মক্কা শরিফের জুমার খুতবা
কেয়ামতের দাঁড়িপাল্লা সত্য
শায়খ ড. ফয়সাল বিন জামিল গাজ্জাবি
প্রকাশ : ১৭ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
কেয়ামতের অন্যতম একটি বিষয় হলো, মানদণ্ড বা দাঁড়িপাল্লা। কোরআন-হাদিসে এ সম্পর্কে বহু প্রমাণ রয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি কেয়ামতের দিন ন্যায়বিচারের মানদ- স্থাপন করব। সুতরাং কারো প্রতি জুলুম করা হবে না।
যদি কোনো আমল সরিষার দানা পরিমাণও হয়, আমি তা উপস্থিত করব। আর হিসাব গ্রহণে আমিই যথেষ্ট।’ (সুরা আম্বিয়া : ৪৭)। এ ছাড়া আরো দলিল রয়েছে। এসব দলিল প্রমাণ করে, কেয়ামতের দিন প্রতিস্থাপিত দাঁড়িপাল্লা সত্য-সঠিক, ও সূক্ষ্ম। যাতে কমবেশি করার সুযোগ নেই। এর দ্বারা পরিমাপের ফলেই ভালো-মন্দ ব্যক্তি আলাদা হয়ে যাবে। সুতরাং সৎকর্মশীল সফলকাম ও নাজাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা নেয়ামতে ভরা জান্নাতে স্থান পাবে। আর দুর্ভাগা-পাপিষ্ঠ ও হতভাগাদের স্থান হবে জাহান্নামের তলদেশে।
দাঁড়িপাল্লার দুটি পাল্লা থাকবে : কেয়ামতের দাঁড়িপাল্লা বাস্তবেই প্রতিষ্ঠিত হবে। তার দুটি পাল্লা থাকবে। তবে তার আকার ও আকৃতি কেমন হবে, তার স্বরূপ একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। শরয়ি দলিলাদি এ কথা প্রমাণ করে, এ পাল্লায় মানুষের আমল পরিমাপ হবে। তদ্রূপ তারা নিজেরাও পরিমাপ হবে। তাদের আমলনামা বা রেজিস্টারও পরিমাপ করা হবে।
বান্দার আমল পরিমাপ করা হবে : উল্লিখিত পাল্লায় বান্দার আমল পরিমাপ হবে। নবীজি (সা.) বলেন, ‘এমন দুটি বাক্য রয়েছে, যা আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়। পাল্লায় ভারী। কিন্তু জবানে অতি হালকা। তা হলো, সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আজিম।’ (বোখারি : ৭০৫৩)।
বান্দাকে পরিমাপ করা হবে : বান্দার আমল পরিমাপের পাশাপাশি বান্দাকেও পরিমাপ করা হবে। তার ঈমানের স্তরমতে তার ওজন কমবেশি হবে। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘কেয়ামতের দিন একজন খুব মোটা ব্যক্তি আসবে; কিন্তু সে আল্লাহর কাছে মশার পাখার চেয়ে ক্ষুদ্র হবে।’ (বোখারি : ৪৭২৯)। পক্ষান্তরে তার কাছে দুর্বল জীর্ণ-শীর্ণ দেহের মজবুত ঈমানের অধিকারী বান্দাকে উপস্থিত করা হবে। তখন তিনি তার দ্বারা পাহাড় পরিমাপ করবেন। তার ওজন অনেক বেশি হবে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তার পা ছোট ছিল, ফলে বাতাস তাকে নাড়িয়ে দিত। এটা দেখে মানুষ হাসতে লাগল। নবীজি (সা.) বললেন, ‘হাসার কারণ কী?’ কারণ শুনে নবীজি (সা.) বললেন, ‘আল্লাহর কসম! তার সেই ছোট পায়ের ওজন কেয়ামতে উহুদ পাহাড় থেকেও অনেক ভারী হবে।’ (মুসনাদে আহমদ ও সহিহ ইবনে হিব্বান)।
মানুষের আমলের রেজিস্টার মাপা হবে : মানুষের আমল পরিমাপের পাশাপাশি মানুষের আমলের খাতা ও রেজিস্টার পরিমাপ করা হবে। নবীজি (সা.) সূত্রে বর্ণিত; এমন দুটি বাক্য রয়েছে, যা আল্লাহর কাছে খুবই প্রিয়। পাল্লায় ভারী; কিন্তু জবানে অতি হালকা। তা হলো, সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আজিম।’ (বোখারি :৭০৫৩)। মিজান বা দাঁড়িপাল্লার এ স্বরূপ যখন জানতে পারলাম, তখন অবশ্যই আমাদের আমল সম্পর্কেও ভালোভাবে চিন্তা করা চাই। আমাদের নিশ্চিত হতে হবে, আমাদের ভালো-মন্দ সব কর্ম পরিমাপ হবে। ওমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, ‘তোমরা নিজেদের হিসাব করে নাও তোমাদের হিসাব আল্লাহতায়ালার করার আগে। নিজেদেরকে কেয়ামতে পরিমাপের আগে পরিমাপ করে নাও। কেননা, আগামীকালের হিসাব থেকে আজকের হিসাব খুবই সহজ।’ (আয যুহদ : ৬৩৩)।
ঈমানের বলে বলীয়ান হওয়ার ফল : একজন মানুষ ঈমানের বলে বলীয়ান হওয়ার ফলে পৌঁছে যাবে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্তরে। তখন তার ওজন উম্মাহ থেকে অনেক বেশি হবে। উম্মতে মুসলিমার মান-সম্মান, শ্রেষ্ঠত্ব ও তাদের ওজন অনেক হবে। তাদের মাঝে মহান ব্যক্তিদের ওজন তাদের তুলনায় অনেক বেশি হবে। ওমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, ‘যদি আবু বকর (রা.)-এর ঈমান এক পাল্লায় রাখা হয়, আর সব মানুষের ঈমান আরেক পাল্লায় রাখা হয়, তাহলে আবু বকর (রা.)-এর ঈমানের ওজন বেশি হবে। তিনি উম্মাহর একজন মহান ব্যক্তি ছিলেন, আল্লাহতায়ালা তার দ্বারা দ্বীনকে শক্তি সঞ্চার করিয়েছেন।’ নবীজি (সা.)-এর ইন্তেকালের পর সাহাবিদের কঠিন পেরেশানি দেখে তিনি দাঁড়িয়ে দারাজ কণ্ঠে ঘোষণা করতে লাগলেন, ‘যে ব্যক্তি মুহাম্মদ (সা.)-এর ইবাদত করত, সে শুনে রাখুক যে, মুহাম্মদ (সা.) মারা গেছেন। আর তোমাদের যে ব্যক্তি আল্লাহর ইবাদত করত, সে জেনে রাখুক যে, আল্লাহতায়ালা চিরঞ্জীব। তিনি মৃত্যুবরণ করেন না।’ এ কথা শুনে সাহাবিরা সম্বিত ফিরে পেলেন। তার প্রতি তার কথায় সন্তুষ্ট হয়ে গেলেন।
পাল্লা ভারী হওয়ার অন্যতম দিক : মানুষের স্বাধীনতা তার প্রতিপালকের পরিপূর্ণ দাসত্বে। তার শ্রেষ্ঠত্ব তার ঈমান, তাকওয়া ও সৎকর্মের জন্যই। সুতরাং নেক আমলের পাল্লা ভারী হয়, এমন আমল বাড়িয়ে দেওয়া চাই। এসব আমলের অন্যতম হলো, আদর্শবান ও উত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়া। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন মোমিন বান্দার পাল্লা ভারী হওয়ার অন্যতম দিক হলো, তার উত্তম চরিত্র। আরেকটি অন্যতম আমল হলো এ দোয়া বেশি বেশি করা- সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আজিম।’ নবীজি (সা.) আরো বলেছেন, ‘শুধু আলহামদুলিল্লাহ কেয়ামতের পাল্লাকে পরিপূর্ণ করে দেবে।’ (মুসলিম : ৩৭০০)। এসব হাদিস প্রমাণ করে, এমন কিছু আমল রয়েছে, যা কেয়ামত দিবসে পাল্লা ভারী করে। এসব আমলের শ্রেষ্ঠ হলো, কালিমায়ে তাওহিদ অর্থাৎ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।
মিজানের প্রতিঈমান আনার ফল : মিজান বা দাঁড়িপাল্লার প্রতি ঈমান আনার অনেক ফায়দা রয়েছে। যেমন- এ পাল্লা মানুষের বিপক্ষে দলিল হতে পারে। এ পাল্লা আল্লাহর ইনসাফের নিদর্শন। সফলকামদের জান্নাতে প্রবেশের আগে এ পাল্লায় হিসাব-নিকাশ দেখে তারা আনন্দিত হবে।
কেয়ামত দিবসে জালেমের হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে এ পাল্লা মাজলুম ব্যক্তিকে সহজতা এনে দেবে। এ পাল্লা আল্লাহর মনোনীত দ্বীনে অটল থাকার শক্তি জোগাবে। কেননা, পরকালে হিসাব-নিকাশের কাঠগড়ায় সবাইকে দাঁড়াতে হবে। এর প্রতি বিশ্বাসের ফলে মানুষ সৎকাজের প্রতিযোগিতা করবে। অসৎকাজ হতে বিরত থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে।
মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন - মুহাম্মাদুল্লাহ ইয়াসিন