মক্কা শরিফের জুমার খুতবা
ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব
শায়খ ড. উসামা বিন আবদুল্লাহ খাইয়াত
প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
পার্থিব জ্ঞান যদি মানব জীবনের উন্নতি-অগ্রগতির মূলভিত্তি হয়, তাহলে আল্লাহতায়ালার প্রিয় বান্দাদের কাছে বিদ্যমান অহির জ্ঞান ও বিদ্যা আরও বেশি মূল্যবান ও সফলতার চাবিকাঠি। আর জান্নাতে যাওয়ার সহজ মাধ্যম ও পন্থা। নবীজি (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইলম হাসিলের জন্য পথে বের হয়, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দেন। যখন কোনো সম্প্রদায় আল্লাহর ঘরগুলোর কোনো একটিতে সমবেত হয়ে আল্লাহর কিতাব তেলাওয়াত করে এবং পরস্পরে তার পর্যালোচনায় নিয়োজিত থাকে, তখন তাদের ওপর প্রশান্তি অবতীর্ণ হয়। রহমতের শামিয়ানা তাদের আচ্ছাদিত করে এবং ফেরেশতারা তাদের পরিবেষ্টন করে রাখেন। আর আল্লাহতায়ালা তাঁর নৈকট্যধারীদের (ফেরেশতাদের) মধ্যে তাদের আলোচনা করেন। আর যে ব্যক্তির আমল তাকে পিছিয়ে দেবে, তার বংশ মর্যাদা তাকে এগিয়ে নিতে পারবে না।’ (মুসলিম : ৬৬০৮)।
ইলমে দ্বীন সফলতার মাধ্যম
ইলমে দ্বীন ও অহির বিদ্যা দুনিয়া ও আখেরাতের সফলতার মাধ্যম। মুআজ (রা.) বলেন, জ্ঞান মূর্খতা থেকে অন্তরে জীবন দানের মতো। চক্ষুষ্মানদের আলোকবর্তিকা। এর মাধ্যমে কোনো বান্দা দুনিয়া ও আখেরাতের সর্বোত্তম স্তরে পৌঁছাতে পারে। এর মাধ্যমেই হালাল-হারাম জানা যায়। ইলম আমলের সব মূল। আমল হলো তার অনুগামী। সৌভাগ্যবান ব্যক্তি এর মাধ্যমে প্রশান্তি পায়। আর দুর্ভাগা হয় বঞ্চিত। ইলমের এত সম্মান ও মর্যাদা এবং বৈশিষ্ট্য যে, কোরআনের প্রথম আয়াত ইলম অর্জনের ব্যাপারে নাজিল হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, পড় তোমার রবের নামে। যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট রক্ত দ্বারা। পাঠ কর, তোমার পালনকর্তা মহাদয়ালুর নামে। যিনি কলম দিয়ে শিক্ষা দিয়েছেন। মানুষকে এমন জ্ঞান শিখিয়েছেন, যা সে জানত না।’ (সুরা আলাক : ১-৫)।
আলেমদের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব
আল্লাহতায়ালা বিশেষভাবে ইলম ও আলেমের মর্যাদা উল্লেখ করেছেন। তাদের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করেছেন। আলেম ও গায়রে আলেম কখনও এক হতে পারে না বলে ঘোষণা করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তবে কি (এরূপ ব্যক্তি সেই ব্যক্তির সমতুল্য হতে পারে) যে রাতের মুহূর্তগুলোতে ইবাদত করে কখনও সেজদাবস্থায়, কখনও দাঁড়িয়ে, যে আখেরাতকে ভয় করে এবং নিজ প্রতিপালকের রহমতের আশা করে? বল, যারা জানে আর যারা জানে না, উভয়ে কি সমান? উপদেশ গ্রহণ তো শুধু বোধসম্পন্ন ব্যক্তিরাই করে।’ (সুরা জুমার : ৯)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘মানুষ, পশু ও চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যেও আছে অনুরূপ বর্ণ-বৈচিত্র্য। আল্লাহকে তো শুধু তারাই ভয় করে, যারা জ্ঞানের অধিকারী। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী, অতি ক্ষমাশীল।’ (সুরা ফাতির : ২৮)।
জ্ঞানী মূর্খ এক নয়
আল্লাহতায়ালা আলেমদের তাকে ভয় করার আসল স্তর দান করেছেন। অর্থাৎ আলেমরা আল্লাহর পূর্ণ ক্ষমতা, তাঁর পূর্ণ গুণাবলি সম্পর্কে বেশি অবগত হওয়ায় অন্যদের তুলনায় আল্লাহকে আলেমরাই বেশি ভয় করে। আল্লাহতায়ালা আলেমদের দৃষ্টিমানদের সঙ্গে তুলনা করেছেন। মূর্খদের অন্ধকারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তেমনিভাবে ইলম ও ঈমানকে নূর ও আলোর সঙ্গে তুলনা করেছেন। কুফরকে অন্ধকারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। ঈমানদার ব্যক্তি কখনও আল্লাহভোলা ও পথভ্রষ্টের পথে চলে না। তারা কখনও এক হতে পারে না। তাদের অন্তর মৃত। ফলে তাতে কোনো কিছু ক্রিয়াশীল হয় না। সৎপথ প্রদর্শনকারীদের ডাকে তারা সাড়া দেয় না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘অন্ধ ও চক্ষুষ্মান সমান হতে পারে না। অন্ধকার ও আলোও না। আর ছায়া ও রোদও নয়। সমান হতে পারে না জীবিত ও মৃত। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা শুনিয়ে দেন। যারা কবরে আছে, তুমি তাদের শোনাতে পারবে না।’ (সুরা ফাতির : ১৯-২২)।
তালিবুল ইলমের জন্য সবাই দোয়া করে
আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাদের থেকে তাঁর একত্ববাদের সাক্ষ্যদানের সঙ্গে আলেমদের সাক্ষ্যদানের বিষয় ও শ্রেষ্ঠত্বের কারণে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ স্বয়ং এ বিষয়ের সাক্ষ্য দেন এবং ফেরেশতারা ও জ্ঞানীরাও যে, তিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, যিনি ইনসাফের সঙ্গে (বিশ্বজগতের) নিয়মণ্ডশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করছেন। তিনি ছাড়া অন্য কেউ ইবাদতের উপযুক্ত নয়। তাঁর ক্ষমতা পরিপূর্ণ এবং হেকমতও পরিপূর্ণ।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৮)। আলেমদের মর্যাদার ব্যাপারে আবু উমামা বাহেলি (রা.) সূত্রে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, দুজন লোকের ব্যাপারে রাসুল (সা.)-এর কাছে আলোচনা করা হলো। তাদের একজন সাধক, অন্যজন আলেম। রাসুল (সা.) বললেন, ‘তোমাদের সাধারণ ব্যক্তির ওপর আমার যতখানি মর্যাদা, তেমনি একজন আলেমের মর্যাদা একজন আবেদের ওপর।’ তারপর রাসুল (সা.) বললেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ এবং আসমান-জমিনের অধিবাসীরা, এমনকি গর্তের পিঁপড়া এবং পানির মাছ পর্যন্ত সেই ব্যক্তির জন্য দোয়া করে, যে মানুষকে কল্যাণকর জ্ঞান শিক্ষা দেয়।’ (তিরমিজি : ২৬৮২)। আলেমরা নবীর ওয়ারিশ। এ কথার দ্বারাই তাদের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব অনুমেয় হয়। তবু রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি এমন পথে গমন করে, যাতে সে জ্ঞানার্জন করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সুগম করে দেন। আর ফেরেশতারা তালিবে ইলমের জন্য তার কাজে প্রসন্ন হয়ে নিজেদের ডানাগুলো বিছিয়ে দেন। অবশ্যই আলেমের জন্য আকাশ-পৃথিবীর সব বাসিন্দা এমনকি পানির মাছ পর্যন্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে। আবেদের ওপর আলেমের ফজিলত ঠিক তেমনি, যেমন সমগ্র নক্ষত্রপুঞ্জের ওপর পূর্ণিমার চাঁদের ফজিলত। ওলামা সম্প্রদায় পরগম্বরদের উত্তরাধিকারী। আর এ কথা সুনিশ্চিত যে, পয়গম্বররা কোনো রৌপ্য বা স্বর্ণ মুদ্রার কাউকে উত্তরাধিকারী বানিয়ে যাননি; বরং তারা ইলমের (দ্বীনি জ্ঞানভাণ্ডারের) উত্তরাধিকারী বানিয়ে গেছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি তা অর্জন করল, সে পূর্ণ অংশ লাভ করল।’ (মুসলিম : ১৩৯৬)।
বড়দের চোখে ইলমের মর্যাদা
ইবনে শিহাব জুহরি (রহ.) বলেন, সারারাত একাকী কাটানোর চেয়ে কিছু সময় ইলমে বুৎপত্তি অর্জনের জন্য কাটানো অতি উত্তম। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) যখন কোনো তালিবে ইলমকে দেখতেন, তখন তাকে সুস্বাগতম জানিয়ে তার ভরপুর প্রশংসা করতেন। সুতরাং জ্ঞান আহরণকারী প্রত্যেকের জন্য আবশ্যক হলো, ইলম অর্জনে তার নিয়ত পরিশুদ্ধ করা এবং ইলম দ্বারা যেন আল্লাহর সন্তুষ্ট উদ্দেশ্য হয়, দুনিয়ার কোনো যশ-খ্যাতি, কোনো অহংকার ও বড়ত্ব যেন কখনোই তার উদ্দেশ্য না হয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা আলেমদের ওপর বাহাদুরি প্রকাশের জন্য, নির্বোধদের সঙ্গে ঝগড়া করার জন্য এবং জনসভার ওপর বড়ত্ব প্রকাশ করার জন্য ধর্মীয় জ্ঞান শিক্ষা করো না। যে ব্যক্তি এরূপ করবে, তার জন্য রয়েছে আগুন আর আগুন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৫৪)। যেমনিভাবে তালিবে ইলমেকে এ কথা স্মরণ করে রাখতে হবে, যেহেতু শক্তিশালী মোমিন ব্যক্তি দুর্বল মোমিনের চেয়ে আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয় এবং সর্বোত্তম, সুতরাং আল্লাহর কাছে প্রিয় শক্তি হলো মোমিনের কর্ম ও জ্ঞানের শক্তি। এ ইলমের কারণেই আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়া যায়। পাশাপাশি লেগে থাকা সূক্ষ্ম বিষয়ে গবেষণা করা, দুর্বোধ্য বিষয়ের সমাধান করা, কঠিন ও জটিল বিষয়গুলোতে কর্ম ও জ্ঞান দ্বারা জ্ঞানের মাধ্যমে সহায়তা করা সম্ভব।
২৩ মহররম ১৪৪৫ (১১ আগস্ট ২০২৩) তারিখে মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন - মুহাম্মাদুল্লাহ ইয়াসিন