আল্লাহতায়ালা আমাদের যে সব নেয়ামত দান করেছেন, তার মধ্যে সময় অন্যতম। এ নেয়ামতের গুরুত্ব অনেক বেশি। পৃথিবীর শুরু থেকেই রাব্বুল আলামিন চাঁদ-সূর্য, আকাশ-বাতাস, গ্রহ-নক্ষত্র সবকিছুকে একটি নির্দিষ্ট সময়ে পরিচালনা করে আসছেন। সূর্য প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে উদিত হয়, আবার নির্দিষ্ট সময়ে অস্ত যায়। যার দ্বারা সময়ের গুরুত্ব খুব সহজেই বোঝা যায়। এ ছাড়া শরিয়তের বিধিবিধানের প্রতি লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ইসলামের প্রতিটি ইবাদতের জন্য আল্লাহতায়ালা একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। হজ নির্দিষ্ট সময় পালন করার জন্য নির্ধারণ করেছেন, জাকাত নির্দিষ্ট পরিমাণ মাল হলে নির্দিষ্ট সময়ে আদায় করার জন্য নির্ধারণ করেছেন, ফরজ নামাজের জন্যও একটি নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় নামাজ মুসলমানদের ওপর নির্দিষ্ট সময়ে ফরজ।’ (সুরা নিসা : ১০৩)। এভাবে শরিয়তের অন্যান্য আহকামের মাঝেও সময়ের মালা গাঁথা রয়েছে।
আল কোরআনে সময়ের গুরুত্ব : আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের একাধিক জায়গায় দিনরাতের কসম করেছেন। রাতদিনের কসম করে বলেছেন, ‘শপথ রাতের, যখন তা আচ্ছন্ন করে। শপথ দিনের, যখন তা উদ্ভাসিত করে।’ (সুরা আল লাইল : ১-২)। এখানে রাতদিনের কসমে বান্দাদের কল্যাণের চিন্তা ও গবেষণার প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন। ফজর ও ১০ রাতের কসম করে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘শপথ ফজরের, শপথ ১০ রাতের।’ (সুরা ফজর : ১-২)। অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘শপথ সকাল ও পূর্বাহ্নের; শপথ রাতের, যখন তা গভীর হয়।’ (সুরা দোহা : ১-২)। সময়ের কসম করে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সময়ের শপথ, নিশ্চয় মানুষ ক্ষতির মাঝে নিমজ্জিত।’ (সুরা আসর : ১-২)। এসব আয়াত দ্বারা সময়ের প্রতি অপরিসীম গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
নবীজীবনে সময়ের মূল্যায়ন : রাসুল (সা.) কী পরিমাণ সময়ের মূল্য দিতেন, তা তার ইবাদত ও আমল থেকে বোঝা যায়। তিনি প্রতিদিন সকালে দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! আজ দিনের প্রথম অংশকে আমার জন্য উপকারী বানিয়ে দিন, তার মধ্যাংশকে সাফল্যমণ্ডিত করুন এবং শেষাংশকে শুভ করুন।’ অসংখ্য হাদিসে সময়ের মূল্য ও জীবনের গুরুত্ব প্রদানের তাগিদ রয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘পাঁচটি বিষয়কে পাঁচটি বিষয় আসার আগে গনিমত মনে করো; বার্ধক্যের আগে যৌবনকে, অসুস্থতার আগে সুস্থতাকে, দারিদ্র্যের আগে স্বচ্ছলতাকে, কর্মব্যস্ততার আগে অবকাশকে এবং মৃত্যুর আগে জীবনকে।’ (সুনানে বাইহাকি : ১০২৪৮)।
সময় মোমিনের অমূল্য সম্পদ : পার্থিব জীবনে মোমিনের মূল পুঁজি সামান্য কিছু সময়। সময় কল্যাণের পথে ব্যয় ও সময় থেকে উপকৃত হওয়ার চেষ্টাকারীর জন্য দুনিয়া ও পরকালে সুসংবাদ রয়েছে। সময়ের সঠিক ব্যবহারে শিথিলতা প্রদর্শন করা জীবনের মূল পুঁজি ধ্বংসের নামান্তর। সময়ের সঠিক ব্যবহার মোমিনকে জান্নাতের সুউচ্চ আসনে পৌঁছে দিতে পারে। অপরদিকে সময়ের অবহেলায় নিক্ষিপ্ত হতে পারে জাহান্নামে। তাইতো কোরআন ও হাদিসে সময়ের পরিচর্যায় স্ববিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তিনিই রাতদিন, সূর্য-চাঁদকে তোমাদের উপকারে নিয়োজিত করেছেন এবং তারকারাজিও তারই নির্দেশমতো কর্মে নিয়োজিত। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য বহু নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা ইবরাহিম : ৩৩-৩৪)।
সময় সোনার চেয়েও মূল্যবান : সময় সবকিছুর তুলনায় দামি। এ কারণেই জীবনের অন্তিম মুহূর্তে এসে মানুষ আফসোস করে, যদি আরেকটুখানি সময় দেওয়া হতো তাকে! আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনগণ! তোমাদের ঐশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদের আল্লাহর স্মরণে উদাসীন না করে। যারা উদাসীন হবে, তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমি তোমাদের যে রিজিক দিয়েছি, মৃত্যু আসার আগে তোমরা তা হতে ব্যয় করবে। অন্যথায় সে বলবে, হে আমার রব! আমাকে আরো কিছুকালের জন্য অবকাশ দিলে আমি সদকা করতাম এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।’ (সুরা মোনাফিকুন : ৯-১০)।
সময়ের মূল্য দেওয়া মুসলিম ঐতিহ্য : এপিজে আবদুল কালাম বলেছেন, ‘জীবন আর সময় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। জীবন শেখায় সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে। আর সময় শেখায় জীবনের মূল্য দিতে।’ সময় কখনও কারও জন্য অপেক্ষা করে না। সময় তার আপন গতিতে চলে। প্রতিটি কাজের নির্দিষ্ট একটা সময় থাকে। আর সেই সময় অনুযায়ী কাজটি না করলে সেই কাজটা গুরুত্ব হারাতে থাকে। আমরা অনেক সময় আজকের কাজ কালকের জন্য ফেলে রাখি। কিন্তু অবহেলায় কোনো কাজ ফেলে রাখা উচিত নয়। সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করার চেষ্টা করতে হবে। তবেই কাজে সফল হওয়া যাবে। তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সময়কে মূল্য দিতে হবে। যারা সময়ের গুরুত্ব দিয়েছেন, ইতিহাসে তারা আজ স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে আছেন। সময়কে কাজে লাগিয়ে তারা জীবনকে দিয়েছেন পূর্ণতা। কালের বাঁধন পেরিয়ে অর্জন করেছেন কালান্তরের অমরত্ব। সময়ের মূল্য দেওয়া মুসলমানদের ঐতিহ্য ও ধর্মীয় কর্তব্য। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যারা অনুসন্ধানপ্রিয় অথবা যারা কৃতজ্ঞতাপ্রিয়, তাদের জন্য তিনি পরিবর্তনশীলরূপে রাতদিন সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা ফোরকান : ৬৪)।
বড়দের সময়ের মূল্যায়ন : সময়কে মূল্যায়ন করে যারা বড় হয়েছেন, তাদের অন্যতম ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.)। তিনি মৃত্যুশয্যায় শায়িতকালেও একটি মাসআলা নিয়ে চিন্তারত ছিলেন। হজরত মারুফ কারখি (রহ.)-এর দরবারে একবার কিছু লোকজন এসে দীর্ঘক্ষণ বিলম্ব করল। বিরক্ত হয়ে তিনি বললেন, ‘সূর্য চালনাকারী ফেরেশতা কখনও ক্লান্ত হন না। অতএব, বল দেখি তোমরা কখন উঠবে?’ হাদিসশাস্ত্রের ইমাম বোখারি (রহ.) ধরাপৃষ্ঠে আগমন করে যখন চোখ খুললেন, তখন সর্বত্র ইসলামি জ্ঞানের চর্চা চলছিল। নবীজি (সা.)-এর যমানা মাত্র শেষ হলো। সাহাবায়ে কেরামের সংশ্রবে লালিত মহাপুরুষগণ তখনও জীবিত ছিলেন। জ্ঞানের পিপাসা নিয়ে সফরের লাঠি হাতে ধারণ করে রওনা হলেন তৎকালীন মুহাদ্দিসগণের কাছে বিভিন্ন শহরে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত হিসাব করে করে কাজে লাগিয়েছেন। কখনও কারও গিবত করেননি। তিনি বলেন, ‘স্মৃতিশক্তি বর্ধনের একমাত্র মাধ্যম হলো অটল, অবিচল ও একাগ্রতার সঙ্গে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করা।’ তিনি এক লাখ সহিহ হাদীস ও দুই লাখ গাইরে সহিহ হাদিস মুখস্থ করেছেন। এ ছাড়া হজরত দাউদ তাঈ (রহ.) রুটির পরিবর্তে ছাতু খেতেন। কারণ জিজ্ঞেস করা হলে বলতেন, ‘রুটির বদলে ছাতু খেলে ৫০টি আয়াত বেশি তেলাওয়াত করা যায়।’ বিখ্যাত আরবি ব্যাকরণবিদ খলিল ইবনে আহমদ (রহ.) বলতেন, ‘আমার কাছে সবচেয়ে অসহ্যকর লাগে খাওয়া-দাওয়ার সময়টুকু।’ (সাফহাতুম মিন সাবরিল উলামা)।
সময়ের সুফল অসময়ের কুফল : সময় নষ্ট করা একপ্রকার আত্মহত্যা। তবে পার্থক্য হলো, আত্মহত্যা মানুষকে চিরদিনের জন্য বঞ্চিত করে দেয়। আর সময়ের অপব্যবহার একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জীবিত ব্যক্তিকে মৃত বানিয়ে রাখে। যে মিনিট, ঘণ্টা ও দিনটি অনর্থক নষ্ট হয়ে যায়, যদি মানুষ তার হিসাব করত, তাহলে তার সমষ্টি হয়ে দাঁড়াত মাস, বছর ও যুগ। যদি কাউকে বলা হয়, তোমার জীবনের ৫ কিংবা ১০ বছর হ্রাস করা হলো, তাহলে নিশ্চিত সে ব্যাকুল ও মর্মাহত হবে। কিন্তু তার জীবনের একটি বিরাট অংশ যে অকারণে নষ্ট করছে, তার প্রতি সে একটুও ভ্রূক্ষেপ করছে না। মাত্র পাঁচ মিনিট দেরি হওয়ার কারণে নেপালিয়নের মতো অজেয় সেনাপতিকেও পরাজিত হতে হয়েছে। যথাসময়ে কর্তব্য আদায় না করায় ব্যর্থতার বোঝা বহন করতে হয়েছিল। সময়ের সদ্ব্যবহারে আসে সুফল। অসদ্ব্যবহারে মেলে হতভাগ্যের হাতছানি। কথায় আছে, সময়ের একফোঁড় অসময়ের দশফোঁড়। একবার রাসুল (সা.)-কে প্রশ্ন করা হলো, ‘সৌভাগ্যবান কারা?’ তিনি বললেন, ‘যারা দীর্ঘায়ু লাভ করে তা নেকআমলের মাধ্যমে অতিবাহিত করেছে।’ পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো, ‘দুর্ভাগা কারা?’ তিনি বললেন, ‘যারা দীর্ঘায়ু পেয়ে তা বদআমলে কাটিয়েছে বা আমলহীন অতিবাহিত করেছে।’ (তিরমিজি : ২৩২৯)।
পরকালে সময়ের হিসাব হবে : ঘড়ি টিক টিক করে অবিরাম গতিতে চলছে। আর বলছে, তোমরা তোমাদের কর্তব্য-কর্ম সম্পন্ন কর। উপকার তোমাদেরই হবে। তাই সময়ের কাছ থেকে আমাদের পাওনা কড়ায়-গণ্ডায় আদায় করে নিতে হবে। এক মুহূর্ত সময়ও যেন বৃথা ক্ষয় না হয়, সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। কবিগুরু বলেছেন, ‘কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন-যৌবন, ধন-মান। কিন্তু যা ভেসে যায় না, তা হলো কীর্তি।’ যেসব স্বনামধন্য পুরুষের কীর্তি ও প্রতিভা দেখে আমরা মুগ্ধ ও অবিভূত, তাদের কীর্তি প্রতিষ্ঠার মূলে আছে সময়ানুবর্তিতা। সময়ানুবর্তিতাই জীবনে সাফল্য লাভের চাবিকাঠি। সময় ও জীবন আল্লাহর অমূল্য দান। সময়ের ইতিবাচক ব্যবহারই জীবনের সফলতা। সময়ের অপচয় ও অপব্যবহার জীবনের ব্যর্থতা। সময়ের যথাযথ ব্যবহার না করা বা অপব্যবহার করার জন্য জবাবদিহি করতে হবে আল্লাহর দরবারে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘শেষ বিচারের দিনে প্রতিটি মানুষ পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ছাড়া এক কদমও নড়তে পারবে না। তা হলো, তার জীবনকাল কী লক্ষ্যে কাটিয়েছে? যৌবনকাল কী কাজে ব্যয় করেছে? কোন পথে আয় করেছে? কী কাজে ব্যয় করেছে? জ্ঞান অনুযায়ী কর্মসম্পাদন করেছে কিনা?’ (তিরমিজি : ২৪১৬)।
সময়ের কারণে অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত : সময় ও নদীর স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না। বাক্যটি ক্ষুদ্র হলেও ব্যাপক অর্থবোধক। এটি একটি বাস্তব সত্য। মানুষ এতে খুঁজে পায় তার জীবনের মূল্য। এ বাক্যটি মানব জীবনে শুধু আগ্রহ-উদ্দীপনা ও প্রেরণা জাগায়, শুধু তা-ই নয়; বরং এটি একজন মানুষকে দান করে নতুন জীবন। সময়ই তার জীবন। এর সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ জান্নাতের সুউচ্চ আসনে পৌঁছাতে পারে। অপরদিকে এর প্রতি অবহেলা করে সে নিক্ষিপ্ত হয় জাহান্নামের অতল দেশে। আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাদের জন্য অসংখ্য নেয়ামত রেখেছেন। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ সেই নেয়ামতগুলোর অকৃতজ্ঞতায় মত্ত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আল্লাহপ্রদত্ত নেয়ামতগুলোর অপব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সময়ের শপথ! মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত; কিন্তু তারা নয়, যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের ও ধৈর্যের উপদেশ দেয়।’ (সুরা আসর : ১-৩)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘দুটি নেয়ামত এমন রয়েছে, যে বিষয়ে মানুষ ধোঁকায় থাকে। তা হচ্ছে, সুস্থতা ও অবসর।’ (বোখারি : ৬৪১২)।
উদাসীনতা বা সময়ের প্রতি অবহেলা : সময়ের এত গুরুত্ব হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই এ ব্যাপারে উদাসীন। অথচ আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদের মোহাচ্ছন্ন করে রাখে, যতক্ষণ না তোমরা সমাধিগুলো দেখতে পাও (তোমাদের মৃত্যু হয়)।
এটি কখনও সঙ্গত নয়; অচিরেই তোমরা জানতে পারবে। আবারও বলি, এটি মোটেই সমীচীন নয়; তা তোমরা অনতিবিলম্বে জানতে পারবে। না, তোমাদের নিশ্চিত জ্ঞান থাকলে অবশ্যই তোমরা মোহগ্রস্ত হতে না। তোমরা (সময়ের প্রতি উদাসীন ও কর্মে অবহেলাকারীরা) অবশ্যই জাহান্নাম দেখবে (তাতে প্রবেশ করবে)। অবশ্যই তোমরা জাহান্নাম চাক্ষুস দেখে (তাতে প্রবেশ করে তার শাস্তি ভোগ করে) প্রত্যয় লাভ করবে। অতঃপর অবশ্যই সেদিন তোমাদের প্রদত্ত সব নেয়ামত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে।’ (সুরা তাকাসুর : ১-৮)।
সোশ্যাল মাধ্যমে সময় ব্যয় : আজকাল অনেকে অবসর সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় পার করে। তারা সারাক্ষণ বিভিন্ন মিউজিক চ্যানেল কিংবা মুভি দেখে সময় কাটাতে ভালোবাসে। এতে আল্লাহপ্রদত্ত নেয়ামতের অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। অন্যদিকে নিজের সময় নষ্ট ও শারীরিক ক্ষতি হয়।
সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো, এটি মানুষের ধ্বংসের কারণও। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমার উম্মতের কিছু লোক মদের নাম পরিবর্তন করে তা পান করবে। আর তাদের মাথার ওপর বাদ্যযন্ত্র ও গায়িকা নারীদের গান বাজতে থাকবে। আল্লাহতায়ালা তাদের জমিনে ধসিয়ে দেবেন এবং তাদের কিছু লোককে বানর ও শূকরে রূপান্তরিত করবেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৪০২০)।
গিবত ও পরনিন্দায় সময় কাটানো : গিবত বা পরনিন্দা ইসলামি শরিয়তে সম্পূর্ণরূপে হারাম ও নিষিদ্ধ। গিবত করা ও গিবত শোনা সমান অপরাধ। অনেকেই পরনিন্দাকে পাপ বা নিষিদ্ধ বলে মনেই করেন না। মদ্যপান, চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার ইত্যাদি থেকেও মারাত্মক ও নিকৃষ্টতম পাপ ও কবিরা গোনাহ হলো গিবত। অন্যান্য পাপ তওবা দ্বারা মাফ হয়; গিবতকারীর পাপ শুধু তওবা দ্বারা মাফ হয় না। যার গিবত করা হয়েছে, সে ব্যক্তি যদি মাফ করে, তবেই আল্লাহর কাছে মাফ পাওয়া যেতে পারে। আর একটি কবিরা গোনাহ কাউকে জাহান্নামে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট। অনেকে অবসরে পরনিন্দায় লিপ্ত হয়। দুঃখের বিষয় হলো, আজকাল মসজিদের মতো পবিত্র জায়গায় বসেও মানুষ অন্যের গিবতে ডুবে থাকে। যা জঘন্য অপরাধ। অথচ গিবত ও অপরের দোষচর্চা নিকৃষ্টতম অভ্যাস। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘পেছনে ও সামনে প্রত্যেক পরনিন্দাকারীর জন্য দুর্ভোগ-ধ্বংস।’ (সুরা হুমাজা : ১)।
অবসরে স্মার্টফোনে ডুব : বর্তমানে স্মার্টফোন অনেকের অবসরের সঙ্গী। মনের অজান্তেই তারা কিছুক্ষণ পরপর স্মার্টফোন চেক করে। এ আকর্ষণের আগুনকে আরও প্রজ্বলিত করে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাপ্স। স্মার্টফোনে হারাম কিছু না দেখলেও এর দ্বারা প্রচুর সময় নষ্ট হয়। অথচ কেয়ামতের দিন মানুষকে প্রতিটি মুহূর্তের হিসাব দিতে হবে। অনেকের আবার অবসর কাটে দোকানে চায়ের আড্ডায়, গল্পগুজব আর অনর্থক ক্রিয়াকর্মে। অথচ মুসলমানদের জীবনের সফলতার ভিত্তি যে কয়টি বিষয়ের ওপর, তার একটি অনর্থক ক্রিয়াকর্ম থেকে বেঁচে থাকা। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় মোমিনরা সফলকাম। যারা খুশু-খুজুর সঙ্গে নামাজ আদায় করে এবং অনর্থক ক্রিয়াকর্ম থেকে বিরত থাকে।’ (সুরা মোমিনুন : ১-৩)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘মানুষ যখন অনর্থক বিষয়াদি ত্যাগ করে, তখন তার ইসলাম সৌন্দর্যমণ্ডিত হবে।’ (মুয়াত্তায়ে মালেক : ৯৪৮)।
সময় সচেতন হওয়া জরুরি : আনমনে-অবহেলায় আমাদের সময় বয়ে যায়। আমরা সময়ের মূল্য দিই না, সময়ের মূল্য বুঝি না। কিন্তু ইসলামের সব কর্মপদ্ধতিতে সময়ের মূল্য অপরিসীম। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আল্লাহ মানুষকে তাদের কৃতকর্মের জন্য শাস্তি দিলে পৃথিবীর কোনো জীব-জন্তুকেই রেহাই দিতেন না; কিন্তু তিনি এক নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত তাদের অবকাশ দিয়ে থাকেন। তারপর তাদের সময় পূর্ণ হলে তারা জানতে পারবে। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি সম্যক দ্রষ্টা।’ (সুরা ফাতির : ৪৫)। জীবন চলার বাঁকে বাঁকে সুখ-দুঃখের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ মানুষ ব্যাধি ও জরাগ্রস্ত হয়ে মৃত্যুর পথে এগিয়ে যাচ্ছে। কাজেই সময় থাকতে এখনই সময় সচেতন হতে হবে। সময়কে হেলায়-ফেলায় কাটিয়ে দিলে পরজগতে আক্ষেপের সীমা থাকবে না। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সেখানে তারা (অপরাধীরা) চিৎকার করে বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের আবার দুনিয়ায় প্রেরণ করুন। আগে যা করেছি, তা আর করব না। তখন আল্লাহতায়ালা বলবেন, আমি কি তোমাদের এতটা সময় দিইনি, যাতে উপদেশ গ্রহণ করতে পারতে? উপরন্তু তোমাদের কাছে সতর্ককারীরাও আগমন করেছিল। অতএব, আজাব আস্বাদন কর। জালেমদের কোনো সাহায্যকারী নেই।’ (সুরা ফাতির : ৩৭)।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট