মক্কা শরিফের জুমার খুতবা
জীবনের হিসাব কষা বুদ্ধিমানের কাজ
শায়খ ড. ইয়াসির আদ দাওসারি
প্রকাশ : ২৮ জুলাই ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আমাদের জীবন কিছু মুহূর্তের সমষ্টির নামমাত্র। এ জীবনে দিন আসে, সন্ধ্যা নামে। আবার দেখা মেলে এক নতুন ভোরের। পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভাঙে। আবার জীবনের আরেকটি পাতা শুরু হয়। এভাবে মাস কেটে যায়, বছর অতিবাহিত হয়। কেশে শুভ্রতা ধরে, শরীরে জীর্ণতা ও দুর্বলতা চেপে বসে। সবকিছুই নির্দিষ্ট সময়ে নিয়মমাফিক চলতে থাকে। আমরা আরেকটি হিজরি বছর পার করলাম। নতুন হিজরি বছরে পদার্পণ করলাম। যেন খুব দ্রুতই চোখের পলকে বছরটি কেটে গেল। সময়গুলো যেন এক মুহূর্তেই ফুরিয়ে গেল। যেন একজন অতিথি এইমাত্র সাক্ষাৎ করল, আবার বিদায় নিল। প্রকৃতপক্ষে নতুন বছরে পদার্পণ করা এবং বিগত বছরকে বিদায় জানানোর মাঝে চিন্তাশীল ও জ্ঞানীদের জন্য শিক্ষা ও চিন্তার খোরাক রয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ দিবস ও রাতের পরিবর্তন ঘটান, এতে শিক্ষা রয়েছে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্নদের জন্য।’ (সুরা নুর : ৪৪)।
সচেতনদের কর্মকাণ্ডের হিসাব কষা
কোনো জ্ঞানী ধোঁকা খায় না। মিথ্যা আশায় প্ররোচিত হয় না। কেউ চরম বার্ধক্যে পদার্পণ করলে, সে যা করছে তা নিমিষে ভুলে যায়। অতএব, জ্ঞানী ব্যক্তিরা কালের যতটুকু ঘূর্ণায়নে আবর্তিত হয়, তাতে জীবনের মানে খোঁজার হিসেব মেলায়। জীবনের মুহূর্তগুলো কীভাবে কাটালাম, তার হিসাব কষে- এমন ব্যক্তি আল্লাহতায়ালার আদিষ্ট মানবিক পূর্ণতায় পৌঁছে যায়। পেয়ে যায় সফলতা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনরা! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; প্রত্যেকেই ভেবে দেখুক আগামীকালের জন্য সে কী অগ্রিম পাঠিয়েছে। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে অবহিত।’ (সুরা হাশর : ১৮)। সুতরাং প্রত্যেক জ্ঞানী ও যুগ সচেতন ঈমানদার ব্যক্তির নিজের কর্মকাণ্ডের হিসেব কষা তার নৈতিক ও আত্মিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। আর কৃতকর্ম থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামীর উজ্জ্বল বিভায় নিজেকে আলোকিত করে সুগঠন করা কাম্য।
আত্মার হিসাব না নেয়ার ক্ষতি
মানুষের আত্মিক অবক্ষয় এবং তার সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হলো, নিজ প্রবৃত্তিকে লাগামহীন ছেড়ে দেয়া, তার কোনো হিসাব না নেয়া, অবহেলা করে গড্ডালিকা প্রবাহে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়া, কুপ্রবৃত্তির তাবেদারি করা। যারা এমন করবে, তাদের ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হতে হবে। ধোঁকার স্বীকার ছাড়া কোনো ব্যক্তি এ ফাঁদে পা দেয় না। এমন ধরনের ব্যক্তি তার চোখ বন্ধ রেখে ক্ষমার আশায় পাপে লিপ্ত হয়। পর্যায়ক্রমে গোনাহে লিপ্ত হওয়া তার জন্য একটু একটু করে সহজ হয়ে যায়। তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে।
কুপ্রবৃত্তি দমনের কৌশল
মানুষের নফসকে খারাপ কাজের উস্কানি শক্তি দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে। আমাদের নফস ও প্রবৃত্তি তার স্বভাব মতোই আমাদের বিপরীতে চলতে থাকে। তাই ইসলাম বান্দাকে নিজের প্রবৃত্তিকে শায়েস্তা করা ও পরিশুদ্ধ করার নির্দেশনা দিয়েছে; যাতে মানুষ প্রবৃত্তির অনুসরণ না করে, কুবৃত্তি যেন তার অনুসরণ ও তাবেদারি করে।
আর নিজ প্রবৃত্তিকে ছেড়ে দিলে সে অবাধ্য হয়ে যাবে এবং বিপথগামী ও ঔদ্ধত হয়ে যাবে। তাকে তার বিপরীতে নিজের মতো সুগঠন করা গেলে, হিসাবের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো গেলে, সে সদা ভীত-সন্ত্রস্ত থাকবে। তখন আমরা যা বলব, তা শুনতে বাধ্য থাকবে। মানুষ নিজে কৃতকর্মের ত্রুটি বিচ্যুতিগুলো বুঝতে ও জানতে পারলে তার মাঝে অনুশোচনা বোধ আসবে, বিনয়ের শক্তি সঞ্চার হবে। তদ্রƒপ তাকে নিজের হিসাব নেয়ার প্রতি মনোযোগ সৃষ্টি করবে। প্রবৃত্তির সঙ্গে লড়াই করে তাকে পঙ্কিলতা থেকে পবিত্র করবে। আল্লাহর ইবাদতের জন্য নিজেকে পরিশুদ্ধ করবে। যাতে আল্লাহর নির্দেশিত কল্যাণ ও সফলতা অর্জন করা যায়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘শপথ মানুষের এবং তাঁর, যিনি একে সুঠাম করেছেন। এরপর একে এর অসৎকর্ম ও সৎকর্মের জ্ঞান দান করেছেন। সে-ই সফলকাম হবে, যে নিজেকে পবিত্র করবে।’ (সুরা শামস : ৭-৯)।
পূর্বপুসূরিরা যেভাবে হিসাব কষতেন
আমাদের পূর্বপুসূরিরা এসব অনুধাবন করেছিলেন। নিজ প্রবৃত্তিকে নিজের অনুগামী করেছিলেন। ইতিহাসের পরতে পরতে তাদের দামি দামি সে নসিহত আজও বিদ্যমান। ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, ‘তোমরা হিসেব নেয়ার আগেই নিজের হিসেব নিয়ে নাও। কেননা, আজ হিসাব না নিলে আগামীকাল তা বড় ভারী আকার ধারণ করবে।’ (আয যুহদ লি আহমদ : ১২০)। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সেদিন তোমাদের হাজিরা হবে এমনভাবে যে, তোমাদের কোনো গুপ্ত বিষয় গোপন থাকবে না।’ (সুরা হাক্কাহ : ১৮)। হাসান বসরি (রহ.) বলেন, ‘মানুষ যতক্ষণ নিজের হিসেবের কাঠগড়ায় তাকে দাঁড় করাবে, ততক্ষণ সে কল্যাণে নিমজ্জিত থাকবে।’ (সুনানে কোবরা)। ফুজাইল ইবনে আয়াজ (রহ.) বলেন, ‘যে নিজেকে আল্লাহর গোলাম মনে করে এবং ভাবে যে, এক সময় তার কাছেই সে ফিরে যাবে, তাহলে সে জেনে রাখুক, তার জীবন রবের জন্য উৎসর্গিত। আর যার জীবন রবের জন্য উৎসর্গিত, সে জিজ্ঞাসিত হবে। আর জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি যেন সব প্রশ্নের উত্তর আগেই ঠিক করে নেয়।’ এ কথা শুনে লোকেরা তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘এসব কীভাবে করা যায়?’ জবাবে তিনি বললেন, ‘এটি খুবই সহজ কাজ। তুমি তোমার অবশিষ্ট জীবনকে সুন্দর কর, তাহলে পুরোপুরি কৃতকর্মের পঙ্কিলতা মোচন হয়ে যাবে। কেননা, অবশিষ্ট জীবনেও যদি অপকর্ম কর, তাহলে এ জীবন ও আগের কৃতকর্ম সবকিছু সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।’
হিসাব-নিকাশের ধরন
নিজ প্রবৃত্তির হিসাব-নিকাশ যেমনিভাবে কর্মের পর করা যায়, তদ্রƒপ কর্মের মাঝে ও আগে করা যায়। কোনো কিছু করার আগে তার সম্পর্কে আগে চিন্তাভাবনা করা চাই। এর পর তাতে কোনো কল্যাণ নিহিত আছে কি-না, তা যাচাই-বাছাই করে সম্পাদন করা উচিত। নইলে বিরত থাকতে হবে। হাসান (রা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা তার ওপর রহম করুন, যে কোনো কিছু করার আগে চিন্তাভাবনা করে নেয়। এরপর রবের সন্তুষ্টি থাকলে তা সম্পাদন করে, নইলে বিরত থাকে। আর যে কাজটি করছি, তা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একনিষ্ঠভাবে সম্পাদন হচ্ছে কি-না, তার হিসাব মেলানো জরুরি। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ যথাযথভাবে পালন হয়েছে কি-না, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা চাই। কোনো বিধান যথাযথভাবে পালিত না হলে আগামীতে তা যেন সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার মাধ্যমে এবং আল্লাহর সাহায্যে সম্পাদিত হয়, তার জন্য পূর্ণ ও সর্বাত্মক চেষ্টা করা চাই। আল্লাহতায়ালার কোনো নিষেধাজ্ঞা যদি অমান্য হয়ে থাকে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে তওবা করা এবং গোনাহের পরিত্যাগ করা কর্তব্য। সে ব্যক্তি বড়ই সৌভাগ্যবান, যে তার কৃতকর্মের জন্য তওবা করে এবং আগামীর জন্য সব চেষ্টা করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সেদিনকে ভয় কর, যখন তোমরা আল্লাহর কাছে ফিরে যাবে। অতঃপর প্রত্যেক ব্যক্তিকে পরিপূর্ণরূপে দেয়া হবে, যা সে অর্জন করেছে। আর তাদের প্রতি কোনো জুলুম করা হবে না।’ (সুরা বাকারা : ২৮১)।
২ মহররম ১৪৪৫ (২১ জুলাই ২০২৩) তারিখে মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন মুহাম্মাদুল্লাহ ইয়াসিন