মহিমান্বিত সুরা
মিজান ইবনে মোবারক
প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
কোরআনুল কারিমের ১১৪টি সুরার মধ্যে সুরা ইখলাস ১১২তম। এতে রয়েছে চারটি আয়াত, একটি রুকু। কোরআনুল কারিমের ছোট সুরাগুলোর মধ্যে এর স্থান দ্বিতীয়। সুরা ইখলাস ছোট হলেও এর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে আল্লাহতায়ালার পরিচয়। কোনো কোনো কাফের মহানবী (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আপনি যে মাবুদের ইবাদত করেন, তিনি কেমন? তার নামণ্ডধাম, বংশ-পরিচয় কী?’ এরই উত্তরে সুরা ইখলাস নাজিল করা হয়েছে। তাই এ সুরার মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার স্বত্বার পরিচয় লাভ করা যায় এবং তাঁর ক্ষমতা সম্পর্কে জানা যায়। যারা আল্লাহতায়ালাকে নিয়ে অমূলক প্রশ্ন করে, তাদেরও দেয়া হয়েছে এতে সমুচিত জবাব। কোরআনুল কারিমের প্রতিটি সুরার রয়েছে আলাদা বৈশিষ্ট্য ও ফজিলত। সেসব সুরার মধ্যে সুরা ইখলাস অন্যতম। হাদিসে সুরা ইখলাসের অসংখ্য ফজিলত বর্ণিত হয়েছে।
এক-তৃতীয়াংশের সমান : সুরা ইখলাস ছোট হওয়ার কারণে পড়তে খুবই সহজ। তাই অনায়াসে পড়া যায়। সুরা ইখলাস একবার তেলাওয়াত করলে তা কোরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমান হয়। একাধিক হাদিসে বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ কি এক রাতে কোরআনের এক-তৃতীয়াংশ তেলাওয়াত করা অসাধ্য মনে কর?’ এ প্রশ্ন তাদের জন্য কঠিন ছিল। তারা বলল, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমাদের মধ্যে কার সাধ্য আছে যে, এটা পারবে?’ তিনি বললেন, ‘সুরা ইখলাস কোরআনের তিন ভাগের একভাগ।’ (বোখারি : ৫০১৫)।
ফজিলতের দিক থেকে অনন্য : সুরা ইখলাস ছোট বলে ফজিলতের দিক থেকেও ছোট বিবেচনা করা যাবে না; বরং ফজিলতের দিক থেকে এটি অনন্য। আবু সাঈদ খুদরি (রা.) হতে বর্ণিত; এক ব্যক্তি এক সাহাবিকে দেখলেন, বারবার সুরা ইখলাস পড়ছেন। সকাল হলে ওই ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর সামনে বিষয়টি পেশ করলেন। লোকটি হয়তো ভেবেছিল, এই ছোট একটি সুরা বারবার পড়তে থাকা তেমন সওয়াবের কাজ নয়। তখন রাসুল (সা.) বললেন, ‘সেই সত্তার কসম, যার হাতে আমার প্রাণ! সুরা ইখলাস কোরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমান।’ (সুনানে আবি দাউদ : ১৪৬১)।
কোরআনের এক-তৃতীয়াংশ পাঠ : আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত; একবার নবীজি (সা.) বললেন, ‘তোমরা সমবেত হও, আমি তোমাদের সামনে কোরআনের এক-তৃতীয়াংশ তেলাওয়াত করতে যাচ্ছি।’ যাদের একত্র হওয়ার, তারা এক হলো। রাসুল (সা.) হুজরা থেকে বেরুলেন। তারপর সুরা ইখলাস পাঠ করে আবার হুজরায় চলে গেলেন। আমাদের একজন আরেকজনকে বলতে লাগল, রাসুল (সা.) বলেছিলেন, ‘আমি তোমাদের সামনে কোরআনের এক-তৃতীয়াংশ পাঠ করব। মনে হয়, এখন আসমান থেকে তার কাছে (এ বিষয়ে) খবর এসেছে (তাই তিনি হুজরায় চলে গেলেন)। পরে নবীজি (সা.) আবার বেরিয়ে এসে বললেন, ‘আমি বলেছিলাম, তোমাদের সামনে কোরআনের এক-তৃতীয়াংশ পাঠ করব। শোন, এ সুরাটি হলো কোরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমান।’ (তিরমিজি : ২৯০০)।
আল্লাহর ভালোবাসা লাভ : সুরা ইখলাসে আল্লাহতায়ালার পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। তাই মোমিন বান্দামাত্রই সুরাটি বিশেষভাবে মহব্বত করে, বারবার তেলাওয়াত করে। এ সুরার মহব্বত জান্নাত লাভের কারণ, আল্লাহতায়ালার মহব্বত হাসিলের মাধ্যম। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত; নবীজি (সা.) এক সাহাবিকে একটি মুজাহিদ দলের প্রধান করে অভিযানে পাঠালেন। তিনি নামাজে যখন তার সঙ্গীদের নিয়ে ইমামতি করতেন, তখন সুরা ইখলাস দিয়ে নামাজ শেষ করতেন। তারা যখন অভিযান থেকে ফিরে এলো, তখন নবীজি (সা.)-এর খেদমতে বিষয়টি আলোচনা করলেন। নবীজি (সা.) বললেন, ‘তোমরা তাকেই জিজ্ঞেস কর, কেন সে এ কাজটি করেছে?’ এরপর তারা তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তর দিলেন, ‘এ সুরায় আল্লাহতায়ালার গুণাবলি রয়েছে। এ জন্য সুরাটি পড়তে আমি ভালোবাসি।’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘তাকে জানিয়ে দাও, আল্লাহও তাকে ভালোবাসেন।’ (বোখারি : ৭৩৭৫)।
জান্নাত লাভের মাধ্যম : আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত; মসজিদে কোবায় আনসার সম্প্রদায়ের এক লোক তাদের ইমামতি করতেন। তিনি নামাজে সুরা ফাতিহার পর প্রথমে সুরা ইখলাস পাঠ করতেন। এ সুরা শেষ করে অন্য সুরা পাঠ করতেন। তিনি প্রতি রাকাতেই এরূপ করতেন। তার সঙ্গীরা এ ব্যাপারে তাকে বলল, ‘আপনি এ সুরাটি পাঠ করার পর মনে করেন, এটা বুঝি যথেষ্ট হয়নি, তাই এর সঙ্গে অন্য আরেকটি সুরাও পাঠ করেন। আপনি হয় এ সুরাটিই পাঠ করবেন, না হয় এটা বাদ দিয়ে অন্য কোনো সুরা পাঠ করবেন।’ তিনি বললেন, ‘আমি এ সুরা বাদ দিতে পারব না। যদি তোমাদের পছন্দ হয়, তবে আমি এ সুরাসহ ইমামতি করি, আর পছন্দ না হলে ইমামতি ছেড়ে দিই।’ কিন্তু তাদের দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম। তাই তাকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে ইমাম বানাতে তারা সম্মত হলো না। পরে নবীজি (সা.) তাদের কাছে এলে তারা বিষয়টি জানাল। তিনি বললেন, ‘হে অমুক! তোমার সঙ্গীরা তোমাকে যে নির্দেশ দিচ্ছে, তা পালন করতে তোমাকে কোন জিনিস বাঁধা দিচ্ছে? আর তোমাকে প্রতি রাকাতে এ সুরা পাঠ করতে কীসে উদ্বুদ্ধ করছে?’ তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আমি এটি খুব ভালোবাসি।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘এর প্রতি তোমার ভালোবাসাই তোমাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে।’ (তিরমিজি : ২৯০১)।
জান্নাত অবধারিত হওয়া : আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম। তখন এক ব্যক্তিকে সুরা ইখলাস পড়তে দেখা গেল। রাসুল (সা.) বললেন, ‘সে ওয়াজিব করে নিল।’ আমি বললাম, ‘কী ওয়াজিব করে নিল?’ তিনি বললেন, ‘জান্নাত।’ (তিরমিজি : ২৮৯৭)।