মানবজাতির প্রাকৃতিক ও সৃষ্টিগত স্বভাবজাতের ফলে তাকে কোনো জ্ঞান, ভোগ-বিলাস, বস্তুসামগ্রী পরিতৃপ্ত করতে পারে না। কেননা, এগুলোতে চিন্তা, ভয় ও সংশয় রয়েছে। এ কারণেই মানবজাতি প্রকৃত শান্তি, নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তার তীব্র প্রয়োজন অনুভব করে। সৃষ্টিকুলের মধ্যে একমাত্র মানবজাতি তার শুরু-শেষ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে। কীসে তার কল্যাণ ও অকল্যাণ, তা নিয়ে ভাবতে থাকে। এ সবই দ্বীনের সহজাত বাসনার ফল।
দ্বীন মানুষের স্বভাবজাত বিষয় : দ্বীনের মৌল তত্ত্ব মানুষের ভেতরে গ্রোথিত। কেননা, দ্বীন হলো মানুষের স্বভাবজাত বিষয়। এ কারণে দুনিয়ার বুকে কোনো মানবজাতিকে ধর্মহীন পাওয়া যাবে না; বরং মানবজাতির জন্য আহার, নিদ্রা থেকেও দ্বীনের প্রয়োজন অপরিসীম; যা তার সুখণ্ডশান্তি ও জীবন পরিচালনায় অত্যন্ত প্রয়োজন। কোনো জ্ঞানী ব্যক্তির দৃষ্টিতে এ জীবন শুধু আত্মীয়তার সম্পর্ক, মৃত্যুর পরে মাটি হয়ে যাওয়া নয়। কোনো এক নাস্তিক বলেছে, ‘মসজিদ-মন্দিরসহ সব ধর্মীয় উপাসনালয় এ কথা বলে যে, মানবজীবনের জন্য দ্বীন-ধর্মের অনেক প্রয়োজন রয়েছে।’ অন্য আরেক নাস্তিক বলেছে, ‘যুগে যুগে হয়তো প্রাচীরবিহীন দুর্গ পাওয়া যেতে পারে, হয়তো কোনো শহর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া পাওয়া যেতে পারে; কিন্তু কোনো যুগ ইবাদত ও উপসনালয়হীন পাওয়া যাবে না। দ্বীন হলো প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে গ্রোথিত স্বভাবজাত। যা প্রমাণে বড় কোনো দলিল-প্রমাণ অথবা আলোচনা বা টকশোর প্রয়োজন নেই। কেননা, তা স্পষ্ট বিষয়। মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই ইবাদত-উপাসনা এবং ধর্মবিশ্বাসে সৃষ্ট। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘প্রতিটি শিশু তার ধর্মচিন্তার স্বভাব নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়।’ (বোখারি)।
আল্লাহর দেওয়া দ্বীন সত্য : আল্লাহ যিনি দুর্বলকে শক্তি জোগান, নিরাশকে আশা জোগান; ভয়ের সময় সাহস প্রদান করেন; পেরেশানিতে নিশ্চয়তা ও নিশ্চিন্ততা প্রদান করেন, বিপদাপদে ধৈর্যধারণের তৌফিক দেন, তাঁর দ্বীন সত্য। কোনো মানুষ দ্বীন থেকে দূরে সরে গেলে, কখনও জীবনের স্বাদ পেতে পারে না। একমাত্র সঠিক দ্বীনই মানবজীবনের চরিত্র গঠন ও প্রশান্তি দিতে পারে। আল্লাহর প্রতি ঈমানের ক্ষেত্রে কিছু মানুষের পেরেশানি ও মাথা ব্যথা রয়েছে। যার কোনো দলিল-প্রমাণ তাদের কাছে নেই। বিশ্লেষকদের মতে, এসব পেরেশানি রোগ-ব্যাধি এবং অন্তরের কুমন্ত্রণা বৈ কিছুই নয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তুমি যদি তাদের সঠিক পথের দিকে ডাক, তবে তারা তা শুনবেও না। তুমি তাদের দেখবে, যেন তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রকৃতপক্ষে তারা কিছুই দেখে না।’ (সুরা আরাফ : ৯৭)।
নাস্তিকতার কারণ : নাস্তিকতা কোনো ঈমানদারি নয়, বরং ঈমানের শূন্যতা। সুতরাং নাস্তিক এ কারণে নাস্তিক হয়েছে যে, তার কাছে ঈমান আনয়নের দলিল পরিপূর্ণভাবে আসেনি; বরং সে পায়নি। সে এ কারণে নাস্তিক নয় যে, ঈমানকে অস্বীকার করার তার যথেষ্ট দলিল রয়েছে। সুতরাং নাস্তিকদের অন্তরে ঈমানের শূন্যতা রয়েছে। নাস্তিক ও সংশয়বাদীর কাছে সঠিক জ্ঞান নেই, সুস্থ বিবেক নেই। ফলে কোনো কোনো দার্শনিক বলেছেন, ‘বাস্তবিক নাস্তিক কোথাও বিদ্যমান নেই।’ নাস্তিকের অন্তর কখনও প্রফুল্ল হয় না। তার মন কখনও শান্তি পায় না। কেননা, সে স্বভাবজাত ও পৃথিবী বিষয়ে বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে। তার আকল তার সহজাত বিষয়ের সম্পূর্ণ বিপরীত। সে অকারণে দলিল খোঁজে। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেন, ‘অনেক আবশ্যিক জ্ঞানের সম্পর্ক হলো স্বভাবজাতের সঙ্গে; দলিলের সঙ্গে নয়। সুতরাং সেসব ক্ষেত্রে দলিল কামনা করলে, সে সন্দেহে পতিত হয়।’ মানুষের অন্তর দুর্বল। তার প্রবৃত্তি পথভ্রষ্টকারী। কামনা-বাসনা মানুষকে সন্দেহের দ্বারে সহজেই নিয়ে যায়। সুতরাং চাহিদা ও কামনা-বাসনা ও কুপ্রবৃত্তি মানুষকে সন্দেহে নিপতিত করে।
নাস্তিকতা অন্তর থেকেই সৃষ্টি হয় : নাস্তিকতা মূলত অন্তরের ভেতর থেকে সৃষ্টি হয়। সে কারণে তারা বলে, আমরা তো সন্দেহ দিয়ে শুরু করি; যাতে নিশ্চয়তায় পৌঁছাতে পারি। তাদের এ কথার উপমা হলো, আমরা বিষ পান করি; যাতে তার ওষুধ যাচাই করতে পারি। আল্লাহর অস্তিত্ব মানব বুদ্ধিতে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। যে ব্যক্তি তার স্বভাব ও জ্ঞান দিয়ে আল্লাহকে পেল না, তার আকল ও স্বভাব ত্রুটিযুক্ত হয়ে গেছে। আপনি দু’চোখে যা কিছু দেখেন, কানে যা শোনেন এবং অন্তরে যা অনুধাবন করেন, তা সবই আপনার রবের অস্তিত্বের প্রমাণ বহন করে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা কি কারও ছাড়া আপনা-আপনিই সৃষ্টি হয়ে গেছে নাকি তারাই (নিজেদের) স্রষ্টা?’ (সুরা তুর : ৩৫)। আল্লাহতায়ালার সম্পর্কে জানা একটি আবশ্যিক বিষয়। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই নবীরা তাদের উম্মতকে বলেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তাদের রাসুলগণ তাদের বলেছিল, আল্লাহ সম্বন্ধেই কি তোমাদের সন্দেহ; যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর স্রষ্টা? তিনি তোমাদের ডাকছেন তোমাদের খাতিরে তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করার এবং স্থিরীকৃত এক মেয়াদ পর্যন্ত তোমাদেরকে অবকাশ দেওয়ার জন্য। তারা বলেছিল, তোমরা তো আমাদেরই মতো মানুষ। তোমরা চাচ্ছ, আমাদের বাপ-দাদারা যাদের ইবাদত করত, তাদের থেকে আমাদের বিরত রাখতে! তাহলে তোমরা আমাদের কাছে সুস্পষ্ট কোনো মোজেজা উপস্থিত কর।’ (সুরা ইবরাহিম : ১০)। আসলে তাঁর দলিল কীভাবে পাব, যিনি সবার দলিল! সৃষ্টিতেই তাঁর একাত্মতার দলিল বিদ্যমান রয়েছে।
নাস্তিক তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করে : নাস্তিক আল্লাহকে ছেড়ে নিজ প্রবৃত্তির উপাসনা করে। আল্লাহর নাফরমানি করে। মানুষের আনুগত্য করে। শরিয়ত ছেড়ে ধারণার বশবর্তী হয়ে তার অনুসরণ করে এবং ধার্মিকদের দোষারোপ করে। সব কালে এবং সব যুগে ও জমানায় একমাত্র মূর্খতাই নাস্তিকদের সূত্রপাত ঘটায়। তাই সঠিক দ্বীন মানুষের মাঝে প্রোথিত থাকলে ভ্রষ্টতা দৌড়ে পালাবে। সত্যকে মেনে নেওয়া শক্তিশালী দলিলের ওপর ভিত্তি নয়। সত্যকে মানা নির্ভর করে বাস্তবিকভাবে তা অন্বেষণের ওপর। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তারা কি কারও ছাড়া আপনা-আপনিই সৃষ্টি হয়ে গেছে নাকি তারাই (নিজেদের) স্রষ্টা? নাকি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী তারা সৃষ্টি করেছে? না; বরং (মূল কথা হচ্ছে), তারা বিশ্বাসই রাখে না।’ (সুরা তুর : ৩৫-৩৮)।
নাস্তিকতা সুস্থ জ্ঞান ও বিবেক ছিনিয়ে নেয় : মানবজাতি আল্লাহর কাছে সবচেয়ে সম্মানিত ও শ্রেষ্ঠ। কেননা, আল্লাহতায়ালা তাদের সৃষ্টি করেছেন জ্ঞানী হিসেবে, বক্তা হিসেবে, শ্রোতা হিসেবে, দৃষ্টিবান ও প্রজ্ঞাবান হিসেবে। কিন্তু নাস্তিকতা মানুষকে এত উঁচু স্থান থেকে জানোয়ারের কাতারে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। নাস্তিকতা মানুষের সুস্থ জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধিকে ছিনিয়ে নিয়েছে। যা দিয়ে তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে, তা সবই তিনি নিজের পক্ষ থেকে তোমাদের কাজে লাগিয়ে রেখেছেন। নিশ্চয় এর মধ্যে বহু নিদর্শন আছে সেসব লোকের জন্য, যারা চিন্তা-ভাবনা করে।’ (সুরা জাসিয়া : ১৩)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘আমি তো আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছি এবং আমি তাদের স্থলে ও সমুদ্রে বাহন দিয়েছি। আর তাদের দিয়েছি উত্তম রিজিক। আমি যা সৃষ্টি করেছি, তাদের থেকে অনেকের ওপর আমি তাদের অনেক মর্যাদা দিয়েছি।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৭০)।
মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন - মুহাম্মাদুল্লাহ ইয়াসিন