জবান সংযত রাখুন
আবদুল্লাহ নোমান
প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
জবানের সদ্ব্যবহার মানবীয় মহৎ গুণগুলোর অন্যতম। এর ইহকালীন ও পরকালীন বহুবিধ উপকারিতা রয়েছে। সংযত ব্যবহারগুলো কল্যাণের আঁধার। যারা জবানের সদ্ব্যবহার করে, তারা সুখময় জীবন লাভ করে। সফলতা তাদের পদচুম্বন করে। সবখানে তারা বরিত ও সমাদৃত হয়। বাকশক্তি আল্লাহতায়ালার অমূল্য নেয়ামত। এ নেয়ামতকে কাজে লাগিয়ে মানুষ অর্জন করতে পারে ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি। পক্ষান্তরে এর অপব্যবহার উভয় জাহানে ডেকে আনে ভয়াবহ বিপদ, ঘোর অমানিশা, বিষাদময় জীবন। সামাজিক অবক্ষয়, পারিবারিক কোন্দল, পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ ও বিয়ে বিচ্ছেদের মতো অপ্রীতিকর বিষয়াদির যেসব কারণ রয়েছে, তার সিংহভাগ হচ্ছে জিহ্বার অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, বাকশক্তির অপব্যবহার। লাগামহীন কথাবার্তা ও অনর্থ আলাপচারিতা থেকে এসবের সূত্রপাত ঘটে।
জবান মানব দেহের অনুসৃত অঙ্গ
জিহ্বা মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। আর শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জিহ্বার অনুগামী ও অনুসারী হয়। জিহ্বার ব্যবহার ভালো হলে অন্যান্য অঙ্গের আচরণও ভালো হয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আদম সন্তান যখন সকালে উপনীত হয়, তখন তার সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জিহ্বাকে অত্যন্ত বিনীতভাবে নিবেদন করে যে, তুমি আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো। কারণ, আমাদের ব্যাপারসমূহে তোমার সঙ্গেই সম্পৃক্ত। যদি তুমি সোজা সরল থাকো, তাহলে আমরাও সোজা সরল থাকব। আর যদি তুমি বক্রতা অবলম্বন করো, তাহলে আমরাও বেঁকে বসব।’ (তিরমিজি : ২৪০৭)।
জিহ্বা সর্বাধিক ভয়ংকর বস্তু
সুফিয়ান ইবনে আবদুল্লাহ আস সাকাফি (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনার দৃষ্টিতে আমার জন্য সর্বাধিক ভীতিকর বস্তু কোনটি?’ তিনি স্বীয় জিহ্বা ধরে বললেন, ‘এটি।’ (তিরমিজি : ২৪১০)। রাসুল (সা.) অন্য এক হাদিসে জবানের অনিষ্টতা থেকে বাঁচার উপায় বলে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যে চুপ থাকে, সে নাজাত পায়।’ (তিরমিজি : ২৫০১)। শায়খ বকর ইবনে আবদুল্লাহ আল মুজানি (রহ.)-কে চুপ থাকা নিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘আপনি এত দীর্ঘ সময় চুপ থাকেন কেন?’ জবাবে তিনি বললেন, ‘আমার জিহ্বা হিংস্র একটা জীবের মতো। যদি আমি ছেড়ে দিই, তাহলে এটা আমাকে খেয়ে ফেলবে।’ (বাহজাতুল মাজালিস : ১/১১)।
জিকিরে সিক্ত জবান
চুপ থাকা মানে দুনিয়াবি বেহুদা কথাবার্তা না বলা। তবে জবানকে জিকিরে সিক্ত রাখা এবং দ্বীনি নসিহায় প্রাণবন্ত রাখা কাম্য। আবদুল্লাহ ইবনে বুসর (রা.) সূত্রে বর্ণিত; এক লোক বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমার জন্য শরিয়তের বিষয়াদি অনেক হয়ে গেছে। সুতরাং আমাকে এমন একটি বিষয় জানান, যাকে আমি শক্তভাবে আঁকড়ে থাকতে পারি।’ তিনি বললেন, ‘সর্বদা তোমার জবান যেন আল্লাহর জিকিরে সিক্ত থাকে।’ (তিরমিজি : ৩৩৭৫)।
জবানের সদ্ব্যবহার জান্নাত লাভের উপায়
জিহ্বার নিয়ন্ত্রণ ও চুপ থাকার দ্বারা চির শান্তির সুখময় জান্নাত লাভ করা যায়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুই চোয়ালের মধ্যবর্তী অঙ্গ (জিহ্বা) এবং দুই পায়ের মধ্যবর্তী অঙ্গ (গুপ্তাঙ্গ) সম্বন্ধে নিশ্চয়তা দেবে, আমি তার জন্য জান্নাতের নিশ্চয়তা দেব।’ (বোখারি : ৬৪৭৪)। অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি ওই ব্যক্তির জন্য জান্নাতের পাশে একটি প্রাসাদের জামিন হব, যে হকের ওপর থেকেও ঝগড়া পরিহার করে এবং ওই ব্যক্তির জন্য জান্নাতের মধ্যখানে একটি প্রাসাদের জামিন হব, যে ঠাট্টাচ্ছলেও মিথ্যা পরিহার করে। আর ওই ব্যক্তির জন্য জান্নাতের একটি প্রাসাদের জিম্মাদার হব, যার চরিত্র সুন্দর হয়।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪৮০০)।
সংযত জবান রবের অসন্তুষ্টি থেকে রক্ষা করে
লাগামহীন অপ্রয়োজনীয় অনর্থক কথা না বলে নীরব থাকতে পারলে আল্লাহর অসন্তুষ্টি ও ক্রোধ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে জবানের সদ্ব্যবহারে জাহান্নাম থেকে মুক্তি মেলে। মুআজ বিন জাবাল (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি একবার রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে সফরে ছিলাম। তিনি বললেন, ‘আমি কি সব কাজের মূল, স্তম্ভ ও সর্বোচ্চ শিখর সম্পর্কে তোমাকে অবহিত করব না?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসুল!’ তিনি বললেন, ‘সব কাজের মূল হলো ইসলাম। এর স্তম্ভ হলো সালাত। আর সর্বোচ্চ শিখর হলো, জিহাদ।’ তিনি আরো বললেন, ‘আমি কি তোমাকে এ সবকিছুর সার সম্পর্কে বলব না?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসুল!’ তিনি তার জিহ্বা ধরে বললেন, ‘এটা সংযত রাখো।’ আমি প্রশ্ন করলাম, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমরা যে কথাবার্তা বলি, এগুলো সম্পর্কেও কি আমাদের পাকড়াও (জবাবদিহি করা) হবে?’ তিনি বললেন, ‘হে মুয়াজ, তোমার মা তোমাকে হারিয়ে ফেলুক। মানুষকে তো শুধু জিহ্বার উপার্জনের কারণেই অধঃমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ (তিরমিজি : ২৬১৬)। চুপ থাকা শয়তান থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রেসক্রিপশন। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমার ওপর নেকির কথা বলা ছাড়া (অন্য সময়) দীর্ঘ চুপ থাকা আবশ্যক করে নাও। কারণ, এটি শয়তানকে তোমার কাছ থেকে দূর করে দেবে। আর দ্বীনি কাজকর্মে তোমার সাহায্যকারী হবে।’ (সহিহ ইবনে হিব্বান : ৩৬২)।