মানুষ কান্না পছন্দ করে না। কারও বিকৃত চেহারা দেখতে ভালোবাসে না। কারণ, কান্নার সময় মানুষের চেহারার রূপ বদলে যায়। তাই কারও সহ্য হয় না। তবে যদি সেই কান্না, সেই অশ্রু ঝরানো হয় আল্লাহর ভয়ে, আখেরাতের চিন্তায়, পরকালের ভাবনায়, নামাজের মুসাল্লায়, শেষ রাতের মোনাজাতে, তাহলে তা আল্লাহর কাছে ও লোকসমাজে প্রশংসিত হয়। যে চোখ আল্লাহর ভয়ে কাঁদে, তা জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে না। পৃথিবীতে যারাই বড় হয়েছেন, আল্লাহর প্রিয়পাত্র হয়েছেন, কেঁদেই হয়েছেন। বড়রা অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, ‘তাহাজ্জুদ আর শেষ রাতের রোনাজারি ছাড়া কেউই আল্লাহর অলি হতে পারে না।’ কিন্তু দুনিয়ার রং-তামাশায় বিভোর হয়ে হাসি আমাদের নিত্যসঙ্গী হলেও কান্না যেন ভুলেই গেছি। মনেই পড়ে না, সর্বশেষ কখন কেঁদেছিলাম। অথচ আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা যেন কম হাসে এবং বেশি করে কাঁদে।’ (সুরা তওবা : ৮২)।
আগুন স্পর্শ করবে না যে চোখ
আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে কাঁদে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ না (স্তন থেকে নির্গত) দুধ স্তনে ফেরে এবং আল্লাহর রাস্তার ধুলো আর জাহান্নামের ধোঁয়া একত্রিত না হয়।’ (তিরমিজি : ২৩১১)। রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা কেয়ামত দিবসে সাত শ্রেণির লোককে আরশের নিচে জায়গা দেবেন। তাদের অন্যতম ওই ব্যক্তি, যে নীরবে-নিভৃতে আল্লাহর স্মরণ করে, ফলে তার চোখ দুটি অশ্রু বর্ষণ করে।’ (বোখারি : ১/২৩৪)। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘দুটি চোখকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না- ১. যে চোখ আল্লাহর ভয়ে কাঁদে, ২. যে চোখ আল্লাহর রাস্তায় পাহারাদারিতে (মুসলমানদের জানমাল ও সীমান্ত নিরাপত্তায়) বিনিদ্র রজনী যাপন করে।’ (মুসলিম : ২/৭১৫)।
কান্না অভিব্যক্তির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ
কান্না স্বতন্ত্র কোনো কাজ নয়। কান্না হলো, হৃদয়ের অভিব্যক্তির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। যুগে যুগে আল্লাহর প্রিয় নবী-রাসুলরা কেঁদেছেন। কেঁদেছেন উম্মতের মনীষী। সাহাবা, তাবেয়ি, তাবেতাবেয়ি ও আকাবিরও কেঁদেছেন। সাবেত আল বুনানি (রহ.)-এর চোখের জ্যোতি ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তারের কাছে পরামর্শ চাওয়া হলো। ডাক্তার অধিক কান্নার কথা জানতে পেরে পরামর্শ দিলেন, কান্না বন্ধ করতে হবে; তাহলেই চোখ ঠিক হয়ে যাবে। উত্তরে তিনি বললেন, ‘এমন চোখ দিয়ে আমার কী লাভ, যে চোখে কান্না নেই!’ আল্লাহর আরেক আশেক উসাইদ আয যাব্বি (রহ.) কেঁদে কেঁদে চোখের জ্যোতি হারিয়েছেন। প্রিয়জনরা কান্না কমিয়ে দিতে বলায় তিনি উত্তর দিলেন, ‘কেন? কেন আমি কান্না কমিয়ে দেব! জাহান্নাম থেকে মুক্তির নিশ্চিয়তা কি আমি পেয়ে গেছি?’ এমনই ছিলেন তারা!
অশ্রু মোমিনের সান্ত্বনা
অশ্রু হৃদয়ের প্রশান্তি। অশ্রুতে আছে মুক্তি; হোক তা মাছির পোকা পরিমাণ। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর (আজাবের) ভয়ে যে মোমিন বান্দার দুই চোখ থেকে অশ্রু বের হয়, যদিও তা মাছির মাথা পরিমাণ হয়; এরপর তার চেহারায় কিছু গড়িয়ে পড়ে, আল্লাহ তার জন্য জাহান্নাম হারাম করে দেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪১৯৭)। ভয় ও কান্না একটি আরেকটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বস্তুত যখন কারোর অন্তরে ভয় ঢোকে, তখন আপনাআপনিই কান্না আসে। অশ্রুই বলে দেয় তার অন্তরে ভীতির সঞ্চার হয়েছে। আল্লাহর নেকবান্দাদের মধ্যে এটি বিদ্যমান থাকে। পক্ষান্তরে পাপিষ্ঠ ফাসেকের অন্তরে তা পরিলক্ষিত হয় না। আল্লাহর ভয়ে কাঁদা ও ভীত থাকা প্রকৃত ঈমানদারের একটি মহৎগুণ ও বৈশিষ্ট্য। আমাদের বেশি করে কাঁদা ও কম হাসা উচিত। অনুতাপের অশ্রু ঝরিয়ে জীবনের সব পাপ থেকে মুক্তি লাভ করা চাই।
কাঁদি বেশি, হাসি কম
একটি শিশু কান্না ছাড়া কিছুই বোঝে না। কিছুই করতে পারে না। একেবারে অসহায়। কিন্তু এই কান্নাস্ত্র দিয়েই মা-বাবার কাছ থেকে অনেক কিছু আদায় করে নেয়। আমরা যদি শৈশবের সেই কান্নাটা ধরে রাখতে পারতাম, আল্লাহর দিকে মুতাওয়াজ্জাহ হতে পারতাম, সব শেকায়েত আল্লাহকেই বলতাম, গোনাহমুক্ত জীবনের অঙ্গীকার করতে পারতাম, তাহলে জীবনের চড়াই-উতরাইয়ে অনেক সমস্যার সমাধান পেয়ে যেতাম। ফজিলতময় শবেবরাত ও অপার মহিমার রমজান সমাগত। রহমতের বারিধারায় ঈমানি বসন্তে স্নাত হই। মাগফিরাতের জন্য কাঁদি। তেলাওয়াতে কাঁদি। কান্না না এলে ভান করি। এমন হৃদয় থেকে পানাহ চাই, যাতে আল্লাহর ভয় নেই। এমন চোখ থেকে পানাহ চাই, যে চোখ আল্লাহর ভয়ে কাঁদে না। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘সেই মহান সত্তার কসম, (আখেরাতের ভয়াবহতা সম্পর্কে) আমি যা জানি, যদি তোমরা তা জানতে, তাহলে বেশি করে কাঁদতে এবং কম করে হাসতে।’ (বোখারি : ৬৪৮৫, মুসলিম : ১/৯০১)।