পবিত্রতা অবলম্বন
মানবজীবনে পবিত্রতা অবলম্বন করার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রস্রাব-পায়খানার পর শৌচকর্ম বা ঢিলা-কুলুখ ব্যবহার করা এবং স্ত্রী গমনের পর গোসল করা অপরিহার্য। পবিত্রতা অবলম্বন না করার কারণে অনেক সময় নামাজ বর্জন করা হয়। শয়তান অপবিত্রতাকে নামাজ বর্জন ও ইবাদত-বন্দেগি পরিত্যাগের বাহানা হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা চালায়। তাই প্রাপ্তবয়স্ক প্রত্যেক মুসলমানের জন্য সমীচীন হলো, পবিত্রতা অবলম্বন করে চলা; সব সময় পবিত্র থাকার প্রয়াস করা। যারা পবিত্রতা অবলম্বন করে, আল্লাহতায়ালা তাদের পছন্দ করেন ও ভালোবাসেন। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে এ ব্যাপারে এসেছে, ‘তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে রজঃস্রাব সম্পর্কে। বলে দাও, এটা অপবিত্র। কাজেই তোমরা স্রাবরত অবস্থায় স্ত্রী গমন থেকে বিরত থাক। তখন পর্যন্ত তাদের কাছে যাবে না, যতক্ষণ না তারা পবিত্র হয়। যখন উত্তমরূপে পরিশুদ্ধ হয়ে যাবে, তখন গমন কর তাদের কাছে, যেভাবে আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। নিশ্চয় আল্লাহ তওবাকারী এবং পবিত্রতা অবলম্বনকারী লোকদের পছন্দ করেন।’ (সুরা বাকারা : ২২২)। আল্লাহতায়ালা পবিত্র লোকদের ভালোবাসেন মর্মে কোরআন কারিমের অন্য জায়গায় এসেছে, ‘তুমি কখনও সেখানে দাঁড়াবে না, তবে প্রথম দিন থেকে যে মসজিদের ভিত্তি তাকওয়ার ওপর রাখা হয়েছে, সেটিই তোমার দাঁড়ানোর যোগ্য স্থান। সেখানে রয়েছে এমন লোক, যারা পবিত্রতাকে ভালোবাসে। আর আল্লাহতায়ালা পবিত্র লোকদের ভালোবাসেন।’ (সুরা তওবা : ১০৮)।
সৎকর্ম সম্পাদন : কর্ম দু’প্রকার- সৎ ও অসৎ। সৎকর্ম সব সময় সুন্দর, শোভনতর ও কল্যাণকর; আর অসৎকর্ম সর্বদা কুৎসিত, কদাকার ও অকল্যাণকর। সৎকর্ম চিরকাল করণীয় ও প্রশংসনীয়; পক্ষান্তরে অসৎকর্ম চিরদিন ঘৃণ্য, পরিত্যাজ্য ও বর্জনীয়। তাই মানুষের জন্য সমীচীন হলো, সব সময় সৎকর্ম সম্পাদন করা এবং অসৎকর্ম পরিহার করে চলা। যারা সৎকর্ম সম্পাদন করে, তারা মানুষের প্রিয়পাত্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহতায়ালারও প্রিয়ভাজন হয়ে যায়। মহান আল্লাহ সৎকর্মশীল লোকদের ভালোবাসেন মর্মে মহাগ্রন্থ আল কোরআনে এসেছে, ‘যারা সৎকর্মশীল, আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৪৮)। কোরআনে কারিমের অন্য জায়গায় এ প্রসঙ্গে এসেছে, ‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে ও সৎকর্ম করেছে, তারা আগে যা পানাহার করেছে, সেজন্য তাদের কোনো গোনাহ নেই যখন ভবিষ্যতের জন্য সংযত হয়েছে, বিশ্বাস স্থাপন করেছে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করেছে। এরপর সংযত থাকে এবং বিশ্বাস স্থাপন করে। এরপর সংযত থাকে ও সৎকর্ম করে। আল্লাহ সৎকর্মশীল লোকদের ভালোবাসেন।’ (সুরা মায়িদা : ৯৩)।
তাকওয়া অবলম্বন : তাকওয়া শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো, বিরত থাকা, নিবৃত থাকা ও সাবধানতা অবলম্বন করা। ব্যবহারিক অর্থে আল্লাহর ভয়, পরহেজগারি, দ্বীনদারি ও ধার্মিকতা বোঝায়। আর ইসলামি পরিভাষায়- মহান আল্লাহর ভয়ে যাবতীয় অন্যায়-অপরাধ, অনাচার ও পাপাচার হতে নিবৃত থাকাকে তাকওয়া বলা হয়। যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন করে, তাকে মুত্তাকি বলা হয়। মুত্তাকি শব্দের অর্থ হলো, আল্লাহভীরু, পরহেজগার ও ধর্মপরায়ণ। তাকওয়া অবলম্বন করে এমন পরহেজগার, ধর্মপরায়ণ ও আল্লাহভীরু লোকদের মহান আল্লাহ ভালোবাসেন। এ মর্মে কোরআনে কারিমে তিনি বলেন, ‘যে লোক নিজ প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করবে এবং পরহেজগার হবে, অবশ্যই আল্লাহ পরহেজগারদের ভালোবাসেন।’ (সুরা আলে ইমরান : ৭৬)।
অনুগ্রহকরণ : দয়া ও অনুগ্রহ মহত্ত্বের পরিচয় বহন করে। করুণা ও অনুগ্রহের চর্চা পারস্পরিক সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি করে। তাই মানুষের জন্য সমীচীন হলো, একে অপরের সঙ্গে করুণা ও অনুকম্পার ব্যবহার করা। সবার প্রতি দয়া ও অনুগ্রহের আচরণ করা। মহান আল্লাহ দয়াশীল ও অনুগ্রহকারী লোকদের ভালোবাসেন। মহান আল্লাহ অনুগ্রহের আচরণ পছন্দ করেন। তিনি মানুষের প্রতি অনুগ্রহ করার নির্দেশ দিয়ে মহাগ্রন্থ আল কোরআনে বলেন, ‘মানুষের প্রতি অনুগ্রহ কর। আল্লাহ অনুগ্রহকারী লোকদের ভালোবাসেন।’ (সুরা বাকারা : ১৯৫)। অনুগ্রহকারী লোকদের ভালোবাসেন মর্মে আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘তুমি সর্বদা তাদের কোনো না কোনো প্রতারণা সম্পর্কে অবগত হতে থাক, তাদের অল্প কয়েকজন ছাড়া। অতএব, তুমি তাদের ক্ষমা কর ও মার্জনা কর। আল্লাহ অনুগ্রহকারী লোকদের ভালোবাসেন।’ (সুরা মায়িদা : ১৩)।
আল্লাহর ওপর ভরসা : মানুষ অনেক সময় বিভিন্ন কাজের সিদ্ধান্ত নেয়। কাঙ্ক্ষিত কাজ সম্পন্নও করে অনেক ক্ষেত্রে। কিন্তু এ কাজের সুফল আনয়ন বা কুফল প্রতিরোধকরণ তাদের আওতাধীন থাকে না। কাজের ব্যর্থতা ও সফলতা সম্পর্কে মানুষের কিছুই জানা থাকে না। তাই কোনো কাজের সিদ্ধান্ত নেওয়া কিংবা তা সম্পন্ন করার পর এর সুফল প্রাপ্তির লক্ষ্যে মানুষের জন্য সমীচীন হলো, আল্লাহতায়ালার ওপর পূর্ণাঙ্গভাবে ভরসা করা ও শতভাগ আস্থা রাখা। আল্লাহতায়ালার ওপর ভরসা করে, এমন সব লোককে আল্লাহতায়ালা পছন্দ করেন ও ভালোবাসেন। এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘যখন কোনো কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেল, তখন আল্লাহর ওপর ভরসা কর। আল্লাহ তার ওপর ভরসাকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৫৯)।
সুবিচার করা : সমাজে খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, লুটতরাজ, সুদণ্ডঘুষ, চাঁদাবাজি ও মানবপাচারসহ বহু ধরনের ভয়াবহ অন্যায় ও অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকে। কৃত অন্যায় ও অপরাধের যথাযথ বিচার করা হলে অপরাধের প্রবণতা কমে আসে। অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হলে মানুষের মধ্যে অপরাধ করার ব্যাপারে ভয় জাগ্রত হয়।
তারা অপরাধ করার আগে এর পরিণাম নিয়ে শতবার ভাবে। তাই সমাজের সর্বস্তরে সুবিচার নিশ্চিত করা বাঞ্ছনীয়। যেসব লোক সুবিচার করে, মহান আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘এরা মিথ্যা বলার জন্য গুপ্তচরবৃত্তি করে, হারাম খায়। অতএব, তারা যদি তোমার কাছে আসে, তবে হয় তাদের মধ্যে ফয়সালা করে দাও, না হয় তাদের ব্যাপারে নির্লিপ্ত থাক। যদি তাদের থেকে নির্লিপ্ত থাক, তবে তাদের সাধ্য নেই যে, তোমার বিন্দুমাত্র ক্ষতি করতে পারে। যদি ফয়সালা কর, তবে ন্যায়ভাবে ফয়সালা কর। নিশ্চয় আল্লাহ সুবিচারকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা মায়িদা : ৪২)।
দ্বীনের পথে সংগ্রাম : দ্বীন কায়েমের জন্য আল্লাহর পথে জিহাদ, সংগ্রাম ও লড়াই করা তাঁর কাছে খুব প্রিয় ও পছন্দনীয়। যারা আল্লাহর পথে লড়াই করে এ পথের যাবতীয় কষ্ট-ক্লেশ সহ্য করে এবং সংগ্রামের পরিশ্রমের ওপর ধৈর্যধারণ করে, তাদের আল্লাহতায়ালা অত্যন্ত পছন্দ করেন ও নিতান্ত ভালোবাসেন।
এ ব্যাপারে কোরআনে কারিমে এসেছে, ‘বহু নবী ছিল, যাদের সঙ্গীরা তাদের অনুবর্তী হয়ে জিহাদ করেছে আল্লাহর পথে; তাদের কিছু কষ্ট হয়েছে বটে; কিন্তু আল্লাহর রাহে তারা হেরেও যায়নি, ক্লান্তও হয়নি এবং দমেও যায়নি। আর যারা সবর করে, আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন।’
(সুরা আলে ইমরান : ১৪৬)। এ প্রসঙ্গে মহাগ্রন্থ আল কোরআনের অন্য আয়াতে এসেছে, ‘আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন, যারা তাঁর পথে সারিবদ্ধভাবে লড়াই করে,
যেন তারা শীসা গালানো প্রাচীর।’ (সুরা সফ : ৪)।
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা