আল্লাহতায়ালা শাশ্বত দ্বীন হিসেবে ইসলামকে মনোনীত করেছেন; একমাত্র দ্বীন হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। ফলে এ ধর্মে সব স্থান-কালের সব বিষয়ে সমাধান রয়েছে। এ ধর্ম সব রকমের দোষত্রুটির অপূর্ণতা ও পদস্খলন থেকে মুক্ত, পবিত্র। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। তোমাদের ওপর আমার নেয়ামত পরিপূর্ণ করলাম। তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে ইসলামকে (চিরদিনের জন্য) পছন্দ করে নিলাম।’ (সুরা মায়িদা : ৩)। ইসলামি শরিয়া যেসব বিষয়কে সুউচ্চ মর্যাদা দিয়ে গবেষণার সামনের সারিতে রেখেছে, তার মধ্যে ইজতিহাদ অন্যতম। ইজতিহাদ বলা হয়, যেসব বিষয়ে দলিল-প্রমাণ নেই, সেসব বিষয়ে সর্বাত্মক চেষ্টা-সাধনা করে সমাধান বের করা। ইসলামি শরিয়া বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ আলেমদের তা অনুসরণের প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছে। ফলে ইসলামি শরিয়ার বিধান প্রতিপালনের ক্ষেত্রে একটি মূলনীতি রয়েছে; যার প্রমাণ উম্মাহর মাঝে স্পষ্ট। ইজতিহাদের মূলনীতি ওলামায়ে কেরামের কাছে প্রোজ্জ্বল।
কল্যাণের প্রতি লক্ষ্য রাখা শরিয়তের কাম্য
ইমাম শাতেবি (রহ.) বলেন, ‘ইসলামি শরিয়াকে মানুষ ইহ-পরকালীন কল্যাণকামিতা ও ক্ষতি দূর করার নীতি বিধিবদ্ধ করা হয়েছে।’ ইসলামের নীতি হলো, কঠিন বিষয়ে সহজ করা; কোনো বিষয় সংকীর্ণ হলে তারও প্রশস্তি আসা। (প্রাগুক্ত)। শরিয়ার ভিত্তি হলো, মানব জীবনের কল্যাণকামিতা ও ক্ষতি দূর করা; আর শরিয়ার দলিলগুলো বিভিন্ন প্রকারে বিভক্ত। যেমন- মুতাওয়াতির, ওয়াহেদ ইত্যাদি; যা দ্বারা সত্য উদ্ঘাটন করে আমল করা যায়। তবে দলিলের এ ভিন্নতা দেখে কেউ যেন মনে না করে, ইসলামি শরিয়া পরিবর্তন হয়ে গেছে; বরং দূরদৃষ্টি, সহজীকরণ এবং উদ্দীষ্ট বস্তু ও কল্যাণের প্রতি লক্ষ্য রাখাও শরিয়তের কাম্য।
মতনৈক্য ধর্মীয় ব্যাপকতার উর্বর ভূমি
কোরআন-হাদিসের দলিল ও ব্যাখ্যা বুঝতে মতনৈক্য হওয়া শরিয়ার বিস্তৃতি ও ব্যাপকতার উর্বর ভূমি এবং শরিয়া যে সহজতা চায়, তার উজ্জ্বল প্রমাণ। পাশাপাশি নিত্য নতুন বিষয়ে বিশ্লেষণ ও গবেষণার সুযোগ প্রদান। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত; নবীজি (সা.) একবার সাহাবায়ে কেরামকে লক্ষ্য করে বলেছেন, ‘ঈমানদার ব্যক্তি যেন অবশ্যই বনি কোরাইযায় গিয়ে আসরের নামাজ আদায় করে।’ নবীজি (সা.)-এর এ বাণী শুনে তারা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। একদল রাস্তায়, অন্যদল বনি কোরাযায় গিয়ে নামাজ আদায় করেন। নবীজি (সা.) তা সমর্থন করেন। (বোখারি : ৯৪৬)। তাই শাখাগত সব মাসআলায় এমন মতনৈক্য রয়েছে। প্রাজ্ঞ আলেমগণ সেগুলোকে সহযোগিতা ও উদারতার মাসআলায় গণ্য করেছেন। স্বতসিদ্ধ মূলনীতির আলোকে সেসব মতনৈক্যে কারও চোখে কেউ দোষী নয়। অতএব, প্রামাণিক বিধান হলো, যেসব ক্ষেত্রে কোরআন-সুন্নাহ দলিল প্রদান করেছে, যাতে ঈমান, ফরজ ইবাদত, হত্যা, চুরি, ব্যভিচার ইত্যাদির বিধান রয়েছে, এসব বিধান অকাট্য। এসব বিষয়ে কারও আঙুল তোলার এবং মাথা ঘামানোর ও চিন্তা-ভাবনার সুযোগ নেই।
সাহাবিদের ইজতিহাদ
শরিয়ার বিধানের সহজতার ক্ষেত্রে সাহাবিদের পূর্ণ দখল ছিল। পাশাপাশি নিত্য নতুন বিষয়ে নতুন করে চিন্তা-ফিকির করার ক্ষেত্রে পূর্ণ কর্তৃত্ব ছিল। যেমনটি আবু বকর (রা.) মুরতাদের হত্যা করার ক্ষেত্রে করেছিলেন। তখন তিনি দ্বীনকে হেফাজতের বিষয়কে অন্য সবকিছুর ওপর প্রাধান্য দিয়েছিলেন। ওসমান (রা.) সবাইকে এক কোরআনের ওপর একত্রিত করেছেন। ওমর (রা.) দুর্ভিক্ষের বছরে সন্দেহের কারণে হদ রহিত করার বিধান করেছেন। তিনি বিখ্যাত সাহাবি আবু মুসা ও আলী (রা.)-কে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘যে বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, আগামীকাল তার বিপরীত যদি সত্য প্রমাণিত হয়, তাহলে সেই সত্যের বিধান পুনরায় জারি করতে কোনো কিছু যেন আপনাকে বাধা না দেয়। কেননা, মিথ্যার ওপর অটল থাকার চেয়ে সত্যের পথে ফিরে আসা অতি উত্তম।’ (সুনানে দারাকুতনি : ৩৯১৪)। এতে বোঝা যায়, যুগ এবং সময়ের চাহিদা অনুপাতে ইজতিহাদ ভিন্ন ও আলাদা রূপ নিতে পারে; যা দোষণীয় নয়। এ জন্যই ওমর (রা.) নতুন কোনো মাসআলা সামনে এলে মুহাজির ও আনসার সাহাবায়ে কেরামসহ বদর যুদ্ধে অংশীদার সাহাবিদের একত্রিত করে সেসব মাসআলার সমাধান দিতেন।
মাজহাবের ইমামদের ইজতিহাদ
সাহাবায়ে কেরামের উক্ত অনুসৃত পথেই ওলামায়ে কেরাম হেঁটেছেন। ফলে হানাফি মাজহাব কিয়াস দ্বারা আমল করার ক্ষেত্রে উদারতা ও ব্যাপকতার নীতি গ্রহণ করেছেন। মালেকি মাজহাব সব মাসআলায় উদ্দেশ্য খুঁজে এবং মদিনাবাসীর কর্মের প্রতি লক্ষ্য রেখে উদারতার নীতি গ্রহণ করেছেন। শাফেয়ি মাজহাব এসব বিষয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুটি মত প্রদান করেছেন। একটি পুরোনো, অপরটি নতুন। ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-এর দুটি নয়, কয়েকটি মত রয়েছে। তারা ইজতিহাদের ক্ষেত্রে ব্যাপকতা এবং সহজতার নীতি গ্রহণ করেছেন; যা স্বাভাবিক স্বীকৃত। এসবের কোনো কিছুই দোষের নয়। তাইতো যখনই কোনো বাদশা বা খলিফা মানুষদের এক মাজহাবে একত্রিত করতে চেয়েছে, তখনই ওলামায়ে কেরাম সোচ্চার হয়ে মানুষদের তা গ্রহণ না করার ব্যাপারে উপদেশ প্রদান করেছেন। যাতে এ ব্যাপকতা উম্মাহর মাঝে চলমান থাকে। তাই ইমাম মালেক (রহ.) ‘মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেক’ সংকলন করে দ্বীনের ব্যাপকতার পথকে আরও সুগম করেছেন। ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) ‘কিতাবুল খিলাফ’ রচনা করে পরবর্তীতে এর নাম দিয়েছেন ‘কিতাবুস সাআহ’। যা ইজতিহাদের ক্ষেত্রে ব্যাপকতার নীতি গ্রহণ করারই ফল। এসবই ছিল আমাদের আকাবিরের অনুসৃত পদ্ধতি।
ইজতিহাদের ক্ষেত্রে তাদের নীতি
ইজতিহাদের জন্য একটি অন্যতম মূলনীতি হলো, ইজতিহাদের যোগ্য ও প্রাজ্ঞ আলেমগণই ইজতিহাদ করবেন।
কেননা, ইজতিহাদটি শরিয়ার চাহিদা মোতাবেক হতে হলে প্রাজ্ঞ আলেমকে ইজতিহাদ করতে হবে। যারা নীতিমালা সম্পর্কে সম্যক অবগত এবং শরিয়তের মানদ-ে ও ছাঁচে ফেলে ইজতিহাদ করার সক্ষমতা রাখেন। আরো একটি অন্যতম মূলনীতি হলো, শাখাগত পরিবর্তনশীল মাসআলা ইজতিহাদ করা। কেননা, ইসলামি শরিয়ায় সব যুগ ও কালের যে কোনো বিষয়ের সমাধান দিতে সক্ষম। তবে এ কথা অবশ্যই স্মরণ রাখা চাই, কোনোভাবেই পূর্ববর্তী ওলামায়ে কেরাম এবং সমসাময়িক আলেমদের মতের অমিলের কারণে গালমন্দ করা যাবে না। তাদের সংকলনকে উপেক্ষা করা যাবে না। তাদের ইজতিহাদ ও মতাদর্শকে হেয় প্রতিপন্ন করা যাবে না। বরং তাদের ইজতিহাদকে সম্পূর্ণ সম্মান দেখাতে হবে। কেননা, মুজতাহিদ ব্যক্তি সঠিকভাবে ইজতিহাদ করলে তার জন্য দুটি প্রতিদান থাকে; আর ভুল করলে একটি প্রতিদান। সুতরাং তাদেরকে সম্মান প্রদর্শন করা এবং পূর্ণ আদব রক্ষা করে মতামত গ্রহণ করা একান্ত কাম্য।
ইজতিহাদে আকাবিরের আদর্শ
ইমাম জাহাবি (রহ.) বলেন, যখন কোনো ব্যক্তি ইজতিহাদি ভুল করে, আমরা তাকে পরিত্যাগ ও মূর্খ বলে গালিগালাজ করতে দ্বিধা করি না। আল্লাহতায়ালা যাকে তৌফিক দেন, সেই ব্যক্তি অধিক সঠিক ব্যক্তির সামান্য ভুলকে ক্ষমা করে দেন। (সিয়ারু আলামিন নুবালা : ১৪/৪০)। কিন্তু বর্তমানে এমন কাদা ছোড়াছুড়ি এবং আলেমদের শানে অকথ্যের যে দুঃসাহসিকতা দেখানো হচ্ছে, তা অত্যন্ত ভয়ানক। খেয়াল-খুশিমতো একটি ইজতিহাদ দাঁড় করানো অত্যন্ত গর্হিত ও ফেতনা সৃষ্টি বৈ কিছু নয়।
ইজতিহাদের অন্যতম বিষয়
বর্তমানে ইজতিহাদের একটি ক্ষেত্র হলো, রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক জারিকৃত কোনো বিধান যেখানে জনসাধারণের কল্যাণকামিতার প্রতি লক্ষ্য রাখা হয়। তা ছাড়া শরিয়তের মূলনীতি হলো, রাষ্ট্রপ্রধানের আদেশ জনসাধারণের কল্যাণের ওপর নির্ভরশীল। (আল আশবাহ ওয়ান নাজায়ের)। কোনো বিচারকের আদেশ মতনৈক্য দূর করে দেয়। যে কোনো জিনিস বৈধ হওয়া আসল যদি তার বিপরীতে কোনো দলিল-প্রমাণ না থাকে। (প্রাগুক্ত)। ইমাম ইজ্জ বিন আবদুস সালাম (রহ.) বলেন, যখন কোনো ক্ষেত্রে কল্যাণ-অকল্যাণ একত্রিত হয়ে যায়, তখন অকল্যাণ দূর করে কল্যাণের ওপর আমল করা গেলে আমরা তা-ই করি, যাতে আল্লাহর আদেশ পালন করতে পারি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় করে চল এবং শোন ও মান। আর (আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী) অর্থ ব্যয় কর।’ (সুরা তাগাবুন : ১৬)।
টেকসই দ্বীনের জন্য করণীয়
এসব মূলনীতি শাস্ত্রীয় পণ্ডিত ফিকহবিদ এবং প্রাজ্ঞ আলেম ছাড়া কেউ প্রণয়ন করতে পারে না। নতুবা প্রত্যেকে খেয়াল-খুশিমতো ইজতিহাদ করত এবং ফেতনা সৃষ্টি করত। তাইতো ইমাম কারখি (রহ.) বলেন, আল্লাহর দ্বীনকে আঁকড়ে ধর, সফল হবে।
হাক্কানি রব্বানি ওলামায়ে কেরামের খুঁটি আঁকড়ে ধর, দুনিয়া ও আখেরাতে সফল হবে। বর্তমানে আধুনিক বিশ্বে এবং প্রযুক্তির এ যুগে ওলামায়ে কেরামকে নিত্য নতুন বিষয়ের ক্ষেত্রে সর্বাত্মক ইজতিহাদ করা চাই। বিশেষ করে, অর্থনৈতিক, চিকিৎসা বিজ্ঞান, নারীবিষয়ক ইত্যাদি বিষয়ে অবশ্যই ওলামায়ে কেরামকে নতুন করে ইজতিহাদ করা চাই। এসব ইজতিহাদ একটি স্বীকৃত ইজতিহাদি বোর্ডের মাধ্যমে স্থান-কালভেদে, ব্যক্তি ও স্বভাবভেদে করা উচিত। আর এভাবেই যুগ যুগ ধরে কেয়ামত পর্যন্ত ইসলামি শরিয়া উপযোগী টেকসই দ্বীন হিসেবে বিবেচিত হবে।
১৬ মহররম ১৪৪৫ হিজরি মোতাবেক ৪ আগস্ট ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষিপ্ত অনুবাদ করেছেন - মুহাম্মাদুল্লাহ ইয়াসিন