ধারণ করে আপনার সঙ্গে শত্রুতাপূর্ণ আচরণকারীদের প্রতিহত করুন। কারণ আপনি যদি তাদের মন্দ আচরণে উদারতা দিয়ে তাদের অসদাচরণকে ভালো আচরণ দিয়ে মোকাবিলা করেন, তাহলে তারা তাদের এই মন্দ আচরণ ত্যাগ করে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে যাবে।
রাগ নিয়ন্ত্রণ করা
হে আল্লাহর বান্দারা! এ নিয়মগুলোর মধ্যে একটি নিয়ম হলো, রাগান্বিত ব্যক্তির সঙ্গে আচরণের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা। কারণ সে অধিক রাগ হওয়ার কারণে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং নিজের বিদ্যা-বুদ্ধি ও বিবেককে হেফাজত করতে পারে না। সে এমন কথা বলে, যা সে অনুধাবন করতে পারে না। ইমাম ইবনুল জাওজি রাহিমাহুল্লাহ বলেন, যখন তুমি দেখবে যে তোমার সাথি রাগান্বিত, তখন তার সবকিছুর হিসাব রাখা এবং এর ওপর ভিত্তি করে তাকে পাকড়াও করা উচিত নয়। কারণ তার অবস্থা একজন মাতালের মতো, সে জানে না কী ঘটছে।
বরং তার এই অবস্থায় তুমি ধৈর্য ধারণ কর এবং তার এই আচরণকে অত গুরুত্ব দিও না। কারণ শয়তান তার ওপর বিজয়ী হয়েছে, তার মেজাজ উত্তেজিত হয়েছে, তার আকল-বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। আর তুমি যখন তার এই ভুল আচরণকে গুরুত্বের সঙ্গে মনে ধারণ করবে, তখন তুমি হবে ওই লোকের মতো যে পাগলের মোকাবিলা করে, ওই চেতনাবাজ ব্যক্তির মতো যে অজ্ঞান ব্যক্তিকে তিরস্কার করে। তখন দোষটা তোমারই হবে। তার প্রতি কৃপার দৃষ্টিতে তাকাও এবং জেনে রাখো যে, সে যখন স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসবে, চেতনা ফিরে পাবে, যা ঘটেছে তার জন্য সে লজ্জিত হবে এবং তোমার ধৈর্যের স্বীকৃতি দেবে। আর এ অবস্থা থেকে আমাদের প্রত্যেকেরই শেখা উচিত, জানা উচিত যে, বাবার রাগের সময় থেকে সন্তান শিক্ষা নেবে, বন্ধুর রাগের অবস্থায় বন্ধু তার অবস্থা থেকে শিক্ষা নেবে, স্বামীর রাগের অবস্থায় স্ত্রী সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে। অতএব তুমি তাদের এই অবস্থায় ছেড়ে দাও। তুমি যদি এ অবস্থায় ধৈর্য ধারণ না করে উল্টো কিছু করে বসো, তাহলে সে বিপদ তোমার ঘাড়েই ফিরে আসবে।
(১৯ মে ২০২৩ তারিখে মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন ড. মো. শহীদুল হক)