সাহাবিদের নবীপ্রেম
শাহাদাত হোসাইন
প্রকাশ : ২০ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সাহাবিরা উম্মতের শ্রেষ্ঠ সন্তান। তারা নবীজিকে যতটা ভালোবেসেছেন, অন্য কেউ ততটা ভালোবাসতে পারেনি। সাহাবিদের হৃদয় নবীপ্রেমে টইটম্বুর ছিল। তারা সর্বদা নবীপ্রেমে জীবন বিলিয়ে দিতে, উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিলেন। ছিলেন নবীপ্রেমে লীন হওয়ার সুযোগ সন্ধানী। ইতিহাসের পাঠকমাত্রই জানেন, সাহাবিরা নবীপ্রেমে কতটা নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন। নবীপ্রেম ব্যতীত পূর্ণাঙ্গ মোমিন হওয়া সম্ভব নয়। নবী (সা.) বলেছেন, তোমাদের কেউ পূর্ণাঙ্গ মোমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে স্বীয় পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি এবং অন্য সব মানুষ অপেক্ষা অধিক প্রিয় হই (বোখারি : ১৫)। নবী প্রেমিক হতে হলে সবকিছু থেকে বেশি ভালোবাসতে হবে নবী (সা.)-কে।
নবীপ্রেমে আত্মোৎসর্গিত আলী (রা.)
মদিনায় হিজরতের সূচনাপর্বে মক্কার কাফেররা যখন নবীজিকে হত্যা করতে বদ্ধপরিকর। নবীজির হত্যা করতে সবাই সমবেত হয়েছে নবী-বাড়ির চারপাশে। নবীজি তাদের ভ্রমে রাখতে নিজ বিছানায় আলীকে শুয়ে থাকতে বললেন। যাতে তারা বুঝতে পারে তিনি বিছানায় রয়েছেন। রক্তখেকো হায়েনার দল উন্মুক্ত তরবারি নিয়ে দণ্ডায়মান। কিছুক্ষণের মধ্যেই হামলে পড়বে নবীজির ওপর। হত্যা করবে বিছানায় শায়িত ব্যক্তিকে। তাই, এই বিছানায় শায়িত ব্যক্তি নিরাপদ নয়। সব কিছু জানা সত্ত্বেও নবীপ্রেমিক আলী জীবনের মায়া ত্যাগ করে, নবীপ্রেমের মূর্ত প্রতীক হয়ে, ভয়-ডরহীনভাবে নবীর আদেশ পালন করলেন। শুয়ে পড়লেন নবীজির বিছানায়। (আল-বেদায়া ওয়ান-নেহায়া : ৩:৩২৩)। আলী (রা.) এর এই ঘটনা আমাদের শিক্ষা দেয় যে, কোনো ধরনের চিন্তা-ভাবনা ছাড়া রাসুলের আদেশ পালন করা প্রত্যেক মোমিনের জন্য অবশ্য কর্তব্য। এমন লোকদের ব্যাপারে কোরআনে এসেছে, আর মানুষের মাঝে এক শ্রেণির লোক আছে, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জীবন বাজি রাখেন। (সুরা বাকারা : ২০৭)।
নবীর হেফাজতে ব্যাকুল আবু বকর (রা.)
নবীর প্রতি সাহাবিদের ভালোবাসায় কোনো ধরনের কৃত্রিমতা ছিল না। তারা একনিষ্ঠভাবে ভালোবাসতেন নবীকে। নবীজির কষ্ট লাঘবে প্রস্তুত থাকতেন সদা-সর্বদা। হিজরতের রাতে নবীজি এবং আবু বকর সাওর পর্বতের গুহামুখে পৌঁছলেন। গুহাটি পরিত্যক্ত হওয়ায় সেখানে বিষাক্ত কীট থাকার আশঙ্কা ছিল। নবীজি যেন কষ্ট না পান, সেজন্য আবু বকর নবীজিকে বাইরে রেখে নিজে আগে গুহায় প্রবেশ করেন এবং তা পরিষ্কার করে কাপড়ের টুকরা দ্বারা গুহা অভ্যন্তরের সব ছিদ্র বন্ধ করেন। কিন্তু কাপড় ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে একটি ছিদ্র উন্মুক্ত থেকে যায়। গুহায় প্রবেশের পর নবীজি আবু বকরের রানে মাথা রেখে শুয়ে পড়েন। আবু বকর পায়ের আঙুল দ্বারা উক্ত ছিদ্রটি বন্ধ করে রাখেন। সে ছিদ্র তথা গর্তে একটি সাপ ছিল। বের হওয়ার রাস্তা বন্ধ পাওয়ায় আবু বকরের (রা.) আঙুলে দংশন করে। বিষ-ব্যথায় কুঁকড়ে যান তিনি। রাসুল (সা.)-এর আরাম নষ্ট হবে ভয়ে কোনো শব্দ করেননি। কিন্তু ব্যথার তীব্রতায় চোখের পানি রাসুলের চেহারায় পড়ে। ঘুম ভাঙে নবীজির। জিজ্ঞাসা করেন, কী হয়েছে আবু বকর? তিনি বলেন, বিষাক্ত কোনো সাপে কেটেছে। তখন নবীজি নিজের মুখের সামান্য লালা দংশিত স্থানে লাগিয়ে দেন। ফলে আবু বকর (রা.) সুস্থ হয়ে যান। (নুরের পর্বত থেকে সবুজ গম্বুজ : ২০০)। এটাই আবু বকরের নবীপ্রেম। নিজে সর্প-বিষে জ্বলবেন; কিন্তু নবীর ঘুম ভাঙতে দেবেন না। নিজে কষ্ট সইবেন; কিন্তু নবীকে কষ্ট পেতে দেবেন না। তরবারির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হতে প্রস্তুত; কিন্তু নবীর গায়ে ফুলের আঘাত সইতে প্রস্তুত নন। এমন লোকদের ব্যাপারেই কোরআনে এসেছে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট। (সুরা তাওবা : ১০০)।
যিয়াদ ইবনে সাকান (রা.)-এর নবীপ্রেম
ওহুদ যুদ্ধের এক পর্যায়ে নবীজিকে হত্যা করতে কাফেররা একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নবীজি আওয়াজ দিলেন, কে আছ? যে আমার জন্য জীবন বিলিয়ে দেবে? তার এই আওয়াজে যিয়াদ ইবনে সাকান তার পাঁচজন সঙ্গীসহ দাঁড়িয়ে যান। রাসুলকে রক্ষা করতে একে একে সবাই শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন। সর্বশেষ ব্যক্তি যিয়াদ তরবারি আর বর্ষার আঘাতে জর্জরিত হওয়া পর্যন্ত লড়তে থাকেন। জীবনের শেষ রক্তবিন্দু বিলিয়ে দিয়ে হেফাজত করেন নবীকে। (সিরাতে ইবনে হিশাম : ৩:৬০)। নবীকে যুদ্ধের ময়দানে শত্রুদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে গিয়ে তালহা (রা.) সেদিন কাফেরদের নিক্ষিপ্ত সত্তরের অধিক তির, বর্শা আর তরবারির আঘাত সহ্য করেছিলেন। (আল-বিদায়া : ৪:৬৩)।
রাসুল রক্ষার ঢাল আবু দুজানা (রা.)
আবু দুজানা (রা.)। কাফেরদের তিরবৃষ্টি থেকে রাসুলকে বাঁচাতে ঢাল হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে যান। ঝাঁকে ঝাঁকে তীর বর্ষিত হয়। শত তিরের আঘাত হারাতে পারেনি এই নবীপ্রেমীকে। এ অবস্থায়ও রাসুলের ওপর উপুড় হয়ে সুরক্ষা দিয়েছেন রাসুলকে। রাসুলকে বাঁচাতে তার পিঠ চালুনির মতো ছিদ্রযুক্ত হয়ে যায়। (নবীয়ে রহমত : ২৫২)। সাহাবিরা প্রয়োজনে জীবন বিলিয়ে হলেও নবী (সা.)-কে রক্ষা করেছেন শত্রুর আক্রমণ থেকে। হায় আমাদের অবস্থা! পিতার অপমান সহ্য হয় না। প্রতিবাদণ্ডপ্রতিরোধে গর্জে উঠি। অথচ নবীর অপমান সয়ে যাই অবলীলায়! তাই নিজেকে ধিক্কার দিয়ে কবির ভাষায় বলতে হয়, বিশ্বনবীর অপমানে যদি কাঁদে না তোর মন। মুসলিম নয় মোনাফেক তুই নবীজির দুশমন।
আবু উবাদা (রা.) এর দাঁত কোরবানি
পাপিষ্ঠ ইবনে কামিয়ার আঘাতে রাসুলের চেহারায় শিরস্ত্রাণের দুটি কড়া ঢুকে যায়। এত গভীরে প্রবেশ করে যে, হাত দিয়ে বের করা সম্ভব ছিল না। আবু উবাদা (রা.) তা দাঁত দিয়ে কামড়ে তুলে ফেলেন। এতে তার একটি দাঁত পড়ে যায়। দ্বিতীয় কড়াটি তুলতে গিয়ে তার আরো একটি দাঁত পড়ে যায়। (সিরাতে ইবনে হিশাম : ৩:৫৯)। নবীকে কীভাবে ভালোবাসতে হবে সাহাবিরা তা কাজেকর্মে দেখিয়েছেন। আফসোস, সেই সব নবীপ্রেমীর জন্য, যারা মুখে নবীপ্রেমের বুলি আওড়ায়; কিন্তু নবীর সম্মান বাঁচাতে বুলি আওড়াতেও রাজি নয়। এভাবে নবীপ্রেমিক হওয়া যায় না।
জীবন দেবেন তবু গালি নয়
আম্মার ইবনে ইয়াসির। মক্কার দুর্বল ব্যক্তিদের অন্যতম। প্রতিদিন মক্কার জালিমদের দ্বারা অপমানিত, নির্যাচিত হন। তাদের দাবি, ইসলাম ত্যাগ কর এবং মুহাম্মদকে গালি দাও। ই¯পাতকঠিন আম্মার। ধৈর্যের পাহাড়। সব যাতনা সয়েছেন; কিন্তু নবীর শানে উচ্চারণ করেননি কোনো কটুকথা। একদিন তাকে এ পরিমাণ প্রহার এবং পানিতে চুবিয়ে রাখা হয় যে, তিনি বেহুঁশ হয়ে কিছু কথা বলেই ফেলেন। হুঁশ ফিরলে তিনি নবীজির কাছে ক্রন্দনরত অবস্থায় আসেন এবং বলেন আজকে কাফেরদের ইচ্ছামতো আপনার শানে কিছু বাক্য বলেই ফেলেছি। নবীজি তাকে সান্ত¡না দিলেন এবং বললেন, এতে তোমার ঈমানের কোনো ক্ষতি হবে না। (আসহাবেরাসুলের জীবনকথা : ২:২৩)। একজন মোমিন নবীকে প্রাণাধিক ভালোবাসেন। প্রকৃত নবীপ্রেমীর কাছে নবীর কষ্ট হয় এমন কোনো বিষয় মেনে নেয়ার চেয়ে নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়া অধিকতর জন্য সহজ।
লেখক : মুহাদ্দিস ও খতিব