মকতব মুসলমান শিশুদের বিকশিত হওয়ার প্রথম ধাপ। একজন শিশু মকতব থেকে শেখে আলিফ, বা, তা, ছা কিংবা আলিফে আল্লাহ, বা-তে বাইতুল্লাহ। এভাবে সে নুরানি কায়েদার গণ্ডি পেরিয়ে আমপারা শেখে। তারপর ধাপে ধাপে পবিত্র কোরআন শেখে। মুসলমান শিশুরা মকতব থেকেই শিক্ষার প্রথম ধাপ শুরু করে। মকতব থেকেই কোরআন সহিহ-শুদ্ধভাবে শেখে। শিশু ইসলামি মননে বিকশিত হওয়ার প্রথম ধাপ হচ্ছে মকতব। মক্তবের যাত্রা প্রাচীন আমল থেকে শুরু হয়েছে। বড় বড় মুসলিম মনীষা মকতব থেকেই প্রথম শিক্ষা লাভ করেছেন। এ উপমহাদেশে সিন্ধু বিজয়ের পর মুসলিম বিজেতারা মুসলমানদের শিক্ষার জন্য মকতব ও মাদরাসা চালু করেন। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এ অঞ্চলে বড় বড় দরবেশ, সুফি, জ্ঞানী, সাধকগণ এসে ইসলামের বাণী প্রচার করে গেছেন। তারা প্রতিষ্ঠা করেছেন অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা, মকতব, হেফজখানা। আস্তে আস্তে মুসলমানরা পুরো উপমহাদেশে ছড়িয়ে যায়। ইসলামের বাহকগণ যেখানে গেছেন, সেখানেই গড়ে তুলেছেন প্রতিষ্ঠান।
মকতব থেকে জীবনের সবক : একটা শিশু মকতব থেকে তার জীবনের সবক পেয়ে যায়। সে শুধু কোরআন শেখে, এমন নয়; মকতব থেকে শেখে অজু ভঙ্গের কারণ, গোসলের ফরজ, অজুর ফরজ, গোসল ফরজ হওয়ার কারণ, তায়াম্মুমের নিয়মাবলি। এসব বিষয় মানুষের সারা জীবন দরকার; যদি সে পবিত্রতা অর্জন করতে চায়।
এ ছাড়া দলবদ্ধভাবে কালিমায়ে তাইয়্যিবা, শাহাদত, তাওহিদ, ঈমানে মুজমাল ও মুফাসসাল শেখে। এগুলো উচ্চস্বরে সুর ধরে শেখানো হয়। ফলে শিশুদের মনে এমনভাবে গেঁথে যায়, যা সারা জীবনের হাতেখড়ি হয়। ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম নামাজ। নামাজের ফরজ, ওয়াজিব কীভাবে পালন করা হয়, কোন কোন কাজে নামাজ ভঙ্গ হয়, কোন কোন কাজে মাকরুহ হয়, নামাজে কি কি দোয়া পড়তে হবে, কোথায় কোন দোয়া পড়তে হবে, সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে সবাইকে নামাজ শেখানো হয় মকতবে। তেমনি ওয়াশরুমে যাওয়ার দোয়া, মসজিদে যাওয়ার দোয়া থেকে শুরু করে যাবতীয় দোয়া-দুরুদ মকতবেই শেখানো হতো।
মকতবগুলো শূন্য হয়ে যাচ্ছে : বিংশ শতাব্দীতে এসে কেমন যেন এ যাত্রা স্তমিত হয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তির ব্যাপক উৎকর্ষে হারিয়ে যাচ্ছে মকতবব্যবস্থা। একসময় গ্রামাঞ্চলে মায়েরা ভোরে উঠে ফজর শেষে সুললিত ধ্বনিতে কোরআন তেলাওয়াত করতেন।
সন্তানদের মকতবে পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন। কিন্তু প্রযুক্তির ব্যাপকতায় আজ সেই ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে বসেছে। ফলে বর্তমানে অধিকাংশ মুসলিম সন্তান কোরআনবিমুখ হয়ে যাচ্ছে। সহিহ-শুদ্ধভাবে কোরআন পড়তে না জানার কারণে তারা কোরআনের প্রতি ভালোবাসা হারিয়ে ফেলেছে। কালের বিবর্তনে মানুষের হাতে প্রযুক্তির উৎকর্ষতা। প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় আজ ইসলামের সেই সোনালি অধ্যায় হারিয়ে যেতে বসেছে। মকতবগুলো আস্তে আস্তে শূন্য হয়ে যাচ্ছে। আগেকার মায়েরা ফজর নামাজ পড়ে সন্তাদের মকতবে যাওয়ার জন্য বাধ্য করতেন। বর্তমানে সেটা হারিয়ে গেছে। এখন রাত গভীরে ঘুমানোর কারণে ফজরে অবচেতন মনে ঘুমিয়ে থাকে। ফলে মুসলিম শিশুরা আগের সেই ঐতিহ্যের ছোঁয়া পাচ্ছে না।
মকতব চ্যারিটি ফান্ডের উদ্যোগ : বাংলাদেশে মকতব শিক্ষায় অনেকে অবদান রেখেছেন। বর্তমানেও এ মুসলিম ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন অনেকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ধরা যায় ‘মকতব চ্যারিটি ফান্ড’।
যেটা সার্কেল একাডেমির পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে সারা দেশে বিস্তৃত রয়েছে সার্কেল একাডেমির কার্যক্রম। তারা অনলাইন-অফলাইন দুটোর মাধ্যমে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এ রকম স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে মুসলিম শিশুদের বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া সত্যিই প্রশংসনীয় কাজ। যারা মকতব শিক্ষা নিয়ে কাজ করেন, তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করে দেশের প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় খুব অল্প সময়ে হারিয়ে যাবে শত শত বছরের এ ঐতিহ্য।