মানুষের সেবা করা, মানবপ্রেম এমন এক আমল, যা দ্বারা আল্লাহর প্রিয় হওয়া যায়। কেননা, সব সৃষ্টি আল্লাহর পরিবার। সুতরাং সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক প্রিয়, যে আল্লাহর পরিবারের প্রতি অনুগ্রহ করে। যারা সৃষ্টিকে ভালোবাসে, সৃষ্টির সেবা করে, তারাই আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় বান্দা। আর যারা আল্লাহর প্রিয়পাত্র, তাদের নাজাত পেতে কোনো বেগ পেতে হবে না। যখন নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদি ইবাদত পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব দিয়ে পার হওয়া কঠিন হবে, তখন বিভিন্ন আমল নাজাতের উসিলা হবে। এর ভেতর এ সৃষ্টিসেবাও এক বিশেষ আমল; যা দ্বারা আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়া যায়; যা মানুষের মুক্তির অসিলা হবে। আল্লাহর প্রিয় হতে হলে মানুষকে ভালোবাসতে হবে। আল্লাহর ভালোবাসা পেতে হলে মানুষকে ভালোবাসা দিতে হবে। আল্লাহর প্রেম অর্জন করতে হলে মানুষের প্রতি, সৃষ্টির প্রতি প্রেম নিবেদন করা চাই। এখানে মানুষকে প্রেম করার অর্থ যৌন সুড়সুড়িমূলক প্রেম নয়, বরং মানুষের প্রতি সহানুভূতি, তাদের কল্যাণের চিন্তা, কাজকর্মের মাধ্যমে তাদের প্রতি ভালোবাসার পরিচয় দেয়া। আর মানবসেবা বলতে অভাবীর অভাব দূর করা, গরিব-অসহায় মানুষের অন্ন-বস্ত্র দান করা, অসহায়ের পাশে দাঁড়ানো, রোগ-ব্যাধিতে সেবা করা, দুর্গত মানুষদের ত্রাণসামগ্রী দান করা, মজলুমের ফরিয়াদে সাড়া দেয়া ইত্যাদি বোঝায়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যতক্ষণ একজন মানুষ অন্য কোনো মানুষের সহযোগিতায় নিয়োজিত থাকে, ততক্ষণ মহান আল্লাহ তার সহযোগিতায় থাকেন।’ (মুসলিম : ২৬৯৯)। রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘এক ব্যক্তি রাস্তায় চলতে চলতে একটি কাঁটাযুক্ত ডাল দেখতে পেয়ে সরিয়ে দিল। আল্লাহ তার এ কাজ কবুল করেন। তাকে ক্ষমা করে দেন।’ (বোখারি : ৬৫২)।
মানবপ্রেম ঈমানের অংশ
মুক্তির নিয়তে মানবসেবা নয়, বরং ইসলামের ফরজ হিসেবে করা চাই। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত ইত্যাদি যেমন শরিয়তে ফরজ, মানবসেবাও ফরজ। এ ফরজ আদায়ের নিয়তে মানবসেবা করতে হবে। যার সম্পদ আছে, সে সম্পদ দিয়ে মানুষের সেবা করবে। যার বুদ্ধি আছে, সে বুদ্ধি দিয়ে মানুষের সেবা করবে। যার শক্তি আছে, সে শক্তি দিয়ে মানুষের সেবা করবে। যার যতটুকু সাধ্য, সেভাবে সে মানুষের সেবা করবে। মানবপ্রেম ও মানবসেবার বিষয়টি এত খাটো করে দেখার বিষয় নয়, বরং অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি ইসলামে মানবপ্রেমকে ঈমানের অঙ্গ বলা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ পূর্ণাঙ্গ মোমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ সে অন্য মুসলমানের জন্য তা ভালো না বাসবে, যা নিজের জন্য ভালোবাসে।’ (বোখারি : ১৩)। এ বর্ণনা দ্বারা বোঝা গেল, নিজের জন্য আমরা যা ভালোবাসি, আরেক মুসলমান ভাইয়ের জন্যও সেরকমটা ভালোবাসতে হবে। নিজের জন্য যেমন চাই, অপরের জন্য যদি সেটা না চাই, তাহলে আমাদের ঈমান পূর্ণাঙ্গ হবে না। এমনকি মানবপ্রেম জান্নাতি হওয়ার লক্ষণ। জান্নাতিদের আলোচনায় আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা আল্লাহর প্রেমে অভাবগ্রস্ত, এতিম ও বন্দিকে আহার্য দান করে। তারা বলে, শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা তোমাদের আহার দান করি এবং তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না।’ (সুরা দাহর : ৮-৯)।
দয়াকারীর ওপর আল্লাহ দয়া করেন
মানুষ নিজের জন্য কামনা করে, তার উন্নতি হোক, তার ধন-সম্পদ হোক, তার সুখণ্ডশান্তি হোক, তার ছেলে-মেয়েরা প্রতিষ্ঠিত হোক, তার ছেলে-মেয়েদের ভালো ঘরে বিয়ে হোক। প্রত্যেকে চায়, আমি যেন ভালো চাকরি পাই, আমি যেন ভালো পদ পাই, আমি যেন ইজ্জত-সম্মান পাই ইত্যাদি। আমরা প্রত্যেকে নিজের জন্য এগুলো ভালোবাসি। অতএব, অন্যের জন্যও এগুলো ভালোবাসতে হবে। আমি নিজের জন্য বিপদাপদ চাই না। তাই অন্যের জন্যও বিপদাপদ চাইতে পারব না। নিজের জন্য নিরাপত্তা চাই। তাই অন্যের জন্যও নিরাপত্তা চাইতে হবে। আমার মঙ্গল ও কল্যাণের জন্য যেমন চেষ্টা করি, অন্যের জন্যও তেমন চেষ্টা করতে হবে। আমার কামনা হলো, অনাহারে যেন না থাকি। অতএব, অন্যের জন্যও তা চাইতে হবে। এক কথায়, সবাইকে নিজের মতো করে দেখতে হবে। সবার জন্য নিজের মতো করে চাইতে হবে। সবাইকে নিজের মতো করে ভাবতে হবে। ইসলামের দৃষ্টিতে এটা অনেক বড় ব্যাপার। এমনকি একে ইসলামের অঙ্গ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এমন না হতে পারলে আমরা মোমিন নই। রাসুল (সা.) বলেন, ‘দয়াময় আল্লাহ দয়ালুদের দয়া করেন। তোমরা জমিনবাসীদের ওপর দয়া কর, তাহলে মহান আল্লাহ তোমাদের ওপর দয়া করবেন।’ (তিরমিজি : ১৯২৪)। রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি এতিমণ্ডঅনাথের রক্ষণাবেক্ষণ বা লালন-পালন করে, সে আমার সঙ্গে পাশাপাশি জান্নাতে থাকবে।’ এ কথা বলে তিনি মধ্যমা ও তর্জনী আঙুল পাশাপাশি রেখে দেখান। (তিরমিজি : ১৯১৮)।
সৃষ্টির প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ানো
মানবসেবার কথা এত শক্ত করে আর কোনো ধর্মে বলা হয়নি। অতএব, ইসলাম ধর্মেই মানবপ্রেমের কথা এবং মানবসেবার কথা বেশি বলা হয়েছে। আমরা পুরোপুরি করতে পারি না বা করি না, সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু ইসলামে বলা হয়েছে। আমলে না থাকলে সেটা ইসলামের দোষ নয়, বরং আমাদের দোষ। মানবপ্রেম ও মানবসেবা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি অনেক ফজিলতের কাজ। মানবসেবার একটি ফজিলত হলো, মানবসেবা দ্বারা আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজাত লাভ করা যায়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ শুধু তার আমল দ্বারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (মুসনাদে আহমদ : ৭৪৭৯)। নেক আমলের পাশাপাশি আল্লাহর রহমত থাকলেই নাজাত পাওয়া যাবে। আল্লাহর রহমত লাভের সবচেয়ে সহজ পথ হলো, তাঁর সৃষ্টির প্রতি সহযোগিতা ও উপকারের হাত বাড়িয়ে দেয়া। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর কাছে সেই ব্যক্তি সবচেয়ে প্রিয়, যে মানুষের বেশি উপকার করে। তাঁর কাছে সবচেয়ে প্রিয় নেক আমল হলো, কোনো মুসলমানের হৃদয়ে আনন্দ দেয়া, তার বিপদণ্ডকষ্ট দূর করা, তার ঋণ পরিশোধ করে দেয়া, তার ক্ষুধা দূর করা।’ (মাজমাউয যাওয়ায়েদ : ৮/১৯১)।
যাদের সেবায় আল্লাহর সেবা
রাসুল (সা.) বলেন, কেয়ামতের দিন মহান আল্লাহ বলবেন, ‘হে আদম সন্তান, আমি অসুস্থ হয়েছিলাম; কিন্তু তুমি আমাকে দেখতে যাওনি!’ সে বলবে, ‘হে রব, আপনি তো রাব্বুল আলামিন। আমি কীভাবে আপনাকে দেখতে যাব?’ তিনি বলবেন, ‘তুমি তো জেনেছিলে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ হয়েছিল। তবু তুমি তাকে দেখতে যাওনি। তুমি কি জানতে না, তুমি যদি তাকে দেখতে যেতে, তাহলে আমাকে তার কাছে পেতে।’ এর পর বলবেন, ‘হে আদম সন্তান, আমি তোমার কাছে খাদ্য চেয়েছিলাম; কিন্তু তুমি আমাকে খাদ্য দাওনি।’ সে বলবে, ‘হে রব, আপনি তো রাব্বুল আলামিন। আমি কীভাবে আপনাকে খাদ্য দেব?’ তিনি বলবেন, ‘তুমি তো জেনেছিলে, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাদ্য চেয়েছিল। কিন্তু তুমি তাকে খাদ্য দাওনি। তুমি কি জানতে না, তুমি যদি তাকে খাদ্য দিতে, তাহলে আমাকে তার কাছে পেতে!’ এর পর আল্লাহতায়ালা বলবেন, ‘হে আদম সন্তান, আমি তোমার কাছে পানি পান করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আমাকে পানি দাওনি।’ সে বলবে, ‘হে রব, আপনি তো রাব্বুল আলামিন। আমি কীভাবে আপনাকে পানি পান করতে দেব?’ তিনি বলবেন, ‘তুমি তো জেনেছিলে, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানি পান করতে চেয়েছিল। কিন্তু তুমি তাকে পানি দাওনি। তুমি কি জানতে না, তুমি যদি তাকে পানি পান করতে দিতে, তাহলে আমাকে তার কাছে পেতে!’ (মুসলিম : ২৫৬৯)।
মানবসেবা নবীজির বিশেষ গুণ
সুরা আলাকের প্রথম পাঁচ আয়াত নাজিল হলে রাসুল (সা.) ভয় পেয়ে যান। তার প্রতি এটিই ছিল প্রথম ওহি নাজিলের ঘটনা। উম্মুল মুমিনিন খাদিজা (রা.)-এর কাছে ফিরে এসে তিনি বললেন, ‘আমি নিজের ব্যাপারে শঙ্কা বোধ করছি।’ খাদিজা (রা.) বললেন, ‘আল্লাহর কসম, কখনও নয়। আল্লাহ আপনাকে কখনও অপমানিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করেন, অসহায়-দুর্বলের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সাহায্য করেন, মেহমানের মেহমানদারি করেন এবং দুর্দশাগ্রস্তকে সাহায্য করেন।’ (বোখারি : ৩)।
মানবসেবার অপার প্রতিদান
রাসুল (সা.) বলেন, ‘মানবকল্যাণমুখী কাজ বিপদাপদ ও অপমৃত্যু থেকে রক্ষা করে। গোপন দান আল্লাহর ক্রোধ নির্বাপিত করে। রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষায় আয়ু বৃদ্ধি পায়।’ (মাজমাউয যাওয়ায়েদ : ৩/১১৫)। রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘দুজন মানুষের মধ্যে বিবাদ মিটিয়ে ন্যায়-সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করাকে দান বলে। কোনো মানুষকে তার বাহন পরিচালনা করতে সাহায্য করা দান বলে গণ্য। কারও বাহনে তার জিনিসপত্র তুলে দেয়া দান বলে গণ্য। সুন্দর আনন্দদায়ক কথা দান বলে গণ্য। মসজিদে গমনের জন্য প্রতিটি পদক্ষেপ দান বলে গণ্য। রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক দ্রব্য সরিয়ে দেয়া দান বলে গণ্য।’ (বোখারি : ২৯৮৯)। এমনকি যে কোনো জীবজন্তুর সেবাতেই সওয়াব রয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে কোনো প্রাণের সেবাতেই তোমরা সওয়াব পাবে।’ (বোখারি : ২৩৬৩)।