দোয়া মোমিনের হাতিয়ার
সাখাওয়াত মিয়াজী
প্রকাশ : ১৭ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
মোমিনের জন্য নিরন্তন সহযোগী ও হাতিয়ার হচ্ছে দোয়া। দোয়ার মাধ্যমে জীবনে সমৃদ্ধি ও সফলতা আসে। বিপদাপদ দূর হয়ে যায়। পার্থিব এ জীবনে এমন কেউ নেই, যার কোনো সমস্যা নেই। আছে কি কেউ এমন, যার কোনো বিপদাপদ নেই? হতাশা ও দুর্দশা নেই? মানুষের জীবনে এসব শব্দ ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কোনো না কোনো সমস্যা লেগেই থাকে মানুষের জীবনে। এরই মাঝে তার জীবনতরী বাইতে হয়। ব্যক্তি জীবন থেকে নিয়ে পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত মানুষের সমস্য গড়াতে থাকে। কেউ ব্যক্তি জীবন নিয়ে চিন্তিত, কেউ পারিবারিক জীবনে অসুখী, আবার কেউ রাষ্ট্রীয় জীবনে বিভিন্ন ঝামেলায় জর্জরিত। এসব হরহামেশাই পরিলক্ষিত হয়। দুনিয়াবি ঝামেলা ছাড়াও আখেরাতের ঝামেলা থেকে মুক্তির প্রয়োজন রয়েছে। দুনিয়ার সুখ-শান্তির সঙ্গে আখেরাতের সুখ-শান্তির কথাও চিন্তা করতে হয়। এসব কিছু মূলত দোয়ার মাধ্যমে সম্ভব।
আল্লাহ ছাড়া কেউ প্রয়োজন পূর্ণ করতে পারে না : আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা আমার কাছে চাও, আমি তোমাদের দেব। দোয়া করলে তা কবুল করব। সমস্যা থাকলে তা সমাধান করে দেব।’ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউই মানুষের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে না। সমস্যার সমাধান দিতে পারে না। পারে না পরকালে সুখ দিতে ও শাস্তি থেকে মুক্ত করতে। মানুষ চাইতে লজ্জাবোধ করে, আর আল্লাহ খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন। হাদিসে এসেছে, ‘যখন মানষ কিছু চাওয়ার জন্য দু’হাত তোলে, তখন তিনি সে হাত দুটিকে ব্যর্থ ও খালি ফেরত দিতে লজ্জাবোধ করেন।’ (মুসলিম : ৩২১)। অপর এক হাদিসে এসেছে, ‘দোয়া মোমিনের হাতিয়ার; দ্বীনের স্তম্ভ ও আসমান-জমিনের আলো।’ (মুসলিম : ৪৬৫)।
দোয়া একটি স্বতন্ত্র ইবাদত : দোয়ার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহতায়ালার প্রিয় ও নৈকট্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত হয়। মানুষমাত্রই ভুল করে, গোনাহ করে। নবীরা ছাড়া সাধারণ মানুষ ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। তাই ছোট কিংবা বড় কোনো না কোনো গোনাহে মানুষ লিপ্ত হয়। গোনাহ করা অপরাধ; তবে গোনাহের পর তা মাফের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া না করা আরো মারাত্মক অপরাধ। তাই গোনাহ থাকুক বা না থাকুক, প্রয়োজন থাকুক বা না থাকুক, সর্বাবস্থায় আল্লাহর দিকে স্মরণাপন্ন হওয়া, প্রার্থনা করা একজন প্রকৃত মোমিনের কাজ। মানুষের যাবতীয় প্রয়োজন ছাড়াও সব সময় আল্লাহর কাছে দোয়া করা উচিত। কেননা, দোয়াকে ইবাদত বলা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘দোয়া ইবাদতের মগজ।’ (সুনানে তিরমিজি : ৩৩৭১)।
দোয়া শক্তিশালী আমল : দোয়ার শক্তি অনেক। এমনকি দোয়া তাকদির পর্যন্ত বদলে দিতে পারে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘দোয়া ছাড়া আর কিছুই আল্লাহর সিদ্ধান্তকে বদলাতে পারে না।’ (সুনানে তিরমিজি : ২১৩৯)। সুতরাং ইবাদত হিসেবেও সর্বদা দোয়া অব্যাহত রাখা চাই। তা না করে উদাসীনতার সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করা মোটেও প্রকৃত মোমিনের শান নয়। ইবাদতের মূল উদ্দেশ্য হলো, এর মাধ্যমে আল্লাহর কাছে বিনয় ও নম্রতা প্রকাশ করা। আর তা দোয়ার মাধ্যমেই হয়ে ওঠে।
আল্লাহর কাছে না চাইলে রাগ হন : দুনিয়ার নিয়ম হলো, কেউ কারো কাছে কিছু চাইলে, সে রাগ হয়। কখনও বিরক্তি প্রকাশ করে। আবার কখনও একাধিকবার গেলে তাড়িয়ে দেয়। কেউ বা আবার দিতে কার্পণ্য করে। কিন্তু আল্লাহর ব্যাপারে বিষয়টা নিতান্তই ভিন্ন। তাঁর কাছে না চাইলে তিনি রাগ হন। অসন্তুষ্ট হন। বান্দাকে দিতে কার্পণ্য করেন না। তাঁর ধন-ভান্ডারে কোনো কিছুর অভাব নেই। তবুও মানুষ চায় না। কেউ চাইলেও চাওয়ার মতো করে হয় না, বিধায় নিতে পারে না। মূলত আল্লাহ সর্বদা বান্দাকে দিতে প্রস্তুত। তবুও মানুষ প্রার্থনা না করে উদাসীনতায় মত্ত থাকে। হাদিসে এসেছে, ‘যে আল্লাহর কাছে চায় না, আল্লাহ তার ওপর অসন্তুষ্ট হন।’ (সুনানে তিরমিজি : ৩৩৭৩)।
যেসব দোয়া করবেন আল্লাহর কাছে : এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। বৈধ সব জিনিসই তাঁর কাছে চাওয়া যায়। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় প্রয়োজন ছোট-বড় সবকিছুই তাঁর কাছে চাওয়ার অনুমোদন রয়েছে। ব্যক্তি বিশেষ যার যেটা প্রয়োজন, সে তা চাইবে। এটাই স্বাভাবিক। কারো সুস্থতার প্রয়োজন, সে রবের কাছে সুস্থতার জন্য দোয়া করবে। কারও চাকরিবাকরি প্রয়োজন, কারও খাদ্যপানীয় প্রয়োজন। আবার কেউ পারিবারিক জীবনে অসুখী, সে তার সুখময় জীবনের জন্য দোয়া করবে। কেউ নিঃসন্তান, সে আল্লাহর কাছে নেক সন্তান চাইবে। মোটকথা, ছোট থেকে ছোট কিংবা বড় থেকে বড় সবকিছুই তাঁর কাছে চাওয়ার সুযোগ রয়েছে। হাদিসে এসেছে, ‘তোমাদের প্রত্যেকেই যেন যাবতীয় প্রয়োজনের জন্য তার রবের কাছে চায়। এমনকি জুতার ফিতা ছিড়ে গেলে তাও।’ (সুনানে তিরমিজি : ৬৩০৪)।
কোনো দোয়াই বিফলে যায় না : অনেকে বলে, এত দোয়া করি, তবু আল্লাহ কবুল করেন না। এটা নিছক বান্দার ভুল ধারণা। আসলে দোয়া কবুল হয়েছে কিনা, তা সে বোঝার সক্ষমতা রাখে না। আমরা তো প্রতিনিয়ত কত-শত ইবাদত করি। নামাজ, রোজা, দান-সদকা ইত্যাদি নিয়মিত করে থাকি। কিন্তু কেউ কি বলতে পারে যে, তার নামাজ কবুল হয়নি। নিশ্চিতভাবে কেউই এমন কথা বলার অধিকার রাখে না। দোয়া কবুল হয়; তবে আমরা তা বুঝতে সক্ষম নই। বান্দার কোনো দোয়াই বৃথা যায় না। হয়তো দোয়ার কার্যকারিতা তাৎক্ষণিক প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করা যায় না; তবে পরোক্ষভাবে তা কার্যকর হয়। হাদিসে এসেছে, ‘যদি কোনো মুসলমান আল্লাহর কাছে দোয়া করে, আর তাতে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন কিংবা গোনাহের কিছু না থাকে, তাহলে আল্লাহ তাকে তিনটি বিষয়ের যে কোনো একটি দান করবেন- এক. কাঙ্ক্ষিত বস্তুই তাকে দেবেন; দুই. উক্ত দোয়ার উসিলায় কাঙ্খিত বস্তুর সমপরিমাণ কোনো বিপদাপদ তার থেকে দূর করে দেবেন; তিন. এর প্রতিদান পরকালের জন্য প্রস্তুত রাখবেন।’ সাহাবায়ে কেরাম (রা.) বললেন, ‘তাহলে তো আমরা বেশি বেশি দোয়া করব।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘আল্লাহর দান আরো বেশি।’ (সুনানে তিরমিজি : ৩৫৭৩)।