ঢাকা ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মক্কা শরিফের জুমার খুতবা

আল্লাহর ‘ওয়াদুদ’ নামের মহিমা

শায়খ ড. মাহের আল মুআইকিলি
আল্লাহর ‘ওয়াদুদ’ নামের মহিমা

আল্লাহকে চেনা, তাঁর নাম গুণ ও কার্যাবলি সম্পর্কে অবগত হওয়া ঈমানের সারকথা, নবী-রাসুলদের দাওয়াতের চূড়ান্ত ফলাফল। বান্দা যখন রবকে চিনবে, তখন নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর একত্ব মেনে নেবে, তাঁর আনুগত্যের জন্য পরিশ্রম করবে, তাঁর অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকবে। আল্লাহকে চিনলে তাঁর প্রতি সম্মানবোধ ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে। তাঁর সঙ্গে এক হার্দিক সম্পর্ক স্থাপিত হবে- তাঁকে দেখার জন্য, তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠবে। যে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ভালোবাসে, আল্লাহও তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ভালোবাসেন।

আল্লাহর রয়েছে ৯৯টি নাম। যে তা আত্মস্থ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আল্লাহ কোরআনুল কারিমে আপন সত্তার প্রশংসা করেছেন। তিনি নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, ‘তিনি ক্ষমাশীল, প্রেমময়, সুমহান আরশের অধিপতি।’ (সুরা বুরুজ : ১৪-১৫)। শুয়াইব (আ.)-এর বক্তব্য বিবৃত করে আল্লাহতায়ালা আরো বলেন, ‘তোমরা নিজেদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। এরপর তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তন করো। নিশ্চয় আমার রব দয়াশীল, প্রেমময়।’ (সুরা হুদ : ৯০)।

ওয়াদুদ নামের অর্থ

আল্লাহতায়ালা ওয়াদুদ। ওয়াদুদ শব্দটি আরবি ‘মাওয়াদ্দাতুন’ ক্রিয়ামূল থেকে গঠিত। ‘মাওয়াদ্দাতুন’ অর্থ প্রেম। সাধারণ ভালোবাসার চেয়েও এর স্তর ঊর্ধ্বে। ওয়াদুদ বলা হয়, খাঁটি ভালোবাসার অধিকারীকে। আল্লাহতায়ালা প্রেমময়। বান্দাদের সীমাহীন ভালোবাসেন। বান্দাদের প্রতি অত্যন্ত স্নেহশীল। তিনি আমাদের নেয়ামতের সাগরে ডুবিয়ে রেখেছেন। এ বিশ্বচরাচরে যা কিছু আছে, সব তাঁর দয়া অনুগ্রহ ও সুমহান প্রেমের প্রকাশ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে যা কিছু আছে, সব তিনি তোমাদের সেবায় নিয়োজিত রেখেছেন। এর সবই তাঁর পক্ষ থেকে। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে বহু নিদর্শন।’ (সুরা জাছিয়া : ১৩)।

আল্লাহর ভালোবাসার নমুনা

আল্লাহতায়ালা বান্দাদের ইসলামের দিকে পথপ্রদর্শন করেছেন। ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ করেছেন। বান্দাদের কষ্ট-ক্লেশ দূর করেছেন। তাঁর স্মরণ ও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের আদেশ করেছেন। যে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করবে, তাকে নেয়ামত বাড়িয়ে দেওয়ার ওয়াদা করেছেন। তিনি বান্দার কল্যাণে সদা আগ্রহী। এর সবই তাঁর সুমহান অনুগ্রহের অংশ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা আমাকে স্মরণ করো, আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করো, অকৃতজ্ঞ হয়ো না।’ (সুরা বাকারা : ১৫২)।

তিনি পাপীদের প্রতিও দয়াশীল

সন্দেহ-সংশয় অনেককে ঘিরে ধরেছে। পাপাচারে লিপ্ত হয়ে নিজের জীবন অপচয় করে ফেলছে। প্রেমময় মালিক কোমল ভাষায়, সুন্দর সতর্কীকরণের মাধ্যমে তাদের সম্বোধন করে বলছেন, ‘বলো, হে আমার সেসব বান্দা! যারা নিজেদের ওপর জুলুম করেছ; তোমরা আল্লাহর করুণা থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সব পাপ ক্ষমা করেন। তিনিই ক্ষমাশীল, পরম করুণাময়।’ (সুরা যুমার : ৫৩)। আল্লাহ দয়ালু, করুণাময়, ধৈর্যশীল। বান্দা অবাধ্যতা করে, তবুও তিনি তাকে নিজের দুয়ারে আহ্বান করেন। অপরাধ করে, তবুও তাঁর করুণার দ্বার রুদ্ধ হয় না। অবিরাম তাঁর কল্যাণের বারিধারা বর্ষিত হচ্ছে। বান্দাকে তিনি ক্ষতি থেকে হেফাজত করছেন। বান্দার প্রতি ধৈর্যের প্রকাশ ঘটাচ্ছেন। তাদের দোষ-ত্রুটি গোপন করছেন। রাতের বেলা তিনি বান্দাদের প্রতি নিজের হাত প্রসারিত করেন, যেন রাতের অপরাধীরা তওবা করে। দিনের বেলা হাত প্রসারিত করেন, যাতে দিনের অপরাধীরা তওবা করতে পারে। প্রতি রাতেই তিনি নেমে আসেন পৃথিবীর আসমানে (যেভাবে নেমে আসাটা তার সত্তার মর্যাদার সঙ্গে সামঞ্জস্যশীল); যখন রাতের এক-তৃতীয়াংশ বাকি থাকে, তিনি ঘোষণা দেন, ‘যে আমাকে আহ্বান করবে, আমি তার আহ্বানে সাড়া দেব। যে আমার কাছে কিছু চাইবে, আমি তাকে তা দান করব। যে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব।’

আল্লাহ তওবাকারীকে ভালোবাসেন

তওবা করলে, বান্দা আল্লাহর প্রিয়ভাজন হয়ে যায়। কারণ, আল্লাহ তওবাকারীকে ভালোবাসেন। তওবাকারীদের জন্য রয়েছে তাঁর বিশেষ ভালোবাসা। বান্দার তওবায় আল্লাহ খুশি হন। অথচ তিনি এর মুখাপেক্ষী নন। আল্লাহর করুণা সুপ্রশস্ত। তিনি এই করুণা লাভের উপায়ও বলে দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে, ‘আমার দয়া সবকিছুতে পরিব্যাপ্ত। আমি তা নির্ধারণ করব তাদের জন্য, যারা ভয় করে, জাকাত আদায় করে আর যারা আমার নিদর্শনসমূহে বিশ্বাস রাখে।’ (সুরা আরাফ : ১৫৬)। আল্লাহর সত্তা প্রেমময়, তিনি প্রিয়জনদের প্রতি স্নেহশীল। তাদের জন্য তাঁর উপচেপড়া ভালোবাসা। আল্লাহ মোমিনদের ভালোবাসেন। মোমিনরাও তাঁকে ভালোবাসে। মোমিনরা তাঁকে ভালোবাসে তাঁর একত্বে বিশ্বাস স্থাপন ও তাঁর রাসুল (সা.)-এর অনুসরণের মাধ্যমে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বলো, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমার অনুসরণ করো; আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপগুলো ক্ষমা করে দেবেন। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা আলে ইমরান : ৩১)

সৃষ্টির ভালোবাসা লাভের উপায়

বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি সন্ধানে ব্যাপৃত থাকে; এক পর্যায়ে আল্লাহর ভালোবাসা লাভে ধন্য হয়, তার নৈকট্য অর্জন করে। যখন আল্লাহ কাউকে ভালোবাসেন, সৃষ্টির কাছেও তাকে প্রিয় করে তোলেন। বান্দা যখন নিজের হৃদয় আল্লাহর দিকে ধাবিত করে, সৃষ্টিকুলের হৃদয়ও আল্লাহ তার দিকে ধাবিত করে দেন। সাহল ইবনে আবু সালেহ সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন; হজের মৌসুম। আমরা আরাফায়। ওমর ইবনে আবদুল আজিজ সেখান দিয়ে যাচ্ছেন। লোকেরা তাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল। তাকে ভক্তি-শ্রদ্ধার নজরে দেখতে লাগল। আমি আমার পিতাকে বললাম, ‘বাবা! আমার মনে হয়, আল্লাহ ওমর ইবনে আবদুল আজিজকে ভালোবাসেন।’ বাবা বললেন, ‘কীভাবে বুঝলে?’ বললাম, ‘কারণ, মানুষের অন্তরে দেখুন তার জন্য কী পরিমাণ ভালোবাসা!’ তখন আমার বাবা বললেন, ‘আমি আবু হুরায়রা (রা.)-কে রাসুল (সা.)-এর কাছ থেকে বর্ণনা করতে শুনেছি, যখন আল্লাহ কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন, জিবরাইল (আ.)-কে ডেকে বলেন, আল্লাহ অমুক বান্দাকে ভালোবাসেন, তুমিও তাকে ভালোবাসো। ফলে জিবরাইল (আ.) তাকে ভালোবাসেন। জিবরাইল (আ.) আবার আসমানের ফেরেশতাদের ডেকে বলেন, আল্লাহ অমুককে ভালোবাসেন, তোমরাও তাকে ভালোবাসো। ফলে আসমানের ফেরেশতারা তাকে ভালোবাসতে শুরু করে। এভাবে পৃথিবীতেও তার সর্বব্যাপী গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়।’ (মুসলিম)।

মৃত্যুর পরও তাঁর ভালোবাসা জারি থাকে

ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)-এর কিতাবুয যুহদে এসেছে, এক বুজুর্গকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘আপনার সকাল কেমন কাটল?’ তিনি বললেন, ‘আমি দুটো নেয়ামতের মাঝে সকাল কাটিয়েছি। জানি না, দুটোর কোনটি শ্রেষ্ঠ! একটি হলো, আমার অনেক গোনাহ আছে, আল্লাহ তা গোপন রেখেছেন; কোনো মানুষ সেসবের কারণে আমাকে লজ্জা দিতে পারেনি। আরেকটি হলো, আল্লাহ মানুষের হৃদয়ে আমার প্রতি ভালোবাসা জাগ্রত করে দিয়েছেন; অথচ আমার আমল ঠিক অতটা নয় যে, আমি মানুষের এত ভালোবাসা পেতে পারি।’ আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা ঈমান আনে ও নেক আমল করে, আল্লাহ তাদের জন্য ভালোবাসা বরাদ্দ করে রাখেন।’ (সুরা মারইয়াম : ৯৬)। এ ভালোবাসা তারা পরজগতে যেমন লাভ করবে, লাভ করবে ইহজগতেও। বান্দার প্রতি আল্লাহর ভালোবাসা মৃত্যুর পরও জারি থাকে। মৃত্যুর সময় যখন উপস্থিত হয়, যখন চোখ ছিটকে বেরুনোর উপক্রম হয়, গলার মাঝে গড়গড় আওয়াজ শুরু হয়, মোমিনের জন্য সেই সময়ে আল্লাহর ভালোবাসা প্রাপ্তির সুসংবাদ রয়েছে। সেই তখনও আল্লাহ মোমিনের ওপর দয়া করেন। তার ওপর আল্লাহর করুণা বর্ষিত হতে থাকে। মোমিনকে যখন কবরে রাখা হয়, তার জন্য দৃষ্টির প্রান্তসীমা পর্যন্ত কবরকে প্রশস্ত করে দেওয়া হয়। তার কবর পরিণত হয় জান্নাতের বাগিচায়। যখন মানুষ কবর থেকে খালি পায়ে, উলঙ্গ, খতনাবিহীন বেরুবে, তখন ফেরেশতারা মোমিনদের সঙ্গে মিলিত হবে। তাদের অভিনন্দন জানাবে, সুসংবাদ দেবে। এ সবই মোমিনদের প্রতি আল্লাহর ভালোবাসার প্রকাশ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ নির্ধারিত হয়ে আছে, তাদের জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে। তারা তার ক্ষীণতম শব্দও শুনতে পাবে না। তারা নিজেদের ইচ্ছেমতো জীবনযাপনের মাঝে চিরস্থায়ীভাবে বসবাস করবে। মহাভীতি তাদের বেদনাহত করবে না। ফেরেশতারা তাদের সঙ্গে এসে সাক্ষাৎ করবে আর বলবে, এটা হলো তোমাদের সেদিন, যার ওয়াদা তোমাদের সঙ্গে করা হয়েছিল।’ (সুরা আম্বিয়া : ১০১-১০৩)।

মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন - মুইনুল ইসলাম

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত