অশালীনতা প্রতিরোধে পর্দা
আবদুল্লাহ হাসান কাসেমি
প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ইসলাম প্রকৃতির ধর্ম, শরিয়ত মানবিক বিধান। ইসলামি শরিয়তের প্রতিটি বিধি-নিষেধ মানব স্বভাব ও প্রকৃতির একেবারে কাছাকাছি। স্বভাববিরুদ্ধ ও প্রকৃতিবিরোধী কোনো বিষয় কালোত্তীর্ণ ধর্ম ইসলামে নেই। একান্তই কোনো বিষয় যদি কারও কাছে অস্বাভাবিক ও অপ্রাকৃতিক মনে হয়, তাহলে সেটা হবে বিকৃত চিন্তা-চেতনা ও অসুস্থ রুচি-প্রকৃতির কারণে। সুস্থ স্বভাবের অধিকারী কারও কাছে ইসলামের কোনো বিধানই অস্বাভাবিক মনে হতে পারে না। যেমন- দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তির কাছে কখনও দিনকে রাত মনে হয় না এবং সুস্থ ব্যক্তির কাছে সুস্বাদু বস্তু কখনও বিস্বাদ লাগে না। ইসলামের ছোট-বড় সব বিষয়ের ন্যায় পর্দার বিধানও মানব স্বভাব ও প্রকৃতির সম্পূর্ণ অনুকূল।
নারীর প্রধান কর্মক্ষেত্র
ঘরের ভেতর-বাহিরসহ পৃথিবীর সব জায়গা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব মানুষের কর্মক্ষেত্র। তবে নারী-পুরুষের সৃষ্টিগত তারতম্যের কারণে পুরুষের মূল কর্মক্ষেত্র বহিরাঙ্গন, আর নারীর মূল কর্মক্ষেত্র গৃহাভ্যন্তর। স্বভাবগতভাবে কোমল এবং দুর্বল হওয়ার কারণে তাদের জন্য এটাই হচ্ছে উত্তম ও নিরাপদ আবাসস্থল। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা নিজ ঘরে অবস্থান কর এবং (পরপুরুষের সামনে) সাজসজ্জা প্রদর্শন করে বেড়িও না, যেমন প্রাচীন জাহেলি যুগে প্রদর্শন করা হতো। নামাজ কায়েম কর, জাকাত আদায় কর এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য কর। হে নবী পরিবার! আল্লাহ তো চান তোমাদের থেকে মলিনতা দূরে রাখতে এবং তোমাদের সর্বোতভাবে পবিত্রতা দান করতে।’ (সুরা আহজাব : ৩৩)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্ববান এবং তোমাদের প্রত্যেকেই স্বীয় অধীনস্থ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। সুতরাং জনগণের শাসনকর্তা তাদের বিষয়ে দায়িত্ববান। আর তিনি স্বীয় অধীনস্থ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। প্রত্যেক পুরুষ স্বীয় পরিবারের লোকদের বিষয়ে দায়িত্ববান। তিনি নিজের অধীনস্থ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। প্রত্যেক নারী স্বীয় স্বামীর পরিবারের লোক ও তার সন্তানদের বিষয়ে দায়িত্ববান। তিনি তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। কোনো লোকের চাকর স্বীয় মনিবের সম্পদের বিষয়ে দায়িত্ববান। সে তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (মুসলিম : ১৮২৯)। অবশ্য ইসলাম এমন সংকীর্ণ ও কঠোর ধর্ম নয় যে, প্রয়োজনের তাগিদের ঘরের বাইরে বের হওয়া যাবে না এবং চাকরিবাকরিতেও যোগদান করা যাবে না। সময়ের দাবিতে এবং প্রয়োজনের তাগিদে অবশ্যই ঘর থেকে বের হওয়া যাবে, তবে পর্দাশীলতার সঙ্গে। এমনকি চাকরিও করা যাবে, তবে ভিন্ন কর্মক্ষেত্রে।
পর্দা নারীর রক্ষাকবচ
ইসলামি সমাজব্যবস্থায় নারীদের জন্য পর্দা এক অনন্য বিধান, যা সুশৃঙ্খল ও সুসংহত সমাজব্যবস্থার নিশ্চয়তা দেয়। নির্মল, পরিচ্ছন্নতা ও পুতঃপবিত্র জীবনের গ্যারান্টি দেয়। সর্বোপরি যা নারী জাতির ইজ্জত-আব্রু ও সম্মান-সম্ভ্রমের রক্ষাকবচ। যে যত বেশি ইসলামনির্দেশিত পর্দার প্রতি যত্নশীল হবে, তার ইজ্জত-সম্মান তত রক্ষা পাবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি পর্দার প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করবে, সে হবে লাঞ্ছিত, অপমানিত ও অপদস্থ। কখনও যৌন হয়রানির শিকার হবে, কখনও উত্যক্ততার মুখোমুখি হবে, আর কখনও হবে জৈবিক লালসার অসহায় শিকার। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে নবী! তুমি তোমার স্ত্রীদের, কন্যাদের ও মোমিন নারীদের বলে দাও, তারা যেন তাদের চাদরের কিছু অংশ নিজেদের ওপর টেনে নেয়। এতে তাদের চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান। (সুরা আহজাব : ৫৯)।
পর্দা পবিত্রতার মাধ্যম
পর্দাশীলতা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে সুন্দর ও সুনির্মল জীবন উপহার দেয়। ফলে পুরুষের অন্তরে নারী সম্পর্কে এবং নারীর অন্তরে পুরুষ সম্পর্কে কুবাসনা সৃষ্টি হয় না, মন-মস্তিষ্ক ও চিন্তা-চেতনা কদর্য ও অপবিত্র হয় না; বরং বিকৃত ও অসৎ ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-চেতনার বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হয়ে অনুপম সুন্দর জীবনযাপন করতে পারে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(হে নবী!) আপনি মোমিন পুরুষদের বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। এটা তাদের জন্য পবিত্রতর। নিঃসন্দেহে আল্লাহতায়ালা তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে সম্যক অবগত। আর মোমিন নারীদের বলে দিন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং লজ্জাস্থান হেফাজত করে। তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে।’ (সুরা নুর : ৩০-৩১)।
পর্দা সফলতার মাধ্যম
যাদের সঙ্গে দেখা করা জায়েজ নেই, তাদের সঙ্গে পর্দা করা সাফল্যমণ্ডিত জীবন লাভের অন্যতম মাধ্যম। সৃষ্টিগত স্বভাবের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পর্দার এ বিধানের দিকে এগিয়ে আসা এবং পর্দাশীলতাকে গ্রহণ করা মানে সফলতার দিকে আগুয়ান হওয়া। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা যেন তাদের মাথার কাপড় বক্ষদেশে টেনে দেয়। আর তারা যেন তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে তাদের স্বামী, বাবা, শ্বশুর, নিজ পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভাই, ভাতিজা, ভাগিনা, নিজেদের বিশ্বস্ত নারী, অধিকারভুক্ত দাসি, কামনামুক্ত পুরুষ এবং শিশু, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অবহিত নয়, তারা ছাড়া। আর তারা যেন এমনভাবে চলাফেরা না করে, যাতে তাদের গোপন সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়। হে মোমিনরা! তোমরা আল্লাহর দিকে ফিরে যাও, যাতে সফলকাম হতে পার।’ (সুরা নুর : ৩১)।
পর্দা প্রতিরোধের হাতিয়ার
পর্দার বিধান লঙ্ঘন ও তার প্রতি অবহেলা প্রদর্শনের ফলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে দেখা দেয় অশুভ প্রভাব। দৃষ্টিগোচর হয় বহু ন্যাক্করজনক ও লোমহর্ষক ঘটনা। মাঝেমধ্যে রাস্তার ধারে, স্টেশনের গলিতে, কখনও বা ডাস্টবিনের ময়লা-আবর্জনায় পাওয়া যায় ফুটফুটে নবজাতকের বেওয়ারিশ লাশ। যা প্রসবের সঙ্গে সঙ্গেই ছুঁড়ে ফেলা হয় অবৈধ গর্ভের ফসল হিসেবে। এ সবই ইসলামের সর্বজনীন বিধান লঙ্ঘন এবং পর্দাশীলতার প্রতি যত্নবান না হওয়ার কারণ। বস্তুত পর্দা নারীকে অবরোধ করতে চায় না এবং চায় না প্রগতির পথে অন্তরায় হতে। পর্দা নারীকে মানবরূপী শয়তানের দৃষ্টিবান থেকে রক্ষা করতে চায়। অবৈধ প্রেমণ্ডপ্রণয়, ধর্ষণ-ব্যভিচার, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা ও বেলেল্লাপনা প্রতিরোধ করতে চায়। পর্দা চায় অশান্তির দাবানল ছড়িয়ে পড়া থেকে মুসলমানদের ঘর রক্ষা করতে এবং সর্বত্র পুণ্য, পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা ও নিষ্কলুষতার আবহ তৈরি করতে। পর্দা চায় স্বামী-স্ত্রী, সন্তান ও মা-বাবার মধ্যে ভালোবাসার বন্ধন অটুট রাখতে এবং তাদের ধর্মীয় আদর্শ, সামাজিক মর্যাদা ও বংশীয় কৌলিন্য বজায় রাখতে।