ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মক্কা শরিফের জুমার খুতবা

যার দয়ায় বেঁচে থাকি

শায়খ ড. বান্দার বিন আবদুল আজিজ বালিলা
যার দয়ায় বেঁচে থাকি

আল্লাহর পরিচয় লাভ করা দ্বীনের মৌলিক বিষয় এবং একিন ও বিশ্বাসের সোপান। তাঁর অনেক মহিমান্বিত নাম ও মহান গুণাবলি রয়েছে। রয়েছে বহু গুণবাচক নাম। সেসবের অন্যতম হলো, রহমান ও রহিম। এ গুণবাচক নামের গুণাবলি তাঁর মাঝে পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান। এতে কোনো অপূর্ণতার লেশ নেই। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনিই আল্লাহ, যিনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। তিনি গুপ্ত ও প্রকাশ্য সবকিছুর জ্ঞাতা। তিনি সবার প্রতি দয়াবান, পরম দয়ালু।’ (সুরা হাশর : ২২)। তিনি আরো বলেন, ‘(তাদের) জিজ্ঞেস করো, আকাশমণ্ডলি ও পৃথিবীতে যা আছে, তা কার মালিকানাধীন? (তারপর তারা যদি উত্তর না দেয়, তবে নিজেই) বলে দাও, আল্লাহরই মালিকানাধীন। তিনি রহমতকে নিজের প্রতি অবশ্য কর্তব্যরূপে স্থির করে নিয়েছেন। (তাই তওবা করলে অতীতের সব পাপ ক্ষমা করে দেন)। কেয়ামতের দিন তিনি অবশ্যই তোমাদের সবাইকে একত্রিত করবেন। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু যারা (কুফর ও পাপাচারে লিপ্ত হয়ে) নিজেদের ক্ষতিসাধন করেছে, তারা (এ সত্যের প্রতি) ঈমান আনবে না।’ (সুরা আনআম : ১২)।

অবারিত রহমতে সিক্ত সৃষ্টিকুল

আল্লাহতায়ালার রহমত ও দয়া সবার জন্য অবারিত ও ব্যাপৃত। মানবজাতির জন্য যেমন তাঁর রহমত-অনুকম্পা রয়েছে, তদ্রূপ অন্য সব সৃষ্টির জন্য সমানভাবে তাঁর রহমত ও দয়া রয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা আরশকে ধারণ করে এবং যারা এর চারপাশে রয়েছে, তারা তাদের রবের প্রশংসাসহ তাসবিহ পাঠ করে এবং তাঁর প্রতি ঈমান রাখে। আর মোমিনদের জন্য ক্ষমা চেয়ে বলে, হে আমাদের রব! আপনি রহমত ও জ্ঞান দ্বারা সবকিছুকে পরিব্যপ্ত করে রেখেছেন। অতএব, যারা তওবা করে এবং আপনার পথ অনুসরণ করে, আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন। আর জাহান্নামের আজাব থেকে রক্ষা করুন।’ (সুরা মোমিন : ৭)। তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের জন্য এ দুনিয়াতেও কল্যাণ লিখে দিন এবং আখেরাতেও। (এ উদ্দেশ্যে) আমরা আপনারই দিকে রুজু করছি। আমার শাস্তি যাকে ইচ্ছা দিই, আর আমার দয়া তো প্রত্যেক বস্তুতে ব্যাপ্ত। সুতরাং আমি এ রহমত (পরিপূর্ণভাবে) সেসব লোকের জন্য লিখব, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, জাকাত দেয় এবং আমার আয়াতগুলোতে ঈমান রাখে।’ (সুরা আরাফ : ১৫৬)।

আল্লাহর রহমতের নিদর্শন

আল্লাহতায়ালার রহমত সৃষ্টিকুলের কাছে দিবালোকের মতো স্পষ্ট। তিনি নিজের রহমত ও অনুকম্পার গুণ দিয়েই মানুষকে সর্বোত্তম অবয়বে সৃষ্টি করেছেন, জীবন দিয়েছেন, জ্ঞান প্রদান করেছেন, ভোগ্যসামগ্রী দিয়েছেন। তাঁর রহমত দিয়েই চাঁদণ্ডসূর্য সৃষ্টি করেছেন, দিনরাত, আসমান-জমিন সৃষ্টি করেছেন। তাঁর রহমত দিয়ে দুনিয়াকে বসবাসের উপযোগী করেছেন।

আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মহিমাময় সেই সত্তা, যিনি আকাশে বুরুজ বানিয়েছেন এবং তাতে এক উজ্জ্বল প্রদীপ ও আলো বিস্তারকারী চাঁদ সৃষ্টি করেছেন। তিনি সেই সত্তা, যিনি রাতদিনকে পরস্পরের অনুগামী করে সৃষ্টি করেছেন। (কিন্তু এসব বিষয় উপকারে আসে) সেই ব্যক্তির জন্য, যে উপদেশ গ্রহণের ইচ্ছা রাখে কিংবা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে চায়।’ (সুরা ফোরকান : ৬১-৬২)।

দয়ার ফল নবী-রাসুল ও কিতাব প্রেরণ

আল্লাহ নিজ রহমতের কারণেই নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। তাঁর রহমত দিয়েই তিনি ভ্রষ্টতার পরে সঠিক পথের দিশা দিয়েছেন। মূর্খতার পরে শিক্ষা লাভ করিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ মোমিনদের প্রতি (অতি বড়) অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের কাছে তাদেরই মধ্য হতে একজন রাসুল পাঠিয়েছেন, যে তাদের সামনে আল্লাহর আয়াতগুলো তেলাওয়াত করে, তাদের পরিশুদ্ধ করে এবং তাদের কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেয়। নিশ্চয় এর আগে তারা সুস্পষ্ট গোমরাহিতে লিপ্ত ছিল।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৬৪)। তিনি আরো বলেন, ‘সেদিনকেও স্মরণ রেখ, যেদিন প্রত্যেক উম্মতের মধ্যে তাদের নিজেদের থেকে তাদের বিরুদ্ধে একজন সাক্ষী দাঁড় করাব। আর (হে নবী!) আমি তোমাকে এদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য উপস্থিত করব। আমি তোমার প্রতি এ কিতাব নাজিল করেছি; যাতে এটা প্রতিটি বিষয় সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করে দেয়। আর তা মুসলমানদের জন্য হয় হেদায়াত, রহমত ও সুসংবাদ।’ (সুরা নাহল : ৮৯)।

মেঘরাশিতে তাঁরই অনুগ্রহ দৃশ্যমান

মেঘমালা তাঁরই রহমত ও দয়া-অনুকম্পার সৃষ্টি। অতঃপর বৃষ্টি বর্ষণ, ফেটে চৌচির হওয়া জমিন পুনরায় সজীবতা লাভ করা, তারপর সৃষ্টিকুল সে বর্ষণ থেকে পান করা ও সংরক্ষণ করা তাঁরই রহমতের নিদর্শন ও প্রমাণ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহর রহমতের ফল লক্ষ্য করো, তিনি কীভাবে ভূমিকে তার মৃত্যুর পর জীবন দান করেন। বস্তুত তিনি মৃতদের জীবনদাতা এবং সব বিষয়ে শক্তিমান।’ (সুরা রুম : ৫০)।

রহমতের একভাগ বণ্টিত

আল্লাহতায়ালা তাঁর সৃষ্টিকুলের রহমতের মাঝে একাংশ ঢেলে দিয়েছেন। ফলে সৃষ্টিকুল পরস্পর পরস্পরের প্রতি রহম ও দয়াশীল এবং দয়াবান হয়। সুতরাং পিতামাতা তার সন্তানের প্রতি দয়া, সবল ব্যক্তি দুর্বল ব্যক্তির ওপর দয়া, পশুপাখির পরস্পরের প্রতি দয়া সবই আল্লাহতায়ালার রহমতের ধারা। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর একশ’ ভাগ রহমত আছে। এর মধ্যে একভাগ রহমত তিনি জিন, ইনসান, চতুষ্পদ জন্তু ও কীট-পতঙ্গের মাঝে ভাগ করে দিয়েছেন। এই একভাগ রহমতের কারণেই সৃষ্টিজীব একে অপরের প্রতি দয়া করে। এই এক ভাগ রহমতের মাধ্যমে বন্যপশু নিজ সন্তানের প্রতি দয়া ও অনুকম্পা প্রদর্শন করে। মহান আল্লাহ তাঁর একশ’ ভাগ রহমতের নিরানব্বই ভাগ নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। এর দ্বারা তিনি কেয়ামতের দিন স্বীয় বান্দাদের প্রতি দয়া করবেন।’ (মুসলিম : ২৭৫২)। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, ‘তুমি যদি সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে এ জগতের প্রতিটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য কর, তাহলে আল্লাহর দেয়া সেই একভাগ রহমতে দুনিয়াকে পরিপূর্ণ টইটম্বুর দেখতে পাবে, যেমন নদী ও আসমান পানি ও বাতাসে টইটম্বুর থাকে।

রহমতের গুণে বান্দাকে ক্ষমা

তাঁর রহমত ও দয়া-অনুপম্পার ফলে বান্দাদের জন্য তওবার দ্বার উন্মুক্ত রেখেছেন। তাদের অপরাধ ক্ষমা করেন ও গোপন রাখেন। কেননা, তাঁর ক্রোধের চেয়ে তাঁর দয়া ও ক্ষমার গুণ অনেক অনেক বেশি। এ দয়ার ফলে বান্দাদের তিনি জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, তাদের আমলের কারণে নয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বলে দাও হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজ সত্তার ওপর সীমালংঘন করেছে, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সব পাপ ক্ষমা করেন। নিশ্চয় তিনি অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সুরা যুমার : ৫৩)। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা যখন (সৃষ্টির) কাজ সম্পন্ন করলেন, তখন তাঁর আরশের ওপর লিখে দিলেন, আমার রহমত আমার ক্রোধকে ছাড়িয়ে গেছে।’ (বোখারি : ৭৪৫৩)।

রহমতের বেশি হকদার যে জন

আল্লাহর রহমত পাওয়ার সবচেয়ে সৌভাগ্যবান ব্যক্তি হলেন, যিনি গোনাহ ও পাপাচার থেকে বেঁচে থাকেন এবং সৎকর্মে সর্বদা অগ্রগামী হন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার পর তাতে অশান্তি বিস্তার করো না। (অন্তরে তাঁর) ভয় ও আশা রেখে তাঁর ইবাদত কর। নিশ্চয় আল্লাহর রহমত সৎকর্মশীলদের নিকটবর্তী।’ (সুরা আরাফ : ৫৬)। আর ইস্তেগফার মানুষকে আল্লাহতায়ালার খাস রহমতপ্রাপ্তি এবং শাস্তিমুক্ত থাকতে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সালেহ বলল, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা ভালোর আগে মন্দকে কেন তাড়াতাড়ি চাচ্ছ? তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছ না কেন, যাতে তোমাদের প্রতি দয়া করা হয়?’ (সুরা নামল : ৪৬)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সৃষ্টির প্রতি রহমশীল ও দয়াবান হয়, আল্লাহ তার প্রতি রহমশীল ও দয়াবান হন।’ (বোখারি : ৭৪৪৮)।

২৯ সফর ১৪৪৫ (১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩) তারিখে মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন - মুহাম্মাদুল্লাহ ইয়াসিন

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত