নেটবিহীন মধুর এক শিশুকাল পার করে এসেছি আমরা। সেই সময় ডিস-এন্টেনারের মতো জঞ্জাল অতটা সহজলভ্য ছিল না। এখনকার তুলনায় সুস্থ-সুন্দর ও নির্মল একটা কৈশোর পার করেছি। আমাদের ঘুম ভাঙত বাবা-মায়ের কোরআন তেলাওয়াতে, পাখির কিচিরমিচির ডাকে। মকতব থেকে ফিরতাম সকালের মিষ্টি রোদ গায়ে মাখিয়ে। বিকেল হলে বাড়ির উঠোন-আঙিনায় ভাইবোন, পাড়া-পড়শী ও সমবয়সিদের সঙ্গে খেলতাম। আরেকটু বড় হয়ে স্কুলে বা মাদ্রাসার মাঠে দাড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট, ক্রিকেট, ফুটবল, হাডুডু খেলেছি। বিপুল আনন্দণ্ডউৎসাহে আত্মীয়বাড়ি বেড়াতে যেতাম। একে অপরের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ, গল্পগুজব হতো। গল্পের ঝাঁপি খুলে বসতেন দাদি-নানি। মন ডুবিয়ে আমরা সেগুলো শুনতাম। খোশগল্পে মেতে উঠতেন মা-খালা, চাচি-ফুফু আর মামিরা। সেসব দিন-পরিবেশ আর নেই এখন। মানুষের বর্তমান ঝোঁক-প্রবণতায় ঘটেছে আমূল পরিবর্তন। বিবর্তন ঘটেছে চালচলন, জীবনধারা, খাদ্যাভ্যাসেও। গ্রাম-গায়ের লালিত্য কেড়ে নিয়েছে ইট-কংক্রিটের দালান-কোঠা, মিল-কারখানা। মাটি ও মাঠের সংখ্যা কমেছে বেশ। আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাতে বাড়ছে অনীহা। উঠে যাচ্ছে বহুপরিবার প্রথা। সবাই যেন আত্মকেন্দ্রিকতায় সমাহিত হতে পাগলপারা। দুনিয়া এখন হাতের মুঠোয় : আসমুদ্র হিমাচল ছেয়ে গেছে ডিস-এন্টেনা ও ইন্টারনেটে। দুনিয়া এখন হাতের মুঠোয়। গানবাদ্য, নাটক-সিনেমা ও কার্টুন-এনিমেশন সহজলভ্য। ?ইন্টারনেটের ফলে বেহদ সুবিধা ভোগ করছে মানুষ। মুহূর্তেই পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিমে মনের কথা পৌঁছে দেয়া যায়। পৃথিবীর কোথায় কখন কী ঘটছে, তা জানতে আর পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনের পর্দায় তাকাতে হয় না। হাতে থাকা স্মার্টফোন অন করলে ভুরি ভুরি সোর্স এসে ভিড় করে স্ক্রিনে। নোটিফিকেশনবার উপচে পড়ে নানাবিধ সংবাদে। সব বিষয়ের যেমন ভালো-মন্দ দুটো দিক থাকে, অবারিত এই নেট-ব্যবস্থায়ও রয়েছে ভালো-মন্দ দুই দিক। কিন্তু এটা নির্ভর করে ব্যবহারকারীর পরিপক্বতা ও নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতার ওপর। দা-বঁটি ব্যবহারকারীর মধ্যে পরিপক্বতা না এলে বা নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা না থাকলে, সে নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কিংবা তা দ্বারা অন্যরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বিবর্তনের ঢেউ কচিকাঁচার আসরে : সবার আগে এসব পরিবর্তন-বিবর্তনের ঢেউ আছড়ে পড়ছে আমাদের কচিকাঁচাদের ওপর। এখনকার শিশুরা যেভাবে সব বাদ দিয়ে ঘরের এককোণে স্ক্রিনে বুঁদ হয়ে থাকে, সময়ের কাজ ফেলে নিজেকে অন্তর্জালের স্রোতে ভাসিয়ে দেয়, বাস্তবতা এড়িয়ে কৃত্রিম ভার্চুয়াল জগতে নিজের সক্রিয়তা জানাতে ব্যাকুল হয়ে পড়ে, এতে করে জীবনের ঊষালগ্নেই বাছবিচারহীন অনিয়ন্ত্রিত এক জীবনে পা বাড়ায় তারা। এমন হলে শঙ্কিত হতেই হবে। যে কোনো শিশু এ পর্যায় পৌঁছালে আমাদের চোখণ্ডকান খোলা রেখে তাদের সংশোধনে মনোযোগী হতে হবে। বিকল্প দাওয়ায়ির ব্যবস্থা করতে হবে। সেটা হতে পারে বই পড়ায় উৎসাহিত করা, কোনো রিলেটিভের বাসায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, ভ্রমণে বেরিয়ে পড়া, খেলাধুলায় উৎসাহিত করা কিংবা হালাল বিনোদনের ব্যবস্থা করা। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের সোনামণিদের প্রতি সদয় হয় না, বড়দের শ্রদ্ধা করে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়।’ (তিরমিজি : ২০৪৪)। এখানে শিশুর প্রতি সদয় হওয়ার অর্থ কিন্তু এটাও, যথাসময়ে তাদের সব ধরনের আচার-ব্যবহার, নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা নিশ্চিত করা। শিশুরা আমাদের কাছে আমানত। সময় নষ্ট হয় কিংবা সুকুমারবৃত্তি নষ্ট জাতীয় উপাদান থেকে শিশুকে রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। তা না করে তাদের হাতে কার্টুনের মতো জঞ্জাল তুলে দেয়ার অর্থ হলো, অঙ্কুরেই শিশুকে গলা টিপে হত্যা করা, শিশুর প্রতি অবিচার করা আর সময় নষ্টের প্রথম সিঁড়ি উদ্বোধন করা। খেয়াল রাখা দরকার, এ জন্য কিন্তু কেয়ামত দিবসে আল্লাহর কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে।
কান্না থামানোর যত্রতত্র কৌশল : আজকের প্রায় প্রতিটি পরিবারে কান্না থামানোর জন্য স্বয়ং বাবা-মা দু-তিন বছরের শিশুর হাতে স্মার্টফোন তুলে দিচ্ছেন, টিভি অন করে দিচ্ছেন। কান্না থামানোর মনোহর খেলনা যেন এটি। শিশুটি নন্টে-ফন্টে, মোটু-পাতলু, শিবার মতো বস্তাপঁচা হিন্দি কার্টুন গিলছে গোগ্রাসে, বাবা-মায়ের তাতে কিচ্ছু যায় আসে না! অথচ এই কার্টুনের নামে যে কোমলমতি শিশুর মনে জেঁকে বসছে হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতি! আপন হয়ে ধরা দিচ্ছে বিকৃত শিষ্টাচার! হালকা হয়ে যাচ্ছে দেশীয় রীতি-নীতির বন্ধন! আমরা কি আদৌ সেটা টের পাই? এমন চিত্র দেখে বুকটা যেন ভেঙে আসে। আমাদের শ্বাশ্বত বিশ্বাসের গলি-ঘুপচি ডিঙিয়ে কীভাবে একটি শিশুর মস্তিষ্কে হিন্দুয়ানি রীতি-নীতি অনুপ্রবেশ করে, সেই জবাবদিহি আমাদের নেই। আমাদের অসচেতনতা এবং হালকা করে দেখার খোলা মানসিকতা সেজন্য ষোলো আনা দায়ী। যদি একটি শিশুকে ভবিষ্যতের অমূল্য সম্পদ ভাবতে পারতাম, তাহলে হয়তো তাদের সামনে টিভি অন করে দিতাম না, যত্রতত্র কচি হাতে স্মার্টফোন তুলে দিতাম না। বরং শিশুকে এ অপূরণীয় ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হতাম। সময় নষ্টের দুয়ার না খুলে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতাম।
আত্মগঠনে উদাসীনতা কাম্য নয় : তারা খেতে না চাইলে, পড়তে না চাইলে তাদের সামনে দ্বিতীয় কোনো পদ্ধতি প্রয়োগ না করে, কেন মোস্ট পপুলার কার্টুন অন করে দিতে হবে? আমরা শিশুমনে মন্দ প্রভাবের কথা অস্বীকার করছি না তো? অখাদ্য-কুখাদ্য শিশুর মন-মনন বিষিয়ে তোলে না? শিশুর দেহের জন্য পুষ্টিকর খাবার-দাবার, স্বাস্থ্যকর ফলমূল, শাক-সবজির কথা চিন্তা করতে পারি, কিন্তু সঠিক সময়ে শিশুর মন-মানসিকতা গঠনে পর্যাপ্ত ধর্মীয় জ্ঞান, শিক্ষাদীক্ষা, সভ্যতাণ্ডভব্যতা এবং সুস্থ বিনোদনের প্রয়োজনীয়তা কেউই উপলব্ধি করতে পারি না কিংবা করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করি না। অথচ সমানভাবে শিশুর মস্তিষ্ক গঠনে, মন-মানসের পুষ্টি জোগাতে দরকার সুস্থ চিন্তা-চেতনা, মনোরম শান্ত পরিবেশ। এ ক্ষেত্রে গাফলতি কোনোভাবেই কাম্য নয়। শিশুর প্রতি অবহেলা মেনে নেয়ার নয়। বাড়তি সচেতনতা দরকার : শিশু-কিশোরদের প্রতি আমাদের আরো যত্নবান হতে হবে। সত্যিকারার্থে এ সময়ে বয়সে বড় সন্তানের চেয়ে শিশু সন্তানের প্রতি খেয়াল রাখা অতীব জরুরি। একজন মাদকাসক্ত যুবক একটা পর্যায়ে যেমন সুস্থতা-অসুস্থতা বিচার করতে পারে না কিংবা নেশায় বুদ হয়ে অসুস্থতাকেই সুস্থতা জ্ঞান করে থাকে, আমাদের নিউ জেনারেশনও অনুরূপ বিষময় এনিমেশন মুভি কিংবা ঈমান-বিনাশী হিন্দি কার্টুনকে উত্তম উপাদেয় ভাবতে থাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচি-চাহিদারও বিচিত্র পরিবর্তন ঘটে থাকে। কারণ, মানুষ কখনও একই বিষয়ের ওপর দীর্ঘ সময় স্থির হতে পারে না। মানুষ এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় যেতে ছটফট করতে থাকে, নতুন নতুন বিষয়ের স্বাদ নিতে ব্যাকুল থাকে। ফলে খেয়াল রাখতে হবে, আজ যেই ছেলেটি কার্টুন দেখছে, তার জন্য নির্ধারিত একটা সীমা বেঁধে না দিলে, সে কিন্তু একদিন কার্টুন থেকে সিনেমা-নাটক কিংবা আরও অশ্লীল রগরগে কোনো বিষয়ের অনুসন্ধানে নেমে পড়তে পারে। একটা সময় পড়াশোনার প্রতি তার আগ্রহ কমে যেতে পারে। বিরক্তিকর হয়ে উঠতে পারে সমবয়সিদের সঙ্গে খেলাধুলা, গল্প-গুজব। সময় নষ্ট মনে হতে পারে পাড়া-পড়শী, আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ওঠবস। ঘরকুনো মানসিকতা বাড়তে পারে, একাকিত্বে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে। এ প্রবণতা কিন্তু মোটেও ভালো নয়। বরং এ ধরনের প্রবণতাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে না দেখে উপায় নেই। অভিভাবকের দরকার হবে বাড়তি সচেতনতার। মারধরের শাসন দিয়ে নয়, সন্তানের গায়ে স্নেহের হাত বুলাতে হবে। তা না করতে পারলে দীর্ঘমেয়াদে খেসারত দিতে হবে অভিভাবককে। পড়াশোনায় অমনোযোগিতা, মাদকাসক্তি, নারী কেলেঙ্কারিসহ যে কোনো অন্যায়ের ভুলের মাশুল গুনতে হবে বাবা-মাকেই।
লেখক : শিক্ষক, সম্পাদক ও অনুবাদক