দিনের প্রথম সালাত
মিজান ইবনে মোবারক
প্রকাশ : ২৭ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আনুগত্যের মূল এবং সৎ কর্মের বুনিয়াদ হলো নামাজ। নামাজ উম্মুল ইবাদত, ঈমানের প্রকৃত প্রতীক। প্রাপ্তবয়স্ক হ?ওয়ার পরে অথবা ইসলাম গ্রহণের পর সবচেয়ে মহান গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো নামাজ আদায় করা। নামাজ সবচেয়ে উত্তম আমল। নামাজ এমন গুরুত্বপূর্ণ আমল, যার ব্যাপারে বান্দাকে কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। যার নামাজ ঠিক থাকবে, তার অন্যান্য আমলগুলোও সহজে সঠিক বলে বিবেচিত হবে। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রত্যেক নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত থাকা সত্ত্বেও ফজর নামাজ গুরুত্ব ও ফজিলতের বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ। এমনকি আল্লাহতায়ালা ফজরের কসম করেছেন। আর আল্লাহতায়ালা শুধু বড় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দ্বারাই শপথ করে থাকেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘শপথ ফজরের।’ (সুরা ফাজর : ১)।
ফজর নামাজের গুরুত্ব : পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মধ্যে ফজর ও ইশার নামাজের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা, তুলনামূলকভাবে এ দুই ওয়াক্তের নামাজ আদায় করা কষ্টকর। যারা এ কষ্টের নামাজে অভ্যস্ত হবে, তাদের জন্য অন্য ওয়াক্তের নামাজ আদায় করাও সহজ হবে। কোরআন ও হাদিসে এ নামাজের প্রতি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা ফজর নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন, ‘নামাজ কায়েম করো সূর্য ঢলে পড়ার পর থেকে রাতের অন্ধকার পর্যন্ত এবং কায়েম করো ফজরের নামাজ। নিশ্চয় ফজরের নামাজ উপস্থিতির সময়।’ (সুরা বনী ইসরাইল : ৭৮)। নবীজি (সা.) ফজর নামাজে উপস্থিত হওয়ার প্রতি উৎসাহ ও জোর তাগিদ দিয়ে বলেছেন, ‘আজানে ও প্রথম কাতারে কী (ফজিলত) রয়েছে, তা যদি লোকেরা জানত, লটারির মাধ্যমে বাছাই করা ছাড়া এ সুযোগ লাভ করা যদি সম্ভব না হতো, তাহলে অবশ্যই তারা লটারির মাধ্যমে ফয়সালা করত। জোহরের সালাত প্রথম ওয়াক্তে আদায় করার মধ্যে কী (ফজিলত) রয়েছে; যদি তারা জানত, তাহলে তারা এর জন্য প্রতিযোগিতা করত। আর ইশা ও ফজরের সালাত (জামাতে) আদায়ের কী ফজিলত রয়েছে, তা যদি তারা জানত, তাহলে নিঃসন্দেহে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তারা হাজির হতো।’ (বোখারি : ৬১৫)।
ফজরের সুন্নতের গুরুত্ব : ফজরের নামাজের গুরুত্ব অন্যান্য নামাজের ওপর যেমন, ফজরের সুন্নতের গুরুত্ব?ও অন্যান্য সুন্নতের ওপর তেমন। ফজিলতের ক্ষেত্রে ফজরের সুন্নত সম্পর্কে যা বর্ণিত হয়েছে, অন্য সুন্নতের ব্যাপারে এমন ফজিলত বর্ণিত হয়নি। তাই ফজরের সুন্নতে রয়েছে অধিক গুরুত্ব। আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত; নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘ফজরের দু-রাকাত (সুন্নত) সালাত দুনিয়া ও তার সবকিছু থেকে উত্তম।’ (মুসলিম : ৭২৫)। নবীজি (সা.) সফর অথবা মুকিম অবস্থায় কখনোই তা ছাড়তেন না। ফরজ নামাজের ব্যাপারে যেমন সতর্ক থাকতেন, তেমনি ফজরের সুন্নতের ব্যাপারেও থাকতেন সর্বোচ্চ সতর্ক। যা আয়েশা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে ফুটে উঠেছে; নবীজি (সা.) ফজরের (ফরজ সালাতের) আগে দু’রাকাত সুন্নত আদায়ের প্রতি যত কঠোরভাবে খেয়াল রাখতেন, অন্য কোনো নফল সালাতের প্রতি ততটা রাখতেন না। (মুসলিম : ৭২৪)। অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা এ দু-রাকাত কখনও ত্যাগ করো না, শত্রুবাহিনী তোমাদের তাড়া করলেও।’ (সুনানে আবি দাউদ : ১২৫৮)।
ফজরে ফেরেশতাদের উপস্থিতি : ফজরের সময় দিনরাতের ফেরেশতাদের পালাবদল হয়। তবে ফজরের নামাজে উভয় দল একত্রিত হয়। এরপর দুনিয়াতে এক দল থেকে যায়, আরেক দল আল্লাহর কাছে উপস্থিত হয়। আর এ সময় বান্দা যা কিছু করে, ফেরেশতারা তা আল্লাহর কাছে পেশ করে। তাই এ সময়ের নামাজ, ইবাদত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ফেরেশতারা পালাবদল করে তোমাদের মাঝে আগমন করে। এক দল দিনে, এক দল রাতে। আসর ও ফজরের সালাতে উভয় দল একত্র হয়। অতঃপর তোমাদের মাঝে রাতযাপনকারী দলটি উঠে যান। তখন তাদের প্রতিপালক তাদের জিজ্ঞেস করেন, আমার বান্দাদের কোন অবস্থায় রেখে এলে? অবশ্য তিনি নিজেই তাদের ব্যাপারে সর্বাধিক অবগত। উত্তরে তারা বলেন, আমরা তাদের সালাতে রেখে এসেছি। আর আমরা যখন তাদের কাছে গিয়েছিলাম, তখনও তারা সালাত আদায়রত অবস্থায় ছিল।’ (বোখারি : ৫৫৫)।
আল্লাহ তার জিম্মাদার : ফজরের নামাজ আদায়কারী আল্লাহর জিম্মায় থাকে। আল্লাহ তাকে নিরাপত্তা দিয়েছেন। সুতরাং তাকে যে অযথা কষ্ট দেবে, অন্যায়-অবিচার করবে, আল্লাহ তাকে কঠোর শাস্তি দেবেন। এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ফজরের সালাত আদায় করল, সে আল্লাহর নিরাপত্তা লাভ করল। আর আল্লাহতায়ালা যদি তার নিরাপত্তা প্রদানের হক কারও থেকে দাবি করে বসেন, তাহলে সে আর রক্ষা পাবে না। তাই তাকে মুখ থুবড়ে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করবেন।’ (মুসলিম : ৬৫৭)।
নূরের সংবাদ : যে ব্যক্তি কষ্ট করে ঘুম থেকে জাগ্রত হয় এবং নামাজের জন্য অন্ধকারে মসজিদে গমন করে, তাকে কেয়ামতের দিন পূর্ণ নূরের মাধ্যমে এর প্রতিদান দেওয়া হবে। বুরায়দা (রা.) থেকে বর্ণিত; নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যারা অন্ধকার রজনীতে মসজিদে হাজির হয়ে জামাতে নামাজ আদায় করে, তাদের কেয়ামতের দিনের পরিপূর্ণ নূরের সুসংবাদ দাও।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৫৬১)।
মুক্তির মাধ্যম : নামাজ মানুষকে অন্যায়-অবিচার হতে দূরে রাখে। নেক আমলসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম আমল নামাজ। যে ব্যক্তি ঠিকভাবে নামাজ আদায় করে নিজেকে আল্লাহর অবাধ্যতা হতে হেফাজত করে, আল্লাহতায়ালাও তাকে জাহান্নাম হতে হেফাজত করেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘এমন কোনো ব্যক্তি জাহান্নামে যাবে না, যে সূর্যোদয়ের আগের এবং সূর্যাস্তের আগের সালাত, অর্থাৎ ফজর ও আসরের সালাত আদায় করে।’ (মুসলিম : ৬৩৪)।
কপটতা থেকে মুক্তি : মোমিন ব্যক্তির জন্য আল্লাহর ইবাদত করা সহজ। কিন্তু মোনাফেকের জন্য খুবই কষ্টকর?। মোনাফিকরা সুযোগ সন্ধানী। লোকচক্ষুর আড়ালে ইবাদতে ফাঁকি দেয়। ইশা ও ফজরের নামাজ তাদের জন্য খুব কষ্টকর। কেননা, এ সময় মানুষ অন্ধকারে দেখতে পায় না বলে তারা নামাজে খুব অলসতা করে। তাই ফজর নামাজে হাজির হওয়া নেফাকি থেকে মুক্ত হওয়ার আলামত। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত; নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘মোনাফিকদের জন্য ফজর ও ইশার সালাত অপেক্ষা অধিক ভারী সালাত আর নেই।’ (বোখারি : ৬৫৭)।
কিয়ামুল লাইলের স?ওয়াব : যে ইবাদতে কষ্ট যত বেশি, তার স?ওয়াব?ও তত বেশি। স?ওয়াব হয় কষ্ট ও নিয়ত অনুপাতে। ফজর নামাজ একাকী পড়া কিছুটা সহজসাধ্য হলেও জামাতে আদায় করা খুব কষ্টকর। এ জন্য জামাতে ফজরের সালাতে স?ওয়াব?ও বেশি রাখা হয়েছে। উপরন্তু ফজর এবং ইশার নামাজ জামাতে পড়ার প্রতি ইসলামে বিশেষভাবে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। কেননা, এর স?ওয়াব অন্যান্য নামাজের চেয়ে অনেক বেশি এবং মহৎ। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি জামাতের সঙ্গে ইশার সালাত আদায় করল, সে যেন অর্ধেক রাত পর্যন্ত সালাত আদায় করল। আর যে ব্যক্তি ফজরের সালাত জামাতের সঙ্গে আদায় করল, সে যেন সারারাত জেগে সালাত আদায় করল।’ (মুসলিম : ৬৫৬ )।
শয়তানের প্রভাব হতে মুক্তি : যে ব্যক্তির সকাল শুরু হয় আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে। এর অর্থ? হলো, দিনের শুরুতেই সে শয়তানকে পরাস্ত করে দিয়েছে। শয়তানের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকতে পেরেছে। এভাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মাধ্যমে দিনের শেষ পর্যন্ত শয়তানের প্রভাব থেকে তার জন্য দূরে থাকা সহজ হয়। তার দিন কাটে হাসিখুশি ও প্রফুল্লতার মধ্যে। অন্যথায় যার সকাল শুরু হয় আল্লাহর অবাধ্যতার মাধ্যমে, সে দিনের শুরুতেই শয়তানের কাছে পরাজয় বরণ করে নেয়। দিনের শেষ পর্যন্ত শয়তান তাকে সহজেই কাবু করতে সক্ষম হয়। আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত; নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন শয়তান তার ঘাড়ের পেছনের অংশে তিনটি গিঁট দেয়। প্রতি গিঁটে সে এ বলে চাপড়ায়, তোমার সামনে রয়েছে দীর্ঘ রাত।
অতএব, তুমি শুয়ে থাক। অতঃপর যদি সে জাগ্রত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে, একটি গিঁট খুলে যায়। এরপর অজু করলে, আরেকটি গিঁট খুলে যায়। অতঃপর সালাত আদায় করলে, আরেকটি গিঁট খুলে যায়। তখন তার প্রভাত হয় উৎফুল্ল মনে। অন্যথায় সে সকালে ওঠে কলুষ-কালিমা ও আলস্যে।’ (বোখারি : ১১৪২)।