রবের প্রকৃত বান্দা হতে চাইলে জীবনের সব ক্ষেত্রেই বিনয় প্রয়োজন। ইবাদত-বন্দেগি থেকে শুরু করে ঘরে-বাইরে সবার সঙ্গে আচরণে বিনয় অপরিহার্য। আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি কামনায় নিজেকে নিচু করে দেয়ার এ প্রশিক্ষণে যে প্রশিক্ষিত হতে পারবে, দুনিয়া ও আখেরাতে অযাচিতেই সম্মান তার কাছে এসে ধরা দেবে। দুনিয়ার মানুষের ভালোবাসায় সে সিক্ত হবে। মানুষ তাকে খুব সহজেই আপন করে নেবে, কাছে টানবে। কারণ, বিনয়ী মানুষকে সবাই ভালোবাসে। আর এ বিনয় যার যতটা হাসিল হবে, বান্দা হিসেবে সে ততটাই সফল হবে। আল্লাহর বিধিবিধানের সামনে সে ততটাই নিজেকে সঁপে দিতে পারবে। শোকর আর কৃতজ্ঞতায় তার হৃদয়-মন ততটাই আপ্লুত হবে। বাহ্যত নিজের শ্রমে-ঘামে কিংবা অর্থ-মেধায় অর্জিত সফলতাকেও তখন সে আল্লাহর দান বলে বিশ্বাস করবে। এ বিনয় যখন কারও হাসিল হবে, তখন তার ওঠাবসায়, কথাবার্তায় এমনকি হাঁটাচলায়ও এ বিনয় প্রকাশ পাবে। আল্লাহতায়ালার প্রকৃত সেই বান্দাদের বৈশিষ্ট্যাবলি পবিত্র কোরআনে এভাবে উল্লিখিত হয়েছে, ‘রহমানের বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে।’ (সুরা ফোরকান : ৬৩)।
নবীজি (সা.) বিনয়ী ছিলেন
আমাদের প্রিয় নবীজি (সা.) মানুষের মধ্যে অনেক বিনয়ী ছিলেন। বিনয়ের সর্বোচ্চ মাত্রা প্রদর্শন করে মানুষের সঙ্গে মিলিত হতেন। তিনি তার আচার-আচরণে বিনয় ও নম্রতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। জায়গা করে নিয়েছেন মানুষের হৃদয়ে। এ রুগ্ন পৃথিবীকে বারবার তার কাছেই ফিরে আসতে হবে। তার আদর্শের সাহচর্য গ্রহণ করতে হবে। কেমন ছিলেন তিনি? কী ছিল তার জীবনাদর্শ? এক কথায়, এ প্রশ্নের জবাব, ‘তুমি অবশ্যই মহান চরিত্রে অধিষ্ঠিত।’ (সুরা কলাম : ৪)। সমাজের অসহায় ও নিম্নশ্রেণির লোকদের কাছেও তিনি ছিলেন আপনজনদের চেয়েও বড় আপন। খুব সাধারণভাবে তিনি মানুষের সঙ্গে মিশতেন। যে কেউ যখন তখন তার সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। কেউ কথা বলতে গিয়ে ভয় পেলে তিনি তাকে অভয় দিতেন। আবু মাসউদ (রা.) বলেন, এক লোক নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে কথা বলতে এলো। তখন ভয়ে সে কাঁপছিল। নবীজি (সা.) বললেন, ‘শান্ত হও। আমি কোনো রাজা-বাদশা নই। আমি একজন সাধারণ নারীর সন্তান।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৩৩১২)। তিরমিজির একটি বর্ণনায় উঠে এসেছে তার মহানুভবতার কথা, বর্ণিত হয়েছে তার কোমলতার কথা- ‘তিনি ছিলেন প্রশস্ত হৃদয়ের মহানুভব, সত্যবাদিতায় সর্বাগ্রে, ন¤্রতা আর কোমলতায় অনন্য, আচার-আচরণে অভিজাত। প্রথম যে তাকে দেখত, ভয় করত; কিন্তু যে-ই তার সঙ্গে মিশত, তাকে ভালোবাসত।’ (তিরমিজি : ৩৬৩৮)।
বিনয় জান্নাতিদের বৈশিষ্ট্য
জান্নাতি ও জাহান্নামিদের স্বভাব-চরিত্রের পরিচয় দিয়ে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের কাছে জান্নাতবাসীদের ব্যাপারে বলব না? তারা হচ্ছে দুর্বল, নরম লোক, তাদের কেউ যদি আল্লাহতায়ালাকে কসম দিয়ে কিছু বলে, আল্লাহ অবশ্যই তার কসম রক্ষা করবেন। আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নামিদের সম্পর্কে বলব না? ওরা হচ্ছে রূঢ় ও কর্কশ স্বভাবের, উদ্ধত, আত্মম্ভরী লোক।’ (বোখারি : ৪৯১৮, মুসলিম : ২৮৫৩)।
তাচ্ছিল্য অহংকারের শামিল
রাসুল (সা.) বলেন, ‘যার মধ্যে এক কণা পরিমাণ অহংকার রয়েছে, সে জান্নাতে যাবে না।’ একজন জিজ্ঞেস করলেন, ‘মানুষ পছন্দ করে তার কাপড়টা সুন্দর হোক, জুতাটা সুন্দর হোক?’ তিনি বললেন, ‘আল্লাহতায়ালা সুন্দর, সৌন্দর্য তিনি পছন্দ করেন। অহংকার হচ্ছে, সত্যকে অস্বীকার করা, আর মানুষকে তাচ্ছিল্য করা।’ (মুসলিম : ৯১)। আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমাদের এক সম্প্রদায় যেন অন্য সম্প্রদায়কে তাচ্ছিল্য না করে। হতে পারে এরা ওদের চেয়ে ভালো। (তোমাদের) নারীদেরও এক শ্রেণি যেন অপর শ্রেণিকে তাচ্ছিল্য না করে। হতে পারে, এরা ওদের চেয়ে ভালো। তোমরা পরস্পরকে দোষারোপ করো না। একে অপরকে মন্দ উপাধিতে আখ্যায়িত করো না। ঈমানের পর ফাসেক নাম কতই না মন্দ! যারা তওবা করে না, তারাই তো জালেম।’ (সুরা হুজুরাত : ১১)।
বদমেজাজিদের কেউ পছন্দ করে না
যারা উগ্র, বদমেজাজি, নিজের স্বার্থরক্ষায় অনড়-অটল, নিজের বড়ত্ব প্রমাণে ব্যস্ত, বড়কে সম্মান করে না, ছোটদের স্নেহ করে না, তারা নিজেরা নিজেদের হিরো ভাবলেও পরিবার-পরিজন, আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধব কারও প্রিয়পাত্র হতে পারে না। সবাই তাদের আড়চোখে দেখে, যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। অতএব, জীবনকে সুখময় করে তুলতে, সবার প্রিয় পাত্র হতে, সব শেষে জান্নাতিদের দলে শামিল হতে অবশ্যই আমাদের বিনয়ী হতে হবে।