বন্ধু নির্বাচনে নির্দেশনা
মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
প্রকাশ : ২৫ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
সফলতাকামী মোমিনের বন্ধু হবে সৎ, বিশ্বস্ত, নীতিবান, ধর্মপ্রাণ, পরহেজগার, বিচক্ষণ এবং সত্যবাদী। তাহলে ধীরে ধীরে এসব গুণ নিজের মধ্যেও প্রভাব বিস্তার করবে। তাই তো আল্লাহতায়ালা সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘হে মোমিনরা! আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গে থাকো।’ (সুরা তওবা : ১১৯)। বুদ্ধিমান মোমিন এমন সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিদেরই সাহচর্য অবলম্বন করবে, যারা মুখেও সত্য বলে এবং কাজেও সততার পরিচয় দেয়। সে-ই উত্তম বন্ধু, যে অন্য বন্ধুকে নেক কাজে সহযোগিতা করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মোমিন নর-নারী পরস্পর একে অন্যের সহযোগী। তারা সৎ কাজের আদেশ করে ও অসৎ কাজে বাঁধা দেয়, নামাজ কায়েম করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য করে। তারা এমন লোক, যাদের প্রতি আল্লাহ নিজ রহমত বর্ষণ করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমতাধর ও প্রজ্ঞাবান।’ (সুরা তওবা : ৭১)। মানুষ তার চারপাশের পরিবেশ প্রকৃতি এবং বন্ধু-বান্ধবের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়। বন্ধুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, চিন্তাচেতনা এবং মন-মানসিকতার প্রতিফলন ঘটে অন্যের মধ্যে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘মানুষ তার বন্ধুর ধ্যান-ধারণার অনুসারী হয়ে থাকে। সুতরাং তোমাদের খেয়াল রাখা উচিত, কে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করছে!’ (তিরমিজি : ২৩৭৮)।
সৎসঙ্গ ও অসৎ সঙ্গের প্রভাব
চরিত্রবান বন্ধুর মধুময় সম্পর্ক একদিকে যেমন সুস্থ ও নিরাপদ জীবন বিনির্মাণে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে, তেমনি অসৎ চরিত্রহীন বন্ধুর কুপ্রভাব আলোকিত জীবনকে কলুষিত করে। তাই তো বলা হয়- সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ। সন্দেহ নেই, অসৎ সঙ্গ জীবনবিনাশী মহামারি। খারাপ বন্ধু মানুষকে সরল পথ থেকে বিচ্যুত করে। ধাবিত করে অবৈধ, অশোভন এবং অনৈতিক কাজের দিকে। তাই এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের যথেষ্ট সচেতন হতে হবে। গভীর দৃষ্টিতে অধীনস্থদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের প্রত্যেকেই অধীনস্থদের দায়িত্বশীল। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। তোমাদের প্রত্যেককেই তার অধীনস্থদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (আল আদাবুল মুফরাদ : ২০৫)।
খারাপ সঙ্গীর চেয়ে একা থাকাই শ্রেয়
প্রতিবেশী ও সফর সঙ্গীর আচার-আচরণে মানুষ প্রভাবিত হয়। তাই বিশ্ব মানবতার চির বিশ্বস্ত বন্ধু মহানবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা পথ চলার আগে সঙ্গী সন্ধান করো এবং বাড়ির আগে প্রতিবেশীর খোঁজ নাও।’ (আল মুজামাল কাবির : ৪২৭৯)। অসৎ সঙ্গী অপেক্ষা একা থাকাই শ্রেয়। কেননা, সে সহচরকে বিপথগামী করবে, উদ্বুদ্ধ করবে গর্হিত কর্মে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘খারাপ সঙ্গীর চেয়ে একাকী থাকাই উত্তম। আর একাকী থাকার চেয়ে ভালো সঙ্গীর সঙ্গে থাকা ভালো।’ (আল মুসতাদরাক আলাস সহিহাইন : ৫৫৬৩)। অবশ্য খারাপ মানুষকে ভালো করার উদ্দেশে তার সঙ্গে সতর্ক হয়ে চলাফেরা ও মেলামেশা করা উত্তম কাজ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে মুসলমান মানুষের সঙ্গে মেশে এবং মিশতে গিয়ে কষ্টের শিকার হয়ে ধৈর্য ধারণ করে, সে ওই মুসলমানের চেয়ে উত্তম, যে মানুষের সঙ্গে মিশেও না এবং এ পথে কষ্টের শিকার হয়ে ধৈর্যও ধারণ করে না।’ (বায়হাকি : ৯৭৩০)।
অসৎ বন্ধু মূলত শত্রু
বন্ধুত্ব অনেক সময় ডেকে আনতে পারে পরকালের অনিঃশেষ যন্ত্রণা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যেদিন জালেম ব্যক্তি (মনস্তাপে) নিজের হাত কামড়াবে এবং বলবে, হায়! আমি যদি রাসুলের সঙ্গে একই পথ অবলম্বন করতাম। হায়! আমাদের দুর্ভোগ, আমি যদি অমুক ব্যক্তিকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। আমার কাছে তো উপদেশ এসে গিয়েছিল। কিন্তু সে (ওই বন্ধু) আমাকে তা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল। আর শয়তান তো এমনই চরিত্রের, যে সময়কালে মানুষকে অসহায় অবস্থায় ফেলে চলে যায়।’ (সুরা ফোরকান : ২৭২৯)। অসৎ বন্ধু কেয়ামতের দিন কাল হয়ে দাঁড়াবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সেদিন মুত্তাকিরা ছাড়া অন্য বন্ধুরা একে অন্যের শত্রু হয়ে যাবে।’ (সুরা যুখরুফ : ৬৭)। কাজেই বন্ধুত্ব রক্ষায় আল্লাহর অবাধ্য হওয়া, শরিয়তের সীমা লঙ্ঘন করা যাবে না। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তুমি তোমার বন্ধুকে ভালোবাসতে সীমা ছাড়িয়ে যেও না। হয়তো এ বন্ধুই একদিন তোমার শত্রু হবে। তুমি তোমার শত্রুর প্রতি ঘৃণা ও শত্রুতার সীমা ছাড়িয়ে যেও না। হয়তো একদিন এ শত্রুই তোমার বন্ধু হবে।’ (তিরমিজি : ১৯৯৭)।
বন্ধু নির্ণয়ের কষ্টিপাথর
বন্ধু নির্বাচনের কষ্টিপাথর হচ্ছে, তার আচরণের ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা। প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক হলে ভালো বন্ধু, অন্যথায় মন্দ। এক টুকরো মাটি যখন সুবাসিত ফুলের সান্নিধ্য পায়, তখন তা পুষ্প সৌরভে মুগ্ধ করে মানুষের মন-মনন। আবার ডাস্টবিন কিংবা নর্দমায় পড়া গোলাপ ফুল হারায় মনোমুগ্ধকর আপন সুবাস। সৌরভহীন ওই ফুল কুড়িয়ে নেয় না কোনো পুষ্পপ্রেমিক। মান ব্যবধানের এ গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে সান্নিধ্য ও সাহচর্যের কররেখায়। মানব ও মানবতার শ্রেষ্ঠ বন্ধু প্রিয়নবী (সা.) সহচর্যের প্রভাবের বিষয়টি চমৎকার উপমা দিয়ে উপস্থাপন করেছেন, ‘সৎ সঙ্গী ও অসৎ সঙ্গীর দৃষ্টান্ত হলো, আতর বিক্রেতা ও কামারের হাঁপরের মতো। আতর বিক্রেতা হয়তো তোমাকে কিছু দান করবে কিংবা তার কাছ থেকে তুমি কিছু কিনবে অথবা তার কাছ থেকে তুমি সুবাস পাবে। আর কামারের হাঁপর হয়তো তোমার কাপড় পুড়িয়ে দেবে কিংবা তার কাছ থেকে দুর্গন্ধ পাবে।’ (বোখারি : ৫৫৩৪)।
বন্ধুত্ব হোক আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে
বন্ধুত্ব নিছক প্রথাগত বিষয় নয়; বরং একটি শ্রেষ্ঠ ইবাদত। তাই বন্ধুত্ব করতে হবে পরকালের কল্যাণে, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায়। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসে, আল্লাহর জন্য কাউকে অপছন্দ করে এবং আল্লাহর জন্য কাউকে দান করে বা না করে, সে তার ঈমান পূর্ণ করল।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪৬৮১)। তাই তো মোমিনকে ছেড়ে কাফেরের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মোমিনরা যেন মোমিনদের ছেড়ে কাফেরদের নিজেদের মিত্র ও সাহায্যকারী না বানায়। যে এরূপ করবে, আল্লাহর সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে তাদের (জুলুম) থেকে বাঁচার জন্য যদি আত্মরক্ষামূলক কোনো পন্থা অবলম্বন করো, সেটা ভিন্ন কথা।’ (সুরা আলে ইমরান : ২৮)।