ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মক্কা শরিফের জুমার খুতবা

মূর্খতার ভয়াবহ পরিণাম

শায়খ ড. ফয়সাল বিন জামিল গাজ্জাবি
মূর্খতার ভয়াবহ পরিণাম

মূর্খতা আর জ্ঞান যে এক নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মূর্খতা মূলত দু’ধরনের- এক. সত্য সম্পর্কে না জানা, দুই. সত্যের চাহিদা ও দাবি মোতাবেক আমল না করা। জ্ঞানানুযায়ী আমল না করাকে মূর্খতা বলার কারণ হলো, হয়তো সে জ্ঞান আমলে বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে মূর্খতার কাতারে শামিল হয়েছে। অথবা তার মূর্খতার কারণে অশুভ পরিণাম অপেক্ষা করছে। সত্য না জানার ফলে লুত (আ.) তার জাতিকে মূর্খ জাতি বলে অভিহিত করেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি লুতকে (নবী বানিয়ে) পাঠালাম। সে তার সম্প্রদায়কে বলল, তোমরা কি চাক্ষুস দেখেও অশ্লীল কাজ করছ? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য যে, তোমরা কামণ্ডচাহিদা পূরণের জন্য নারীদের ছেড়ে পুরুষদের কাছে যাও? বস্তুত তোমরা অতি মূর্খতাসুলভ কাজ করছ।’ (সুরা নামল : ৫৪-৫৫)। ইউসুফ (আ.) দোয়া করলেন, ‘হে প্রতিপালক! এ নারীরা আমাকে যে কাজের দিকে ডাকছে, তা অপেক্ষা কারাগারই আমার বেশি পছন্দ। তুমি যদি আমাকে তাদের ছলনা থেকে রক্ষা না কর, তবে আমার অন্তর তাদের দিকে আকৃষ্ট হবে। যারা অজ্ঞতাসুলভ কাজ করে, আমিও তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব।’ (সুরা ইফসুফ : ৩৩)। অর্থাৎ যারা ইলম অনুযায়ী আমল করে না, তারা মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত।

জ্ঞানের মূল্য ও জ্ঞানহীনতার ভয়াবহতা : ইলম ও জ্ঞানার্জন করা অনেক বড় নৈকট্য ও সওয়াবের কাজ। সুতরাং ইলম অর্জন না করা এবং তদানুযায়ী আমল না করা অনেক বড় গোনাহ ও নিষিদ্ধ কাজ। নবীজি (সা.) অপকারী ইলম থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় কামনা করেছেন। সুতরাং ইলম অনুযায়ী আমল করা চাই। নইলে অপকারী, ফায়দাহীন ও আমলহীন ইলম কেয়ামতে তার বিপক্ষে সাক্ষী হবে। আবু দারদা (রা.) বলেন, আমার এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি ভয় হয় যে, কেয়ামতে আমাকে বলা হবে, হে উমায়ের! তুমি ইলম অর্জন করেছ? অতঃপর বলা হবে, তোমার ইলম অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছ? ফুজাইল ইবনে আয়াজ (রহ.) বলেন, ‘ইলম অনুযায়ী আমল না করা পর্যন্ত কাউকে আলেম বলা চলে না; বরং সে মূর্খ।’ তিনি আরো বলেন, ‘ইলম দ্বারা মূলত আমল উদ্দেশ্য। বস্তুত ইলম হলো আমলের দলিল।’

মূর্খতা সব অনিষ্টের মূল : মূর্খতা একটি মারাত্মক ব্যাধি এবং অত্যন্ত নিকৃষ্ট কাজ। মূর্খতা সব অপরাধ ও গোনাহের মূল, সব অনিষ্টের উৎস। দ্বীন-দুনিয়া ধ্বংসের কারণ ও মাধ্যম। সুতরাং জ্ঞানীদের এ ব্যাপারে ভাবা উচিত। মূর্খদের কর্মের ফলে কোরআনের ভীতি প্রদর্শনের ব্যাপারে তাদের চিন্তা-ভাবনা করা উচিত; যাতে তারা তাদের সাদৃশ্য না হয়ে যায়।

ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, নবীজি (সা.)-এর আগমনের আগে মানুষকে জাহেলি যুগের মানুষ হিসেবে অভিহিত করা হতো। ফলে তাদের মূর্খতার কারণে আল্লাহতায়ালা সম্পর্কে অশালীন ও গর্হিত মন্তব্য করত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের প্রতি দুঃখের পর প্রশান্তি অবতীর্ণ করলেন তন্দ্রারূপে; যা তোমাদের মধ্যে কতক লোককে আচ্ছন্ন করেছিল। আর একটি দল এমন ছিল, যাদের চিন্তা ছিল শুধু নিজেদের নিয়ে। তারা আল্লাহ সম্পর্কে অন্যায় ধারণা করছিল, সম্পূর্ণ জাহেলি ধারণা। তারা বলছিল, আমাদের কোনো এখতিয়ার আছে নাকি? বলে দাও, সব এখতিয়ার শুধু আল্লাহরই। তারা তাদের অন্তরে এমন সব কথা গোপন রাখে, যা তোমার কাছে প্রকাশ করে না। তারা বলে, আমাদের যদি কিছু এখতিয়ার থাকত, তবে আমরা এখানে নিহত হতাম না। বলে দাও, তোমরা যদি নিজ ঘরেও থাকতে, তবুও কতল হওয়া যাদের নিয়তিতে লেখা আছে, তারা নিজেরাই বেরিয়ে নিজ নিজ বধ্যভূমিতে পৌঁছে যেত। (এসব হয়েছিল) এ কারণে যে, তোমাদের বক্ষদেশে যা কিছু আছে, আল্লাহ তা পরীক্ষা করতে চান এবং যা কিছু তোমাদের অন্তরে আছে, তা পরিশোধন করতে চান। আল্লাহ অন্তরের ভেদ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞাত।’ (সুরা আলে ইমরান : ১৫৪)। তাদের ধারণা ছিল, ইসলাম সত্য নয়; আল্লাহ নবীজি (সা.)-কে কখনও সাহায্য করবেন না; ইত্যাদি ইত্যাদি।

মূর্খদের চিন্তা নৈতিক ভ্রষ্টতা : আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তবে কি তারা জাহেলি যুগের ফয়সালা চায়? যারা নিশ্চিত বিশ্বাস রাখে, তাদের জন্য আল্লাহ অপেক্ষা উত্তম ফয়সালা দানকারী কে হতে পারে?’ (সুরা মায়িদা : ৫০)। আল্লাহতায়ালা নবীজি (সা.)-কে শিক্ষা দিয়েছেন যে, মূর্খদের কীভাবে সম্বোধন করতে হয়! আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(হে নবী! তাদের বল,) আমি কি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে শালিস বানাব, অথচ তিনিই তোমাদের প্রতি এ কিতাব নাজিল করেছেন বিস্তারিত বিবরণরূপে? (আগে) যাদের আমি কিতাব দিয়েছিলাম, তারা নিশ্চিতভাবে জানে, এটা তোমার প্রতিপালকের কাছ থেকে সত্য নিয়ে অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং কিছুতেই তুমি সন্দীহানদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।’ (সুরা আনআম : ১১৪)। আল্লাহতায়ালা এ কোরআন শুধু নবীজি (সা.)-কে প্রদান করেছেন; যা হালাল-হারাম বর্ণনাকারী।

দ্বীনের মৌলিক ও শাখা মাসায়েল বর্ণনাকারী। যেই বর্ণনার পর কোনো বর্ণনা এবং বয়ান থাকতে পারে না। মূর্খদের মূর্খতার একটি দৃষ্টান্ত ও দৃশ্য হলো, যা কোরআনে বর্ণিত হয়েছে। যা তাদের লজ্জিত ও লাঞ্ছিত করার লক্ষ্যে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কাফেররা যখন তাদের অন্তরে অহমিকাকে স্থান দিল, যা ছিল জাহেলি যুগের অহমিকা, তখন আল্লাহ ও তাঁর রাসুল এবং মুসলমানদের ওপর নিজ প্রশান্তি বর্ষণ করলেন। তাদেরকে তাকওয়ার বিষয়ে স্থিত করে রাখলেন। তারা তো এরই বেশি উপযুক্ত ছিল। আল্লাহ সব বিষয়ে সম্যক জ্ঞাত।’ (সুরা ফাতহ : ২৬)।

নারীদের উচ্ছৃংখল চলাফেরা মূর্খতা : এ উম্মাহর নারীদেরকে আল্লাহ মূর্খ জাহেলদের বেশভূশা গ্রহণ করতে নিষেধ করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিজ ঘরে অবস্থান কর (পরপুরুষকে) সাজসজ্জা প্রদর্শন করে বেড়িও না, যেমন প্রাচীন জাহেলি যুগে প্রদর্শন করা হতো। নামাজ কায়েম কর, জাকাত আদায় কর এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের আনুগত্য কর। হে নবী পরিবার (আহলে বাইত)! আল্লাহ তো চান তোমাদের থেকে মলিনতা দূরে রাখতে এবং তোমাদের সর্বোত প্রকারে পবিত্রতা দান করতে।’ (সুরা আহযাব : ৩৩)।

কেননা, ইসলামপূর্ব যুগে কাফেরদের কোনো ভালো গুণ ছিল না। নারীরা তাদের সাজসজ্জাকে, আকর্ষণীয় স্থানকে পুরুষদের সামনে প্রকাশ করত। এ সবই জাহেলি যুগের দৃশ্য। যারা সত্য সম্পর্কে অনবগত ছিল। তখন আল্লাহতায়ালা নবীজি (সা.)-কে এমন এক শ্বাশ্বত দ্বীন প্রদান করেন, যা কেয়ামত পর্যন্ত কায়েম থাকবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘(হে রাসুল!) আমি তোমাকে দ্বীনের এক বিশেষ শরিয়তের ওপর রেখেছি। সুতরাং তুমি তারই অনুসরণ কর। যারা প্রকৃত জ্ঞান রাখে না, তাদের খেয়ালখুশির অনুসরণ করো না।’ (সুরা জাসিয়া : ১৮)।

সুদি অর্থব্যবস্থায় জাহেলি যুগের ছাপ : নবীজি (সা.) জাহেলিদের যে দৃশ্য ও দিক বর্ণনা করেছেন, তার মধ্যে রয়েছে তাদের প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা; যা সুদি অর্থব্যবস্থা। নবীজি (সা.) সুদি অর্থব্যবস্থাকে জাহেলি অর্থব্যবস্থা বলে সাব্যস্ত করেছেন।

কেননা, তারাই এমন অবৈধ বিধ্বংসী অর্থব্যবস্থা বৈধ বলে সাব্যস্ত করেছে। ইসলামের সুশীতল বায়ু প্রবাহে তা হারাম হয়ে গেছে। ইসলাম এমন কারবার করার ব্যাপারে সতর্ক করেছে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘জাহেলি যুগের সুদ বাতিল ও প্রত্যাখ্যাত। সুতরাং সে যুগের অর্থনৈতিক সুদি কার্যক্রম এ যুগের কোনো প্রান্তে থাকলে তা হারাম ও পরিত্যাজ্য হবে।’

মূর্খতা কেয়ামতের আলামত : হাদিসে এসেেেছ, কেয়ামতের একটি অন্যতম আলামত হলো প্রকৃতপক্ষে ইলম উঠে যাওয়া এবং জ্ঞান অর্জনের ভুরি ভুরি উপকরণ থাকা সত্ত্বেও মূর্খতা বেড়ে যাওয়া।

অতএব, প্রত্যেক মুসলমানের উচিত, আল্লাহর দ্বীনের ব্যাপারে নিজে ইলম শিখে আমল করে মূর্খতা থেকে বাঁচা। নিজেকে উপকারী জ্ঞান ও ইলমের প্রদীপ জ্বালাতে উদ্বুদ্ধ করা। দ্বীনের ব্যুৎপত্তি অর্জন করা এবং তার বিপরীতে না থাকা। সুফিয়ান বিন উয়াইনা (রহ.) বলেন, ‘জ্ঞান অনুযায়ী আমল করতে পারলে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি। এর ব্যাতিক্রম ঘটলে দুনিয়ায় আমার চেয়ে কোনো মূর্খ ব্যক্তি আর নেই। মূর্খতায় অকল্যাণ ছাড়া কল্যাণ নেই।

৪ রবিউস সানি ১৪৪৫ (২০ অক্টোবর ২০২৩) তারিখে মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন - মুহাম্মাদুল্লাহ ইয়াসিন

আলোকিত বাংলাদেশ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত