সেদিন রাতে আকাশে রুপোর থালার মতো ভেসে বেড়াচ্ছিল গোল চাঁদ। আলো বিলি করে যাচ্ছিল নিজস্ব গতিতে। ঝকমক করে ওঠছিল সবুজ তরুলতা। চাঁদের আলোয় ফকফক করে ওঠছিল চরাচর। হজরত উমর শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছেন। ছটফট করছেন। চোখে ঘুম নেই। জ্যোৎস্না ভাসা নৈঃশব্দ্য রাত কেটে যাচ্ছে তার নির্ঘুম। ভীষণ কাতরানিতে রাত গড়িয়ে যাচ্ছে সুবহে সাদিকের দিকে। হঠাৎ উমর একজন অপরিচিত মানুষের খটখট পদধ্বনি শুনতে পেলেন, যিনি জনমানবহীন শূন্য পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে কাবা চত্বরের দিকে। মার্জিতভাব নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন বায়তুল্লাহর দিকে। একেবারে দৃঢ় গতিতে। কোনো তাড়াহুড়ো নেই। হজরত উমর কিছুটা চমকে ওঠেন। হজরত উমরের গভীর দৃষ্টি নিবদ্ধ অপরিচিত আগন্তুক লোকটির দিকে। চেনার জন্য বেশ কিছুসময় কুশেশ চালান। ভালোভাবে তাকাতেই মুহাম্মদ (সা.) এর ঝলঝল বদনখানি তার নজরে পড়ে। তিনি অস্ফুট স্বরে বলে ওঠেন- সে তো আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মদ। সে সময় উমর রাসুল (সা.)-কে তার ঘোরতর শত্রু ভাবতেন। প্রায় বলতেন ‘মক্কার সুশৃঙ্খল সমাজকে বিতর্কিত রূপ দিয়েছে এই মুহাম্মদ। মানুষকে নতুন ধর্মের দিকে ডেকে গোত্রে গোত্রে লাগিয়ে দিয়েছে গৃহযুদ্ধ। বাবা-ছেলের সম্পর্ক গড়িয়েছে শত্রুতায়। স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র সম্পর্ক বিচ্ছেদে রূপ নিয়েছে। আরো বলতেন শুধু এই মুহাম্মদের কারণেই মক্কার ব্যবসা-বাণিজ্য চরম হুমকির মুখে পড়েছে। তাছাড়া, আমাদের বহুদিনের প্রচেষ্টায় বানানো মূর্তি ও দেবদেবীকে সে তুমুল সমালোচনায় বিদ্ধ করছে। আমাদের বাপ-দাদার ধর্মকে চির বাতিল বলে ঘোষণা দিয়েছে। এবং সেগুলোকে অবান্তর ও অকার্যকর বলে প্রমাণ করার চেষ্টায় ব্রত।’ হজরত উমর রাসুল (সা.)-কে দেখে প্রবল রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। যার কারণে যুবসমাজ বাপ-দাদার ধর্মকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। দিন দিন বিভ্রান্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার পরিবারে ফাটল ধরিয়েছে যে লোক; সেই-ই তো সব সমস্যার মূল। ওকে যেহেতু একা পেয়েছি রফাদফা করে দেব আজ। কিছুতেই তাকে ছাড়ব না আজ। আমি হলাম মক্কার সবচেয়ে শক্তিশালী যুবক। আমাকে দমানোর সাধ্য কার! কথাগুলো হজরত উমর বলছেন মনে মনে। হজরত উমর রাসুলের পিছুপিছু ছুটলেন সে রাতে। রাসুল তো কাবায় ঢুকে বুকে ইশকের জোয়ার তুলে মাথা অবনমিত করছেন আল্লাহর কুদরতি পায়। মুখে ইশকে ইলাহির জিকির তুলে সময় পার করছেন। কখনো আবার মহিমান্বিত কোরআন তেলাওয়াতে বিমুগ্ধতা ছড়াচ্ছেন, কোরআন তেলাওয়াত করে যাচ্ছেন মিহি সুরে। তখন উমর রাগে ফেটে পড়ছেন যেন। ইতস্তবোধ করছেন কোরআন তেলাওয়াত শুনবে কী শুনবে না! কিছু সময় পরে হজরত উমরের হৃদয়ে কৌতূহল জন্মালো এবং মনে মনে বলতে লাগলেন ‘শুনেছি এই কোরআন নাকি জাদুচ্ছন্ন করে ফেলে শ্রোতাকে। দেখি আমাকে আকৃষ্ট ও মোহগ্রস্ত করতে পারে কি-না! আমি তো সবচেয়ে কঠোর দিলের লোক। মক্কায় আমার চেয়ে কঠিন হৃদয়ের লোক কে আছে! কোনো জাদুটাদুর আমাকে আকৃষ্ট ও মোহগ্রস্ত কিংবা কাবু করার সাধ্য নেই।’ রাত ততক্ষণে গভীর হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ভোরের দিকে। বলা যায় নৈঃশব্দ্য রাতের শেষ প্রহর। স্পষ্টভাবে মুহাম্মদের মিহি কণ্ঠে সুললিত সুরে কোরআন তেলাওয়াত শোনার জন্য; কাবার কালো গিলাফের আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে শুনছেন মহিমান্বিত কোরআানের আয়াত। রাসুল (সা.) তেলাওয়াত করে যাচ্ছেন একের পর এক। বিরামহীনভাবে। আদ, সামুদ গোত্রের প্রলয়ের কথা বলে যাচ্ছেন আয়াতের সুরে সুরে। কেয়ামতের আলামত ও শিঙ্গায় ফুঁ দেয়ার কথা এবং সুরা আল হাক্কাহয় বর্ণিত শেষের আয়াত পড়ছেন। কোরআনের এই মহিমান্বিত আয়াত ও সুরের লহরিতে বিমোহিত হয়ে পড়েন তিনি। ধীরে ধীরে হৃদয় বিগলিত হতে থাকে। কোরআনের সুরে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার উপক্রম। শ্বাস-প্রশ্বাস তার প্রবলবেগে ওঠানামা করছে। কিছুক্ষণ পর যখন সম্বিত ফিরে আসে, তখন তিনি রাসুলের মোহগ্রস্ততা অস্বীকার করার জন্য বলতে লাগলেন ‘এটা তো একটা কবিতা মাত্র। নিতান্ত কবিতা ছাড়া অন্য কিছু নয়।’ তখনই রাসুলের পবিত্র জবান থেকে উচ্চারিত হতে থাকে সুরা হাক্কাহর একচল্লিশ নম্বর আয়াত। ‘এটা কোনো কবির কালাম নয়; তোমরা কমই বিশ্বাস কর।’ তারপর রাসুলকে জাদুকর ও জ্যোতিষী বলে আখ্যা দেয়। তখনও আবার রাসুল তেলাওয়াত করে যাচ্ছেন নিজ গতিতে। হঠাৎ এলেন ‘এটা কোনো জ্যোতিষীর কথা নয়; তোমরা কমই অনুধাবন কর...।’ (সুরা আল হাক্কাহ)। নিকষ আঁধারের রাত কেটে রঙিন ভোর হলো। লাল টুকটুকে সূর্যমামা তার রঙিন আভা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। ধীরে ধীরে পুরো মক্কা শহর আঁধার কেটে আলোকিত হচ্ছে। হজরত উমর গত রাতের স্মৃতি আর মুগ্ধময় বিহ্বলতা মন থেকে কিছুতেই মুছতে পারছেন না। গত রাতের ঘটনা তার হৃদয়ে ভীষণ দাগ কাটে। তাই ক্রমশ তার মন থেকে কুফুরির কালিমা ও আঁধার কেটে যাচ্ছে। ঈমানের চেতনায় একটি মন আন্দোলিত হওয়ার অপেক্ষায়। প্রকট দ্বিধাদ্বন্দ্বগুলো কেটে যাচ্ছে। সত্যের তাড়ায় উদ্ভাসিত হচ্ছে যেন তার উন্মুখ হৃদয়। তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে যেন বর্ষিত হবে শাশ্বত ঈমানের বারিধারা।
উমরের দিলের খানিকটা পরিবর্তন হলেও রাগে-জিদে বলল, ‘এই মুহাম্মদের কোরআন তেলাওয়াত শুনে আমাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে? আমার বাপ-দাদার ধর্মকে চির বাতিল করে মুহাম্মদের আনীত ধর্মের দিকে আমার ধাবিত হতে হবে? আর যদি আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেও ফেলি আমাকে মানুষ কী বলবে? নিশ্চয়ই অকৃতজ্ঞ বলবে।’ মনের ভেতরের বিগলিত ভাব ধামাচাপা দিয়ে ইসলামের প্রতি নির্গত ভালোবাসা লুকিয়ে অগ্নিশর্মা হয়ে পড়েন মুহাম্মদ (সা.)-এর বিরুদ্ধে। চেহারায় রাগের উন্মত্ততা ছড়িয়ে হেঁটে চলছে উমর। এই দৃঢ়তা নিয়ে বের হলো, মুহাম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে আজই তার শেষ হিসাবনিকাশ। মুহাম্মদের জীবন লীলা শেষ করে দেওয়াই আজ তার মূল লক্ষ্য। রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে তরবারিখানি উন্মুক্ত করে সর্বপ্রথম গেলেন সাহাবি আবু নুয়াইমের বাড়ি। আর আবু নুয়াইম ছিল তার চাচাতো ভাই। দরজায় কড়া নাড়তেই ঘর থেকে বেরিয়ে আসে আবু নুয়াইম। উমরের চেহারা যেন রাগে ফেটে পড়ছে। আগুনের ফুলকির মতো ঝরে পড়ছে যেনো রাগ। চেহারায় দৃঢ়তার ছাপ দেখে আবু নুয়াইম বলল, ‘তরবারি উন্মুক্ত করে কোথায় যাচ্ছ উমর?’ উমর রাগে মেশানো দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘মুহাম্মদের সঙ্গে তার জীবনের সুরাহা করতে যাচ্ছি। আমাদের বাপ-দাদার ধর্মকে প্রশ্নবিদ্ধ আর হেয় করার মতো চরম অপরাধ করায় তাকে হত্যা করতে বের হয়েছি। তার মুখ চিরতরে বন্ধ করে দেওয়ার জন্য বেরিয়েছি।’ উমরের এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আবু নুয়াইমের মাথায় যেন সাত আসমান ভেঙে পড়েছে। উমরের এমন রাগত ভাব দেখে আবু নুয়াইমের গলা শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে গেছে। উমরকে শান্তস্থির করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কোনো ফলপ্রসূ হচ্ছে না তার কুশেশ। সবকিছুই ব্যর্থ প্রমাণ করে দিচ্ছে রাগী উমর। শেষমেশ আবু নুয়াইম একটা বুদ্ধি বের করল; উমরের আপন বোন ফাতেমা আর তার ভগ্নিপতি ইসলাম গ্রহণের কথা বললে হয়তো উমর কিছুটা শান্ত হবে। তার মধ্যে ঠান্ডাভাব চলে আসবে। কিন্তু ফলাফল দাঁড়াল উল্টো। যখন উমর শুনল তার বোন আর ভগ্নিপতির ইসলাম গ্রহণের কথা, তখন তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে উমর। প্রচণ্ড রাগে পথ ধরে তার বোনের বাসার দিকে। ওইদিকে ফাতেমা আর তার ভগ্নিপতিকে সর্বশেষ অবতীর্ণ হওয়া আয়াতগুলোকে হজরত খাব্বাব (রা.) শেখাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর দরজায় ঠকঠক কড়া নাড়ে উমর। বিস্মিত কণ্ঠে ফাতেমা জিজ্ঞেস করলেন, ‘দরজার সামনে কে?’ উত্তর দেওয়ার আগেই ফাতেমা বুঝে গেলেন উমরের আগমনের ব্যাপারে। দরজা খুলে দেখেন উন্মুক্ত তরবারি ঝুলানো উমরের কাঁধে। চেহারায় রাগের স্পষ্ট ছাপ দেখা যাচ্ছে। উমর রাগতস্বরে যখন বললেন, ‘তোমরা কী পড়ছিলে?’ তখন ফাতেমা আর সাঈদ পরস্পরে চাওয়াচাওয়ি করছেন। ফাতেমা কোরআন পাঠের কথা গোপন করার ইচ্ছে পোষণ করলেও সাঈদ আগ বেড়ে মুখ খুললেন। সত্য প্রকাশে বিলম্ব করেননি। সত্য ঘটনা শোনার সঙ্গে সঙ্গে উমর বাজপাখির মতো ত্বরিত গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভগ্নিপতি সাঈদের ওপর। তার জামার কলার ধরে একের পর এক প্রহার করতে থাকে। এক পর্যায়ে মাটিতে ধসে পড়ায় তার গলার ওপর চড়ে বসে উমর। রাগের ক্ষিপ্রতা যখন কিছুতেই কমছে না, ফাতেমা যখন ভালোবাসার টানে স্বামীকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে, তাকেও প্রহার করতে উমর দ্বিধাবোধ করেনি। আঘাতের এক পর্যায়ে ফাতেমা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা দেন ইসলাম পরিত্যাগ না করার। ফাতেমার দৃপ্ত কণ্ঠের ঘোষণা অনেকটাই উমরকে অভিভূত করে। রাগ কিছুটা থেমে যায়। প্রচণ্ড রাগে ক্রুদ্ধ উমর যেন নিমিষেই নিস্তেজ হয়ে গেছে। তার তৃষ্ণার্ত বুক হাহাকার করে উঠছে যেন ইসলামের সুধা পানের তাড়নায়। সত্য গ্রহণের নেশায় ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন। চেতনায় বিশুদ্ধ বিশ্বাসের তাড়নায় মরিয়া হয়ে উঠেছেন। তার বোন ফাতেমাকে বললেন, আমি সত্য পথে দীক্ষিত হবো। মানবতা বাঁচানোর তাগিদে আমি ইসলামে দাখিল হবো। প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণের ঘোষণা দিয়ে মক্কার কাফের সম্প্রদায়কে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় বানিয়ে দেব। নিজের অপরাধের শাস্তিস্বরূপ আমি মেনে নেব আল্লাহতায়ালা এক আর মুহাম্মদ (সা.) তাঁর নবী ও রাসুল। তখন রাসুল দারুল আরকামে উপবিষ্ট। তার জানবাজ একদল সাহাবিকে সদ্য নাজিল হওয়া একটি সুরা তেলাওয়াতে মগ্ন। উমর রওয়ানা দেয় দারুল আরকামের দিকে। রাসুলের হাতে নিজের জীবন সঁপে দিতে। দরজায় দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিল তখন হামজা আর তালহার মতো বীর সাহাবিদ্বয়। অদূর থেকে শুনা যাচ্ছিল উমরের পদধ্বনি। উমর দরজায় এসে কড়া নাড়ে। উমরের পায়ের খটখট আওয়াজ শুনেই ভেতরের লোকেরা বুঝতে পেরেছিল হয়তো উমর এসেছে! তবুও তারা জিজ্ঞেস করল ‘কে ওখানে?’ শান্ত গলায় জবাব ‘আমি উমর বিন খাত্তাব।’ সবাই চমকে ওঠেন খানিকটা। দ্বিধায় পড়ে যান তারা দরজ খুলবেন কি-না! অবশেষে দরজা খুলে দেওয়া হলো তার জন্য। ভেতরে প্রবেশ করতেই উমরের শরীর তিরতির করে কেঁপে উঠছে লাউয়ের ডগার মতো। ঘাম বইছে শরীর থেকে। সিংহতুল্য উমর যেন নিমিষেই নিস্তেজ। বরফগলা নদীর মতো ঠান্ডা হয়ে গেছেন। ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন রাসুলের সামনে। বুকে যেন এক পাহাড় তৃষ্ণা হাহাকার করে উঠছে। চোখণ্ডমুখ থেকেও যেন ভীষণ তৃষ্ণা অনুমান করা যাচ্ছে। রাসুল উমরের দিকে এগিয়ে আসেন। ‘উমর, ফিরে এসো’ বলতেই উমর বিড়বিড় করে বলতে লাগল ‘আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করব।’ উমরের এমন কথা শুনে সবাই স্তম্ভিত হলেন ভীষণ বিস্ময়ে। উমর (রা.) কালেমা পাঠ করে মুসলমান হলেন। এ ঘটনায় আনন্দণ্ডবিস্ময়ে মুহূর্তের মধ্যে চারপাশ ছেয়ে যায় পিনপতন নীরবতায়।
(সূত্র : কাশফুল আসতার ৩/১৬৯, তাবাকাতে কুবরা ৩/২৬৭, আসসিরাতুন নাবাবিয়্যাহ আল্লামা ইবনে কাসির রহ.)