থার্টিফার্স্ট নাইট : ইসলাম কী বলে
মিনহাজুল আরিফীন
প্রকাশ : ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
দিন যতই গড়াচ্ছে, পশ্চিমা সভ্যতা-সংস্কৃতির ভয়াল থাবায় ততই আক্রান্ত হচ্ছে মুসলিম বিশ্ব। ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ঘেরা টোপে পা দিয়ে একে একে খুইয়ে ফেলছে ঈমান-আমলের মতো মহাগুরুত্বপূর্ণ মূল্যবান সম্পদ। ভুলতে বসেছে নিজেদের স্বকীয়তা, স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য। হারিয়ে যাচ্ছে হাজার বছরের বীরত্বগাথা ইসলামি ইতিহাস-ঐতিহ্য। মুসলমানদেরও যে একটি সুপ্রতিষ্ঠিত সভ্যতা আছে, আছে সুন্দর-সুগঠিত একটি সংস্কৃতি, তা যেন আজ মুসলিম সমাজে বিস্মৃতপ্রায়।
থার্টিফার্স্ট নাইট ইসলাম সমর্থিত নয় : ইতিহাস বলে, থার্টিফার্স্ট নাইট বা নওরোজ পালন ইসলাম কখনো সমর্থন করেনি। মুসলমানদের সংস্কৃতিতে নওরোজ কখনোই গৃহীত হয়নি। ফার্সি নববর্ষের দিন, আরবি গ্রন্থগুলোতে প্রায় নওরোজরূপে উল্লিখিত। (কালকাশান্দি, সুবহুল আশা, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৪০৮)। পারস্যের সৌরসালের এ ছিল প্রথম দিন এবং মুসলিম চন্দ্রসহ হিজরিতে এটি গৃহীত হয়নি। (ইসলামি বিশ্বকোষ : খণ্ড ১৩, পৃষ্ঠা ৬০৯)। এ ঐতিহাসিক পর্যালোচনা থেকে জানা গেল, নওরোজ বা নববর্ষ উৎসব পালন মূলত পারসিক অগ্নি উপাসকদের দ্বারা এবং পরবর্তীতে এর বিস্তার হয় ইরানের শিয়াদের মাধ্যমে। তারপর দ্বীনে এলাহি প্রবর্তক কাফের বাদশাহ আকবর এটা রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের ফরমান জারি করে। এ দিন উৎসবের নামে তাদের বিভিন্ন অসামাজিক কার্যক্রম, মদ পান, জুয়া ইত্যাদি অনৈসলামি কার্যকলাপ হয়ে থাকত। শুধু তা-ই নয়, এটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষ একটি অনুষ্ঠান; যা ইসলামে সম্পূর্ণ নাজায়েজ। লাখো আলেম-ওলামা এ উপমহাদেশে আগমন করেছেন। কখনো কারও দ্বারা এ আমল করতে দেখা যায়নি। ১৫০০ বছর মুসলিম ইতিহাসে নববর্ষ পালনের কোনো প্রমাণ নেই। তাই এটা সুস্পষ্ট বিদআত, বিধর্মীদের রীতি অনুসরণ এবং ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ হওয়ায় নাজায়েজ ও হারাম।
হাদিসে অবৈধতার ঘোষণা : নওরোজ বা বছরের প্রথম দিন পালন যে ইসলামে নিষিদ্ধ, তার স্পষ্ট দলিল এবং মুসলিম ও অমুসলিমদের উৎসবের পার্থক্য হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, নবীজি (সা.) মদিনায় আগমন করলেন। তখন তাদের দুটি দিন ছিল। যে সময় তারা খেলাধুলা করত। তিনি বললেন, ‘এ দুটি দিন কী?’ তারা বলল, ‘আমরা এতে জাহেলি যুগে খেলাধুলা করতাম।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহতায়ালা-এর পরিবর্তে এর চেয়ে উত্তম দুটি দিন দিয়েছেন। তা হলো- ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর।’ (সুনানে আবি দাউদ : ১১৩৪)। ওই দুটি দিন ছিল ‘নওরোজ’ বা নববর্ষ। অর্থাৎ সৌরবর্ষের প্রথম দিন এবং ‘মেহেরজান’। বছরে এ দিন রাতদিন সমান হয়। আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, ‘যে অনারব দেশ বিচরণ করে, অতঃপর তাদের নওরোজ ও মেহেরজান উদযাপন করে, তাদের সঙ্গে তাকে উঠানো হবে।’ (সুনানে বাইহাকি : ২/৩২৫)।
অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা : এ রাতকে কেন্দ্র করে চলে অশালীন ও বেহায়াপনার মহোৎসব। যুবতীরা আঁটসাঁট, অশালীন ও অর্ধনগ্ন পোশাক পরিধান করে অবাধে চলাফেরা করে। বিভিন্ন আবাসিক হোটেল, সমুদ্র সৈকত, নাইট ক্লাবে যুবক-যুবতীরা অবাধে মেলামেশা ও অপকর্মে লিপ্ত হয়। যা ইসলামের পরিভাষায় ব্যভিচার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এখন কেউ যদি বলে, আমরা খারাপ কিছু করব না, শুধু উৎসব উদযাপন করব, তাহলে বুঝতে হবে- এরাই ধোঁকাবাজ। এরা হয়তো সমাজকে ধোঁকা দিচ্ছে, নয়তো তারা নিজেরাই ধোঁকায় পড়ে আছে। কেননা, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কোনো পুরুষ কোনো নারীর সঙ্গে নির্জনে একত্রিত হলে তাদের তৃতীয়জন হয় শয়তান।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ : ১৩১৮)। ২০০০ সালের ৩১ ডিসেম্বরে ২৫ মিনিটে গুলশানে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপনকারী এক তরুণীকে কিছু মাতাল যুবক শ্লীলতাহানি করে। তার শরীরের বেশিরভাগ কাপড় ছিঁড়ে ফেলে। ২০০১ সালে শাওন আক্তার বাঁধনের ক্ষত-বিক্ষত দেহ, কে না দেখেছেন? আরো কত বাঁধনের সম্ভ্রমহানি হয়েছে, এর হিসেব কি ক্যালকুলেটরে ধরবে? এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, থার্টিফার্স্ট নাইট একটি যৌন উৎসব। যা তাদের জন্য অসম্মানজনক। অথচ, আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা জিনার নিকটবর্তী হয়ো না।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৩২)। তিনি আরো বলেন, ‘(হে নবী!) আপনি (মোমিনদের) বলে দিন, আমার পালনকর্তা সব ধরনের অশ্লীল বিষয়গুলো হারাম করেছেন।’ (সুরা আরাফ : ৩৩)। এ প্রসঙ্গে নবীজি (সা.) বলেন, ‘ওইসব নারী যারা হবে পোশাক পরিহিতা, কিন্তু প্রায় নগ্ন। যারা পরপুরুষকে আকৃষ্ট করবে এবং নিজেরাও আকৃষ্ট হবে। তাদের মাথা বক্র উঁচু কাঁধবিশিষ্ট উটের মতো। তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এমনকি জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না।’ (মুসলিম : ২১২৮)।
বিজাতীয় সাদৃশ্য : থার্টিফার্স্ট নাইট উদযাপন সম্পূর্ণরূপে বিজাতীয় সংস্কৃতি। এ রাতে বলে ও ম্যাসেজের মাধ্যমে অভিবাদন জানানো, আতশবাজি, পটকাবাজি, ফ্যাশন শো, ফায়ার প্লে, ট্যাঁটো বা উল্কা অংকন, ডিজে পার্টি ও কনসার্ট, নেশা সেবনসহ বিজাতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সাদৃশ্য রাখে। ইসলাম এটি কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য অবলম্বন করল, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৩৫১২)।
গান-বাজনা হারাম : এ রাতে আয়োজিত হয় বিভিন্ন কনসার্ট। যেখানে নারী-পুরুষের একসঙ্গে গান-বাজনা, নগ্ন নৃত্য আবশ্যকীয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ আল্লাহতায়ালা ও রাসুল (সা.) এসব নিন্দনীয় কাজকে সম্পূর্ণ হারাম ও অবৈধ বলে ঘোষণা করেছেন। আর যারা এসব কাজে লিপ্ত, তাদের জন্য করেছেন কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘একশ্রেণির লোক আছে, যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে গোমরাহ করার উদ্দেশ্যে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং তাকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে। এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।’ (সুরা লোকমান : ৬)।
জনসাধারণকে কষ্ট দেওয়া : এ রাতে আনন্দ-উল্লাস উপভোগ করার জন্য মধ্যরাত থেকে শুরু হয় আতশবাজি ও পটকাবাজি। যা জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক ও ভীতি সৃষ্টি করে। এর দ্বারা অগ্নিসংযোগেরও আশঙ্কা রয়েছে। তা ছাড়া এসব কর্মকাণ্ডে জনসাধারণকে নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হয়। অথচ আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘যারা বিনা অপরাধে মোমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।’ (সুরা আহজাব : ৫৮)।
অর্থ অপচয়ের সুযোগ নেই : এ রাতকে কেন্দ্র করে অনেক অর্থ অনৈসলামি ও হারাম কাজে ব্যয় করা হয়। যা একদিকে যেমন মারাত্মক গোনাহের কাজ, অপরদিকে অপচয়। আর ইসলাম অপচয়কারীকে শয়তানের ভাই হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এ ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় অপচয়কারী শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার রবের বড়ই অকৃতজ্ঞ।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৭)।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট