ঢাকা ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ইসলাম সাম্যের ধর্ম

মাহমুদ হাসান ফাহিম
ইসলাম সাম্যের ধর্ম

ইসলামি সভ্যতার শিরা-উপশিরায় মানবতার প্রবল স্রোতধারা সঞ্চালিত। বিশ্বের যাবতীয় সভ্যতার শীর্ষেই ইসলামি সভ্যতা স্থান পাওয়ার যোগ্য। প্রকৃতপক্ষে মানবতাই হচ্ছে ইসলামি সভ্যতার প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ বৈশিষ্ট্যের প্রভাবে ইসলাম মানব জাতিক দলাদলি, রেষারেষি ও পক্ষপাতিত্বের সংকীর্ণ পরিবেশ ও বর্ণ বৈষম্যের ঘিঞ্জিগলি থেকে এমন এক মুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলেছে, যেখানে আছে শুধু শালীনতা ও বন্ধুত্বের প্রাণ মাতানো সমীরণ; প্রেমপ্রীতি-ভালোবাসার সুমধুর সুরলহরী। যেখানে এক ব্যক্তি অপর ব্যক্তির ওপর, এক গোত্র অন্য গোত্রের ওপর, এক দল তার প্রতিপক্ষের ওপর কিংবা এক জাতি অন্য জাতির ওপর জুলুমণ্ডঅত্যাচারের কোনো সুযোগ পায় না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! আমি তোমাদের সবাইকে এক পুরুষ ও এক নারী হতে সৃষ্টি করেছি। তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা একে অন্যকে চিনতে পার। প্রকৃতপক্ষে তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি মর্যাদাবান সেই, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা মুত্তাকি। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু জানেন, সব বিষয়ে অবহিত।’ (সুরা হুজুরাত : ১৩)।

গোটা মানবজাতি একই ব্যক্তির সন্তান

ইসলামের এ অনুপম বৈশিষ্ট্য শুধু সৃষ্টিকর্তার সামনে কিংবা তাঁর ইবাদত-বন্দেগির ক্ষেত্রেই নয়; বরং সামাজিক আইন-কানুন ও শান্তি-শৃঙ্খলার ক্ষেত্রেও সম্পূর্ণরূপে বিদ্যমান। ইসলামি সভ্যতার প্রতিটি বিভাগ ও প্রতিটি স্তর এ বৈশিষ্ট্যের মহিমায় মহিমান্বিত। ইসলামের সত্যিকারের অনুসারীদের কর্মজীবন এর একেকটি বাস্তব উদাহরণ। পবিত্র কোরআনে গোটা মানবজাতিকে একই ব্যক্তির সন্তান বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এ থেকেও ইসলামি সভ্যতায় মানবতার প্রভাব সুস্পষ্ট নজরে আসে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মানবজাতি! তোমাদের রবকে ভয় কর। তিনি তোমাদের একই ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে সৃষ্টি করেছেন তার সহধর্মীনিকে। অতঃপর ওই একই স্বামী-স্ত্রী থেকে তিনি অসংখ্য নর-নারীর বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন। নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা তোমাদের পর্যবেক্ষক।’ (সুরা নিসা : ১)।

গোটা মানবজাতি একই বংশোদ্ভূত

মানুষমাত্রই একই বংশের অন্তর্গত। তাদের মধ্যকার জাতিগত পার্থক্য একই ঔরসজাত সন্তানের পার্থক্যের ন্যায়। এটা মোটেও লক্ষ্যণীয় বিষয় নয়। কেননা, মানুষ শাখা-প্রশাখায় ভিন্ন ভিন্ন হলেও মূল কিন্তু একই। গোটা মানবজাতি যখন একই বংশোদ্ভূত, তখন তাদের মধ্যে পরস্পর স্নেহ-ভালোবাসা, সাহায্য-সহযোগিতা ও পরোপকার সাধনের প্রবল আগ্রহ থাকাটা একান্তই স্বাভাবিক। ইসলাম এক অভিনব পদ্ধতিতে মানবতার এ দিকটি বিশেষভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। ওই বিশেষ দিকটির প্রতি মানবজাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘হে মানবজাতি! আমি তোমাদের এক পুরুষ ও এক স্ত্রীলোক হতে সৃষ্টি করেছি। আর পরস্পর পরিচয় লাভের জন্যই আমি তোমাদের মধ্যে বংশ ও গোত্রের প্রবর্তন করেছি।’ (সুরা হুজুরাত : ১৩)। এরপর ইসলাম মানব জীবনের একটি অবস্থার দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এভাবে, এ জীবন সংগ্রামে কেউ জয়ী হয়, কাউকে পরাজয়ের গ্লানি মেনে নিতে হয়। কেউ প্রাচুর্যের মধ্যে থাকে, কারও আবার অন্ন-বস্ত্রেরই সংস্থান হয় না। কেউ শাসন ক্ষমতার অধিকারী হয়, কাউকে আবার বাধ্যতামূলক অন্যের বশ্যতা স্বীকার করে নিতে হয়। কারও গায়ের রং কালো, আবার কারও সাদা। কারও হলদে, কারও বা অন্য কিছু।

সব মানুষই মর্যাদার অধিকারী

ইসলামের মতে, মানব জীবনে এসব পার্থক্য থাকাটা স্বাভাবিক। পার্থিব জীবনের সঙ্গে এসব বৈপরীত্য ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু এর অর্থ এ নয়, যারা উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত কিংবা শক্তি-সামর্থ্য ও শাসন ক্ষমতার অধিকারী, তারা তাদের পার্থিব মর্যাদা বা ক্ষমতাবলে ক্ষমতাহীন কিংবা শাসিতদের দণ্ডমু-ের মালিক হবে। আবার এর অর্থ এ-ও নয়, শ্বেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের দেখলে নাক সিটকাবে। এর প্রকৃতপক্ষে অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর কাছে সব মানুষই মর্যাদার অধিকারী। তবে সততা ও আল্লাহভীতির তারতম্যে তাদের মর্যাদারও তারতম্য ঘটে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে তোমাদের মধ্যে আল্লাহর কাছে সর্বাপেক্ষা বেশি মর্যাদাবান সে-ই, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা মুত্তাকি। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু জানেন, সবকিছু সম্পর্কে অবহিত।’ (সুরা হুজুরাত : ১৩)।

ইসলামের চোখে সবাই সমান

একমাত্র সততার ভিত্তিতেই মানুষের মধ্যে তারতম্য সৃষ্টি হতে পারে। পবিত্র কোরআনের বাচনভঙ্গিই ইসলাম মানবতার ধর্ম হওয়ার অকাট্য দলিল। কোরআন মানব জাতিকে ‘হে বনী আদম, হে মানব জাতি’ ইত্যাদি শব্দ দ্বারা সম্বোধন করেছে। মুসলমানদের সম্বোধনের প্রয়োজনে ‘হে মুসলিমজাতি’ বা এ জাতীয় শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। পক্ষান্তরে ‘হে পরাক্রমশালী মানবগোষ্ঠি’ বা ‘হে শ্বেতাঙ্গ মোমিনরা’- এ জাতীয় শব্দের কোনো সম্বোধন কোরআনে কারিমে উল্লেখ নেই। সমগ্র মানবজাতি হোক কিংবা কোনো এক ধর্মের অনুসারীই হোক, সবাইকে একই স্কেলে দাঁড় করিয়েছে। এখানে সম্মান-মর্যাদা নির্ধারণের বেলায়ও ধনী-দরিদ্র কিংবা সাদা-কালোর প্রশ্ন কখনও উত্থাপন করেনি ইসলাম। প্রাথমিক স্তর বা মৌলিক বিষয়সমূহেই নয়, বরং ইসলামি আইনের প্রত্যেকটি ধারা-উপধারা এবং প্রতিটি অদেশ-নির্দেশেই মানবতার গভীর অনুভূতি বিদ্যমান। প্রথমে নিখুঁত ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কথাই বলা যাক, নামাজে ইসলাম সমগ্র মুসলমান জাতিকে একই সারিতে দাঁড়িয়ে আল্লাহর বন্দেগি করার নির্দেশ দিয়েছে। আমির-উমারারা কোনো বিশেষ কাতারে দাঁড়াবেন, এমন ব্যবস্থা ইসলামের বিধিবহির্ভূত। রমজান মাসে ইসলাম সবাইকেই অভুক্ত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে রাজা-বাদশা কিংবা অর্থ বিত্তশালীদের কোনোরূপ ছাড়ের সুযোগ নেই। হজের সবাইকে একই পোশাক পরিধান করতে হয়। একই স্থানে দাঁড়িয়ে যাবতীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করতে হয়। আরব-অনারব, দেশি-বিদেশি কিংবা বিশিষ্টের কোনো প্রশ্ন এখানে উত্থাপিত হতে পারে না।

দণ্ডবিধিতে শাসক-শাসিতের তফাৎ নেই

ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি ছাড়াও ইসলামি মূলনীতির প্রত্যেকটি ধারা-উপধারা প্রণীত হয়েছে মানবতা তথা ন্যায়নীতিকে কেন্দ্র করে। ইসলামি আইন মাজলুম ও উৎপীড়িতের অধিকার রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে। যুদ্ধ ঘোষণা করেছে জালেম ও শোষকদের বিরুদ্ধে। ইসলামি দণ্ডবিধি শাসক-শাসিত কিংবা উঁচু-নিচুর মধ্যে কোনো তফাৎ করে না। উচ্চ বংশ কিংবা পার্থিব উচ্চ মর্যাদার আবদার এখানে টেকে না। যে কেউই হত্যার অপরাধে অপরাধী হবে, ইসলামি আইন তার ওপর তৎক্ষণাৎই মৃত্যুদণ্ডের আদেশ জারি করবে। হোক না সে যত বড় বিত্তশালী কিংবা শৌর্যবীর্যের মালিক। অভিযুক্ত ব্যক্তি শিক্ষিত না মূর্খ, কৃষক না সাহেব, স্বদেশি না বিদেশি, ধনী না নির্ধন, প্রাচ্যের না পশ্চাত্যের, শ্বেতাঙ্গ না কৃষ্ণাঙ্গ- এ ধরনের অবান্তর তফাৎ ইসলামি আদালতে স্বীকৃতি পাবে তো দূরের কথা, উত্থাপিতও হতে পারে না। ইসলাম বর্ণ, ধর্ম কিংবা এ জাতীয় কোনো কিছুর দিকেই তাকায় না। সমতা তথা মানবতাকেই এর সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দেয়। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ হিসেবে প্রতিটি মানুষই সম্মানিত এবং মর্যাদার অধিকারী। আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে যেভাবে উচ্চ মর্যাদা ও সুসম্মানের অধিকারী করেছেন, তাতে প্রতিটি মানুষ অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা- এককথায় দুনিয়ার যাবতীয় মৌলিক অধিকারে সমান অধিকারী। ইসলামি শাসনব্যবস্থা তাদের কাউকে জন্মগত এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করেনি; বরং অত্যন্ত কড়াকড়িভাবে তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত