মক্কা শরিফের জুমার খুতবা
সন্তানের প্রতি পিতামাতার কর্তব্য
শায়খ ড. মাহের আল মুআইকিলি
প্রকাশ : ২৪ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
নশ্বর এ পৃথিবীতে মানুষ কিছুকাল বেঁচে থাকে মাত্র। জীবন একদম সংকীর্ণ। পরকালের অধিবাসী হওয়া আবশ্যম্ভবী। কিছু মানুষের মৃত্যুর পর তার সব আমলনামা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। আবার কিছু মানুষের তার মৃত্যুর পর আমলনামা চালু থাকে এবং তার আমলের পাল্লা ভারী হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় আমিই মৃতদের জীবিত করব এবং তারা যা কিছু সামনে পাঠায়, তা লিখে রাখি। আর তাদের কর্মের যে ফলাফল হয়, তাও। এক সুস্পষ্ট কিতাবে প্রতিটি বিষয় সংরক্ষণ করে রেখেছি।’ (সুরা ইয়াসিন : ১২)।
যে সন্তান জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পর কল্যাণ বয়ে আনে : যেসব কারণে মৃত ব্যক্তির আমলনামা বাকি থাকে, তার অন্যতম হচ্ছে, তার নেককার সন্তান; যারা উভয়কালে তার জন্য উত্তম কল্যাণকর হয়। নবীজি (সা.) বলেন, ‘যখন কোনো মানুষ মারা যায়, তার সব আমলের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমলের দরজা তার জন্য খোলা থাকে। যথা- ১. সদকায়ে জারিয়া, ২. এমন ইলম, যা দিয়ে মানুষের উপকার সাধিত হয়, ৩. নেককার সন্তান, যে তার জন্য দোয়া করে।’ (মুসলিম : ৪৩১০)।
একজন নেককার সন্তান দুনিয়ার শোভা-সৌন্দর্য এবং দুনিয়ার সুখ ও সমৃদ্ধি। সন্তানকে ভালোবাসলে সে আপনাকে ভালোবাসবে, কোনো আদেশ করলে সে মান্য করবে, বৃদ্ধ বয়সে আপনাকে দ্বীন ও দুনিয়ার কাজে সহযোগিতা করবে, এমন সন্তান আপনার জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পর কল্যাণ বয়ে আনে। নবীজি (সা.) বলেন, আল্লাহতায়ালা নেককার বান্দাদের জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম প্রদান করলে বান্দা তার কারণ জিজ্ঞেস করবে। আল্লাহতায়ালা বলবেন, ‘সবই তোমার সন্তানের তোমার জন্য ইস্তেগফারের ফসল।’
সাত বছর বয়সে সন্তানদের উৎসাহ প্রদান : নেককার স্ত্রী গ্রহণের মাধ্যমে নেককার সন্তান কামনা শুরু করা চাই। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; রাসুল (সা.) বলেন, ‘নারীর চারটি জিনিস দেখে বিয়ে করা হয়। যথা- তার সম্পদ, উচ্চ বংশ, রূপ ও দ্বীন। তুমি দ্বীনদার নারী পেতে সচেষ্ট থাকো।’ (বোখারি : ৫০৯০)।
একজন সন্তান নেককার হতে হলে সর্বাগ্রে তার মাঝে একত্ববাদের বাণী, আল্লাহ প্রেম, আল্লাহর ভয় ও আশা প্রোথিত করে দিতে হবে। তাকে শিক্ষা দিতে হবে যে, নামাজ সব সফলতার মূলমন্ত্র। নামাজই হলো দ্বীনের খুঁটি, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যম। সুতরাং নামাজের প্রতি পিতামাতার সর্বাগ্রহ থাকতে হবে। সাত বছর বয়সে সন্তানদের উৎসাহ প্রদান করতে হবে। তাদের নামাজের বিধিবিধান শিক্ষা দিতে হবে। কারণ, নামাজের সম্পর্ক অন্তরের সঙ্গে। সুতরাং তারা যেন নামাজের প্রতি যত্নবান হয়।
পিতামাতা সৎ হলে সন্তানও সৎ হয় : পিতামাতা নেককার হলে সন্তান নেককার হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘ওই প্রাচীরটি ছিল নগরের দুই পিতৃহীন কিশোরের। এর নিম্নদেশে আছে এদের গুপ্তধন। এদের পিতা ছিল সৎকর্মপরায়ণ। সুতরাং আপনার প্রতিপালক দয়াপরবশ হয়ে ইচ্ছা করলেন যে, এরা বয়ঃপ্রাপ্ত হোক এবং এরা এদের ধন-ভান্ডার উদ্ধার করুক। আমি নিজ হতে কিছু করিনি; আপনি যে বিষয়ে ধৈর্য ধারণে অপারগ হয়েছিলেন, এটাই তার ব্যাখ্যা।’ (সুরা কাহফ : ৮২)। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, তাদের পিতামাতা নেককার হওয়ায় বাচ্চাদের সম্পদ আল্লাহতায়ালা রক্ষা করেছেন। সুতরাং পিতামাতা আদর্শবান হওয়ার বিকল্প নেই। বিশেষ করে, বাচ্চার শিশুকালের জন্য। কারণ, শিশুকালে শেখানো জিনিসের ওপর সবকিছুরই ভিত্তি। এর ওপর ভর করে তার চরিত্র ঠিক হয়। নবীজি (সা.) বাচ্চাদের সঙ্গে অত্যন্ত কোমল ব্যবহার করতেন। তাদের অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং তা বুঝতে দিতেন। আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, নবীজি (সা.) দিনের এক অংশে বেরুলেন। তিনি আমার সঙ্গে কথা বলেননি। আমিও তার সঙ্গে কথা বলিনি। অবশেষে তিনি বনু কায়নুকা বাজারে এলেন। (সেখান থেকে ফিরে এসে) ফাতেমা (রা.)-এর ঘরের আঙিনায় বসে পড়লেন। তারপর বললেন, ‘এখানে খোকা (হাসান রা.) আছে কি? এখানে খোকা আছে কি?’ ফাতেমা (রা.) তাকে কিছুক্ষণ দেরি করালেন। আমার ধারণা হলো, তিনি তাকে পুতির মালা (স্বর্ণ-রুপা ছাড়া, যা বাচ্চাদের পরানো হতো) পরাচ্ছিলেন। তারপর তিনি দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং চুমু খেলেন। তখন তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি তাকেও (হাসানকে) মহব্বত কর। আর তাকে যে ভালোবাসবে, তাকেও ভালোবেসো। এমনকি নামাজের সময় বাচ্চাদের খেলাধুলাও তিনি সহ্য করতেন। নবীজি (সা.) একবার নামাজের সময় হাসান অথবা হুসাইন (রা.)-কে কাঁধে নিয়ে বেরুলেন। নামাজে এক সেজদা অনেক লম্বা করলেন। নামাজ শেষে সাহাবিরা বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! আপনার সেজদা এত লম্বা করার ফলে আমরা আপনার ইন্তেকাল অথবা আজ অহি নাজিল হচ্ছে বলে ধারণা করেছিলাম।’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘এসব কিছুই নয়, বরং আমার নাতি আমার কাঁধে উঠেছিল। তাই তার প্রয়োজন পূর্ণ হওয়ার আগেই আমি তাকে নামাতে চাইনি।’ (মুসনাদে আহমদ)।
শিশুদের মতো আচরণ করা নবীজির নির্দেশ : বাচ্চাদের সঙ্গে তাদের মতো কথা বলা এবং তাদের খুশি করা নবীজি (সা.)-এর নির্দেশনার অংশ। আনাস ইবনে মালেক (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, নবীজি (সা.) আমাদের সঙ্গে কৌতুক করতেন। এমনকি একবার তিনি আমার ছোট ভাইকে (কৌতুক করে) বললেন, ‘হে আবু উমায়ের! কী হলো তোমার নুগায়েরের?’ ইমাম আবু ঈসা তিরমিজি (রহ.) বলেন, এ হাদিসে অনুধাবনযোগ্য বিষয় হলো, আনাস (রা.)-এর ছোট ভাইয়ের নুগায়ের নামে একটি পাখি ছিল। যা নিয়ে সে খেলা করত। একদিন পাখিটি মরে গেল। এতে সে ভীষণ ব্যথিত হলো। তখন নবীজি (সা.) তার সঙ্গে কৌতুক করলেন। বললেন, ‘হে আবু উমায়ের! কী হলো তোমার নুগায়েরের?’ (বোখারি : ৬১২৯)।
শিশুদের প্রতি অধিক দয়ালু ছিলেন যিনি : আনাস (রা.) বলেন, শিশুদের প্রতি নবীজি (সা.)-এর চেয়ে আর কাউকে এত বেশি দয়াবান পাইনি। আনসার সাহাবিদের সাক্ষাতে গেলে তিনি তাদের বাচ্চাদের সালাম দিতেন। তাদের মাথায় হাত বুলাতেন এবং রিজিক ও বরকতের দোয়া করতেন। বাচ্চাদের প্রতি দয়াবান হওয়া, তাদের সঙ্গে সত্য বলা তাদের নেককার হওয়ার মাধ্যম। আবদুল্লাহ ইবনে আমের (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, একবার আমার মা আমাকে ডাকলেন। নবীজি (সা.) তখন আমাদের বাড়ি ছিলেন। বললেন, ‘এদিকে এসো, আমি তোমাকে কিছু দেব।’ এ কথা শুনে নবীজি (সা.) বললেন, ‘তুমি তাকে কি দেবে?’ মা বলল, ‘খেজুর দেব।’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘তুমি যদি তাকে কিছু না দিতে, তাহলে মিথ্যাবাদী হতে।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪৯৯১)।
শিশুদের সঙ্গে ন্যায়বিচার তাদের নেককার হওয়ার উপায় : শিশুদের সঙ্গে ন্যায়বিচার করা তাদের ন্যায্য অধিকার এবং তাদের অন্তর নেক হওয়ার মাধ্যম। নবীজি (সা.) তাদের সঙ্গে ন্যায় বিচার করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন। নোমান ইবনে বশির (রা.) সূত্রে বর্ণিত; একবার আমার পিতা আমাকে নিয়ে নবীজি (সা.)-এর দরবারে গিয়ে বললেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি আমার এ সন্তানকে আমার সম্পদ থেকে এত এত দান করলাম। আপনি তার সাক্ষী থাকুন।’ নবীজি (সা.) বললেন, ‘তোমার প্রত্যেক সন্তানের জন্যই কি এ পরিমাণ দান করেছ?’ আব্বা বললেন, ‘না।’ এ কথা শুনে নবীজি (সা.) বললেন, ‘এভাবে হবে না; বরং ইনসাফ করো।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৩৭৫)। কতই না সুন্দর হবে, যদি আমরা আমাদের সন্তানদের কল্যাণের ও নেককার হওয়ার তরবিয়ত দিই। তাদের সফলতার পথে সর্বোচ্চ দয়া-সহনশীলতা ও রহম দিয়ে সহযোগিতা করি। তাই বাচ্চাদেরকে শিশুকাল থেকে একটু একটু করে শরয়ি বিধান, আদর্শ রীতিনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি শিক্ষা দেওয়া চাই। তাদের ভুল হলে সর্বোত্তম পন্থায় তা শুধরে দেওয়া চাই। নবীজি (সা.)-এর জীবনাদর্শে তাকালে বাচ্চাদের প্রতি নবীজি (সা.)-এর আদব শিক্ষার চেষ্টা ও তা শিক্ষা দেওয়ার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। ওমর ইবনে আবু সালামা (রা.) বলেন, আমি ছোটকালে নবীজি (সা.)-এর কাছে ছিলাম। আমার হাত পুরো দস্তরখানে ঘুরত। এটা দেখে নবীজি (সা.) বললেন, ‘হে বাছাধন! বিসমিল্লাহ বলে তোমার পাশের খাবার খাও।’ এরপর সর্বদা আমি সেভাবেই খাবার খেতাম।’ (বোখারি)।
সন্তানদের জন্য দোয়া করা : আল্লাহতায়ালার অনেক বড় একটি অনুগ্রহ হলো, তিনি আমাদের জন্য দোয়াকে সর্বোত্তম ইবাদত হিসেবে গণ্য করেছেন। তাই বান্দাকে দোয়া করার আদেশ দিয়েছেন। দোয়া কবুলের ওয়াদা করেছেন। (সুরা যুমার : ৬০)।
অতএব, সন্তানদের জন্য পিতামাতার দোয়া সন্তানদের নেককার ও সফল হওয়ার পেছনে অনেক বড় ভূমিকা রাখে। এমন দোয়া কখনও বিফলে যায় না। নবীজি (সা.) বলেন, ‘তিন ব্যক্তির দোয়া কবুল হওয়ার মাঝে কোনো সন্দেহ থাকে না- মজলুমের দোয়া, মুসাফিরের দোয়া, সন্তানের জন্য পিতামাতার দোয়া। সন্তানদের জন্য পিতামাতার দোয়া করা নবী-রাসুলদের আদর্শ ও সুন্নাহ। যেমন ইবরাহিম (আ.) আল্লাহতায়ালার কাছে দোয়া করেছেন।’ (সুরা সাফফাত : ১০১)। নেক সন্তান পাওয়ার পর এবং তাদের সুশিক্ষা প্রদানের পরও তিনি তার দোয়া চালু রেখেছেন। (সুরা ইবরাহিম : ৩৫-৪৬)। সন্তানদের প্রতি ইসমাঈল (আ.) ও ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়া অবিস্মরণীয়। তাদেরই একজন হলেন দোজাহানের সরদার মুহাম্মদ (সা.)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি ইবরাহিম (আ.)-এর দোয়ার ফসল।’ (মুসনাদে আহমদ)।
সন্তান-সন্ততির জন্য দোয়া করা নবীজির আদর্শ : সন্তান-সন্ততির জন্য দোয়া করা নবীজি (সা.)-এর আদর্শ ছিল। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, আমাকে নবীজি (সা.) জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি তাকে কিতাবের জ্ঞান দান কর।’
তাইতো আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এ উম্মাহর একজন আদর্শ সৈনিক হয়েছেন। কোরআনের মুখপাত্র হয়েছেন। আনাস (রা.)-এর মা নবীজি (সা.)-কে বললেন, ‘হে নবী! আপনার ছোট খাদেম আনাসের জন্য দোয়া করুন।’ নবীজি (সা.) তার জন্য সব কল্যাণের দোয়া করলেন। শেষের দিকে বললেন, ‘হে আল্লাহ! তার সম্পদ ও সন্তান বাড়িয়ে বরকত দিন।’ আনাস (রা.) বলেন, ‘আমি আনসার সাহাবিদের অন্যতম ধনী ব্যক্তি হয়ে গেলাম।’ তবে সন্তানদের জন্য বদ দোয়ার ব্যাপারে পিতামাতাকে সতর্ক থাকতে হবে। নবীজি (সা.) বলেন, ‘তোমরা নিজেদের জন্য এবং তোমাদের সন্তানদের জন্য বদ দোয়া করো না।’
মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন- মুহাম্মাদুল্লাহ ইয়াসিন