মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
সাবেক সহকারী মুফতি, জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম খাদেমুল ইসলাম (গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসা), টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ
প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
প্রশ্ন : পিতামাতার নির্দেশে দাড়ি কাটা যাবে?
উত্তর : কমপক্ষে একমুষ্টি দাড়ি রাখা ইসলামের প্রতীক, মুসলমানিত্বের প্রতীক। নবীজি (সা.) ও সব সাহাবি ও উম্মতে মুসলিমার আমল। এ পরিমাণ দাড়ি রাখা ওয়াজিব। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা মুশরিকদের বিরোধিতা করো, দাড়ি লম্বা করো এবং গোঁফ খাট রাখ।’ আর আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) যখন হজ বা ওমরা করতেন, তখন তিনি তার দাড়ি মুঠ করে ধরতেন, তারপর অতিরিক্ত অংশ কেটে ফেলতেন। (বোখারি : ৫৫৫৩)। আর শরিয়তের বিধান পালন করার ক্ষেত্রে পিতামাতার এ ধরনের কথা জায়েজ নয়। কেননা, রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর নাফরমানি করে কোনো মানুষের আনুগত্য করা জায়েজ নয়।’ (মুসনাদে আহমদ : ১০৬৫)। সুতরাং কারও পিতামাতা যতই অসন্তুষ্ট হোন না কেন, এ ক্ষেত্রে তাদের কথা মানা জায়েজ হবে না। দাড়ি রাখতে হবে।
প্রশ্ন : পাখি, মাছ, বিড়াল, খরগোশ ইত্যাদি জীবজন্তু পালা ও অ্যাকুরিয়ামে মাছ রাখা যাবে?
উত্তর : এমনিতে পশুপাখি পোষা জায়েজ আছে। তবে তাদের সার্বিক দেখাশোনার ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখতে হবে। বাকি এমনিতে অধিক অর্থ ব্যয় করে এসব কেনা অনর্থক খরচ; যা মাকরুহ। তবে বন্যপাখিদের আটকে না রেখে তাদের মুক্ত করে দেওয়া উত্তম। আনাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুল (সা.) সবার চেয়ে বেশি সদাচারী ছিলেন। আমার একজন ভাই ছিল। তাকে আবু উমায়ের ডাকা হতো। আমার ধারণা যে, সে তখন মায়ের দুধ খেত না। যখনই সে রাসুল (সা.)-এর কাছে যেত, তিনি বলতেন, ‘হে আবু উমায়ের! তোমার নুগায়ের কি করছে?’ সে নুগায়ের পাখিটা নিয়ে খেলত। আর প্রায়ই যখন নামাজের সময় হতো আর তিনি আমাদের ঘরে থাকতেন, তখন তার নিচে যে বিছানা থাকত, সামান্য পানি ছিটিয়ে ঝেড়ে দেওয়ার জন্য আমাদের নির্দেশ দিতেন। তারপর তিনি নামাজের জন্য দাঁড়াতেন। আমরাও তার পেছনে দাঁড়াতাম। আর তিনি আমাদের নিয়ে নামাজ আদায় করতেন। (বোখারি : ৬২০৩)। এ হাদিসে পাখি পোষার ঘটনার প্রমাণ রয়েছে।
প্রশ্ন : খাঁচাবন্দি করে পাখি লালন-পালন করার বিধান কী?
উত্তর : যেসব পাখি খাঁচাতেই জন্মায় এবং এখানেই বড় হয়, অর্থাৎ (ওড়া পাখি নিয়ে এসে বন্দি করা হয়েছে এমন নয়), এসব পালিত পাখিকে নিয়মিত খাবার, পানি ও চিকিৎসা দিয়ে সুন্দরভাবে পরিচর্যা করতে পারলে খাঁচায় রেখে লালন-পালন করা জায়েজ হবে। কয়েকজন সাহাবির থেকে খাঁচায় পাখি লালন-পালন করা প্রমাণিত রয়েছে। হিশাম ইবনে উরওয়া (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.) মক্কায় ছিলেন। তখন সাহাবিরা খাঁচায় পাখি রাখতেন। (আল আদাবুল মুফরাদ : ৩৮৩)। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যথাযথ পরিচর্যা করতে হবে। পরিচর্যা করতে না পারলে অথবা বন্দি করে রাখার কারণে কষ্ট পেলে খাঁচায় আটকে রাখা জায়েয হবে না; বরং ছেড়ে দিতে হবে। প্রকাশ থাকে যে, বাইরে উড়ে বেড়ায় এমন পাখিকে খাঁচায় বন্দি করলে তাদের কষ্ট হতে পারে। তাই এ ধরনের পাখি খাঁচায় বন্দি না করা উচিত। (বোখারি : ৬২০৩, ফাতহুল বারি : ১০/৬০১, ফতোয়ায়ে কারিইল হেদায়া : ২০০, রদ্দুল মুহতার : ৬/৪০১)।
প্রশ্ন : অ্যালকোহলযুক্ত সুগন্ধি ব্যবহার কি জায়েজ? এগুলো শরীরে ব্যবহার করা অবস্থায় নামাজ আদায় করা যাবে?
উত্তর : অ্যালকোহলমুক্ত যেসব সুগন্ধি বা পারফিউম পাওয়া যায়, তা ব্যবহার করাই উত্তম ও শ্রেয়। অ্যালকোহলযুক্ত সুগন্ধি ব্যাবহার করা জায়েজ আছে কি-না, তা জানার জন্য আগে মদ বা অ্যালকোহলের বিধান জানা জরুরি। ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতে, মদ বা অ্যালকোহল হলো, যা আঙ্গুরের কাঁচা রস থেকে তৈরি হয়। এটি যখন ভালোভাবে জ্বাল দেওয়া হয়, তখন তা মদ হয়। মোটকথা, যে মদ বা অ্যালকোহেলের উপাদান আঙ্গুর, সেটাই মদ। এটি নাপাক। এটি কেনাবেচা, ব্যবহার অল্প বা বেশি নেশা হোক বা না হোক, সবই হারাম। এ ব্যাপারে সবাই একমত। আরেকটি কথা হলো, এমন মদ যার উপাদান খেজুর বা কিসমিস, এটিও হারাম। অল্প বা বেশি পান হারাম। তবে এর নিষিদ্ধতা প্রথমটার মতো মজবুত নয়। তাই এ ধরনের মদ্যপায়ীর ওপর ইসলামি হদ (শাস্তি) কার্যকর হয় না। এ কারণে তা বৈধ উদ্দেশ্যে বিক্রি জায়েজ। যেমন- মেডিসিনের ব্যবহারের জন্য উক্ত প্রকার অ্যালকোহল বেচাকেনা করা। তবে ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ (রহ.)-এর মতে এটিও বিক্রি জায়েজ নয়। তৃতীয় প্রকার অ্যালকোহল হলো, যার উপাদান উপরোক্ত বস্তু ছাড়া অন্যকিছু। যেমন- গম, যব বা অন্য কোনো শস্য, মধু ইত্যাদি। এসব অ্যালকোহেলর বিধান হলো, নেশা উদ্রেক করে না- এ পরিমাণ ব্যবহার করা বৈধ। নেশা উদ্রেক করে- এ পরিমাণ ব্যবহার করা বৈধ নয়। এটি ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) উভয়ের মত। বর্তমান সময়ে বিশ্বের অন্যতম ইসলামিক স্কলার শাইখুল ইসলাম মুফতি তাকি এ বিষয়ে যা লিখেছেন, ‘বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে অ্যালকোহল ব্যবহার করা হচ্ছে। বিভিন্ন ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। রাসায়নিক বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। বহু শিল্প-কারখানা অ্যালকোহলের ব্যবহার করা ছাড়া চলা সম্ভব নয়। এককথায়, বর্তমান সময়ে বহু মানুষ এর সঙ্গে জড়িত। এর প্রচণ্ড প্রয়োজন রয়েছে। এখন আমাদের দেখার বিষয়, যদি এসব অ্যালকোহল আঙ্গুরের কাঁচা রস থেকে তৈরি না হয়, তবে তা বৈধ কাজে ব্যবহার করা ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতে বৈধ। ইনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকায় বর্তমান বিশ্বে অ্যালকোহল কীসের থেকে তৈরি হয়, এর একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে। সে তালিকায় মধু, শস্য, যব, আনারসের রস, গন্ধক ও সালফেট অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান রয়েছে। তবে তাতে কোথাও আঙ্গুর বা খেজুরের কথা নেই। সারকথা, ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর মতানুযায়ী বাজারে প্রচলিত অ্যালকোহল যদি খেজুর ও আঙ্গুর থেকে প্রস্তুত না হয়, তবে তা বৈধ কাজের উদ্দেশ্যে ব্যবহার বৈধ হবে। নেশার উদ্রেক হয় না- এ পরিমাণ ব্যবহার করা যাবে। আর এটিই স্বাভাবিক সত্য যে, বর্তমানে অধিকাংশ অ্যালকোহল আঙ্গুর ও খেজুর থেকে তৈরি হয় না। সুতরাং এসব বৈধ উদ্দেশ্যে বেচাকেনা করা যাবে। তদ্রƒপ ওষুধ তৈরিতে বা চিকিৎসায়ও ব্যবহার করা যাবে। অন্যান্য কাজেও ব্যবহার করা যাবে।’ (তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম : ১/৩৪৮, ৩/৩৩৭, ফিকহুল বুয়ু : ১/২৯৮)। উল্লেখ্য, যদি কোনো অ্যালকোহলের ব্যাপারে প্রমাণিত হয় যে, তা আঙ্গুর ও খেজুর থেকে তৈরি, তাহলে তা ব্যবহার করা যাবে না।