ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিকৃত চিন্তার ছদ্মবেশী মতবাদ

এনায়েতুল্লাহ ফাহাদ
বিকৃত চিন্তার ছদ্মবেশী মতবাদ

ট্রান্সজেন্ডারবাদ একটি বিদ্ঘুটে মতবাদ। অদ্ভুত এক শ্রেণির মানুষ এ মতবাদে বিশ্বাসী। বাংলায় যাদের আমরা রূপান্তরকামী বলতে পারি। অনেকেই আবার এ চিন্তাকে ‘জেন্ডার আইডেন্টিটি’ বা লিঙ্গ পরিচয় মতবাদও বলে থাকেন। এ মতবাদের বক্তব্য হলো, একজন পুরুষ যদি ‘নিজেকে নারী বলে মনে করে’, তাহলে সে একজন নারী। সমাজ ও আইন নারী হিসেবেই তাকে বিবেচনা করবে। সেই পুরুষ শারীরিকভাবে পুরোপুরি স্বাভাবিক হোক, তিন বাচ্চার বাবা হোক অথবা অল্প বয়সের বাচ্চা-বালক হোক, কিছু আসে যায় না তাতে। পক্ষান্তরে একজন নারী নিজেকে যদি পুরুষ মনে করে, তাহলে সে পুরুষ। সমাজ ও আইন পুরুষ হিসেবেই তাকে বিবেচনা করবে। যদিও তার মাসিক হয়, সে গর্ভবতী হয়, সন্তানের জন্ম দেয় অথবা অল্প বয়সের বালিকাও হয়। এগুলো এ মতাবলম্বী মানুষের কাছে আপত্তির কিছু নেই। জন্মগত দেহ যা-ই হোক, যে নিজেকে যেমন মনে করবে, সে সেটাই হবে। খুব সহজে হতে পারে নারী দাবি করে পুরুষ আর পুরুষ দাবি করে নারী। এখানে মোটাদাগের একটা কথা মানুষের মনটাই গুরুত্বপূর্ণ; দেহ নয়।

নিজেকে বিপরীত লিঙ্গের বলে দাবি : এ মতবাদে বিশ্বাসীরা চাহিবামাত্র হরমোন ট্রিটমেন্ট আর বিভিন্ন অপারেশনের মাধ্যমে কাটাকুটি করে নিজের শরীরকে বদলে নিতে পারবে। ইচ্ছেমতো ওষুধ আর অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বদলে নিলে মনের পাশাপাশি শারীরিক পরিবর্তন দেখা যাবে। তারা এ সুযোগ রেখেছে, কেউ যদি অস্ত্রোপচার না করেই নিজেকে বিপরীত লিঙ্গের বলে দাবি করে, তাতেও কোনো সমস্যা নেই। আবার এ কথাও বলে, একজন শিশু জন্মানোর পর তাকে যে ছেলে বা মেয়ে বলা হয়, তা পুরোটাই হয় অনুমানের ভিত্তিতে। ডাক্তাররা আন্দাজ করে ছেলে বা মেয়ে পরিচয় বাতলে দেয়। কিন্তু পরে একজন শিশু জন্মকালে নির্ধারিত পরিচয়ের বদলে অন্য কোনো পরিচয় বেছে নিতে পারে। জন্মের পরপর যাকে ছেলে ধরে নেওয়া হয়েছিল, সে একসময় গিয়ে নিজেকে মেয়ে বলতে পারে। শরীর যেমনই হোক না কেন, তাকে তখন মেয়েই ধরে নিতে হবে। এ আলোচনার প্রেক্ষিতে মোটাদাগে এ কথা বলা হয়, কিছু মানুষ ভুল দেহে জন্ম নেয়।

সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর মুখোশ : আবার তারা সাধু সেজে এ কথাও উচ্চারণ করে, যতক্ষণ না অন্যের কোনো ক্ষতি হচ্ছে, ততক্ষণ যা খুশি তা-ই করা যায়। তাদের কথামতে, যারা ট্রান্সজেন্ডারবাদ মানবে না, তারা সেকেলে ও পশ্চাৎপদ! অধিকার নিশ্চিত করতে তারা এটাও বলে, আমাদের অবস্থান দিতে হবে আইনি ও সামাজিকভাবে। মানুষ ইচ্ছেমতো পোশাক পরবে, আমাদের সব কাজ মেনে নিতে হবে মুখ বুজে। রাষ্ট্র ও সমাজ কোনো বাধা দিতে পারবে না; বরং ‘সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী’ হিসেবে এ ধরনের মানুষকে দিতে হবে বিশেষ সুবিধা। এমনকি এ আদর্শকে উপস্থাপন করা হচ্ছে নাগরিক ও মানবাধিকারের প্রশ্ন হিসেবে।

নেপথ্যে যাদের ভূমিকা : আজ মানবাধিকারের নামে পশ্চিমাবিশ্ব ও জাতিসংঘ বিশ্বজুড়ে ট্রান্সজেন্ডারবাদ ফেরি করে বেড়াচ্ছে। বিলিয়ে দেয় বিপুল অর্থ। এতে অভাব নেই তাদের। এদের মূল উৎস ও অগ্রণী ভূমিকায় যারা রয়েছে, তারা এনজিও সংশ্লিষ্ট ও অ্যাক্টিভিস্ট। তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে দূরদূরান্তে নয়, বরং নিজ শহর বাংলাদেশেরও কিছু এনজিও প্রতিষ্ঠান কাজ করে যাচ্ছে। উল্লেখযোগ্য আরকাস ফাউন্ডেশন। যা সম্পূর্ণরূপে এনজিওদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত। এদের পেছনের শক্তি ‘সমকামিতা আন্দোলন’ ও ‘নারীবাদ আন্দোলন’। এদের মূল উদ্দেশ্য হলো, সমকামিতার মতো ঘৃণিত কাজ সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া। মানুষদের জাহান্নামে ঠেলে দেওয়া।

ট্রান্সজেন্ডার মতবাদের ছড়াছড়ির তৎপরতা : এদের উত্থান বেশিদিন নয়। অথচ খুব দ্রুতই এ নতুন শক্তি পশ্চিমা বিশ্বের ওপর রাজত্ব কায়েম করেছে। যা বর্তমানে এ মতবাদ শেখানো হচ্ছে পশ্চিমের স্কুলগুলোতে। প্রবল আগ্রহে এ মতবাদকে তারা গ্রহণ করে নিয়েছে। শেখানো হচ্ছে পশ্চিমার চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। এমনকি এ মতবাদ প্রচার করে চলছে মধ্যপন্থী থেকে শুরু করে বামপন্থী, সব রাজনৈতিক দল ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানও। আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধানের এক্সিকিউটিভ নির্দেশ, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় আইন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক পলিসিও ঠিক হচ্ছে নতুন এ মতবাদের আলোকে। এ মতবাদের ওপর ভিত্তি করে আইন তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন পশ্চিমা ঘনিষ্ঠ বন্ধু দেশে। বেশি দূরে নয়, এর প্রভাব বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ থেকে উচ্চ আদালতেও পৌঁছে গেছে। যেমন- পাঠ্যপুস্তক থেকে আরও প্রমাণ দেখানো যায়, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন বইয়ে (একান্ন থেকে ছাপ্পান্ন) পৃষ্ঠায় শরিফার গল্প শিরোনামের লেখায় সরাসরি ট্রান্সজেন্ডারবাদের দীক্ষা দেওয়া হয়েছে।

সুবিধাভোগের জন্য ছদ্মবেশী : সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার সার্কুলার হয়েছে। ট্রান্সজেন্ডার ‘প্রান্তিক’ জনগোষ্ঠীর নাম দিয়ে তাদের জন্য আলাদা কোটা তৈরি করা হয়েছে। কী ভয়ংকর ব্যাপার! একদিকে তাদের বরাদ্দ কোটা নতুনভাবে তৈরি করা হয়নি, বরং সাধারণ কোটা কমিয়ে তাদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যা দ্বারা সাধারণ জনগোষ্ঠীর মাঝে সংকট তৈরি করা হচ্ছে। অন্যদিকে ট্রান্সজেন্ডারদের কোটা আলাদা থাকলেও তাদের সিট আলাদা নয়। একজন ট্রান্সজেন্ডার যখন নারী পরিচয়ে মহিলা হোস্টেলে সিট নেবে, তখন তার কাছে আপনার মেয়ে ও বোনেরা কতটুকু নিরাপদ! কারণ, সে মনে মনে নারী হলেও আসলে সুবিধাবাদী পুরুষ।

ট্রান্সজেন্ডারবাদ বিশ্বাসে আলোচনায় যারা : অনেকেই এটাকে সহজে উড়িয়ে দিচ্ছে অবিশ্বাস্য মতবাদ বলে। তবু এরই মধ্যে যে নজির তৈরি হয়েছে, তার কয়েকটি তুলে ধরছি- ১. রিচার্ড লাভিন। অ্যামেরিকার পেন স্টেইট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিশু রোগ ও মানসিক রোগের প্রফেসর। কিন্তু ২০১১ সালে দুই বাচ্চার বাবা। ৫৪ বছর বয়সী এ রিচার্ড ঘোষণা করে, সে আসলে একজন নারী। নতুন নাম নেয় র‍্যাইচেল। ২. জেইমস প্রিটযকার। শ্রেষ্ঠ একজন ধনী। দু’বার বিয়ে করা জেইমস প্রিটযকার এক মেয়ে আর দুই ছেলের বাবা। ২০১৩ সালে ৬৩ বছর বয়সে এ বয়োঃবৃদ্ধ নিজেকে নারী ঘোষণা করে। তার নতুন নাম জেনিফার। ৩. ব্রুস জেনার। সে বিশ্ব রেকর্ড করা অলিম্পিক গোল্ড মেডালিস্ট। তিন বিয়ে থেকে মোট ছয় সন্তানের বাবা। ২০১৫ সালে নিজেকে নারী ঘোষণা করে। তার নতুন নাম ক্যাইটলিন। এবার দেখি বাংলাদেশ থেকে উদাহরণ; শারমিন আক্তার ঝিনুক। এ নারী শারীরিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ। কিন্তু অন্য ‘নারীর প্রতি আকৃষ্ট’ হওয়ার কারণে ‘নারী থেকে পুরুষে রূপান্তরিত’ হয়েছে। নতুন নাম নিয়েছে জিবরান সওদাগর। এখন আবদার করছে আইন ও সমাজ তাকে যেন মেনে নেয় পুরুষ হিসেবে। (সূত্র : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, দৈনিক প্রথম আলো)।

ট্রান্সজেন্ডারবাদ বাস্তবায়নে ক্ষতিকর দিকগুলো : এ মতবাদ বাস্তবায়ন হলে আমাদের কী ক্ষতি হবে? এ প্রসঙ্গে সংক্ষেপে মোটাদাগে কয়েকটি কথা বলা যায়- ১. আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধাচরণ। ২. ছেলে-মেয়ে উত্তরাধিকার সম্পদ বণ্টনে বিভ্রান্তি। ৩. একই রুমে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ। ৪. সমকামিতার দ্বিধাহীন বাস্তবায়ন। ৫. বাস্তবতার বিরুদ্ধে অবস্থান। নারীত্ব ও পুরুষত্বের মর্যাদা ক্ষুণ্ণকরণ। ৬. নারী-পুরুষের মাঝে বিভেদের দেয়াল তুলে দেওয়া। ৭. সৃষ্টি ও সমাজের আইন ভেঙে ফেলা। আরেকটু চিন্তা করলে আরও বেরিয়ে আসবে কত শত সমস্যার কথা! এদের এ পশ্চিমা চিন্তাধারা থেকে সমস্যা ছাড়া কোনো উপকার উপলব্ধ হয় না।

ইসলামি শরিয়ত যা বলে : আল্লাহ যা বৈধ করেছেন, এর বাইরে কোনো কিছু নেই। মানুষের তৈরিকৃত নয়, বরং ইসলাম দৈহিক বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে মানবজাতিকে নারী-পুরুষ হিসেবে নির্ধারণ করেছে। কোরআন থেকে আমরা জানতে পারি, শয়তান আল্লাহর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছে, অবশ্যই তারা আল্লাহর সৃষ্টি বিকৃত করবে। (সুরা নিসা : ১১৯)। আমরা সরল অনুবাদ পড়েই অনুমান করতে পারি, ট্রান্সজেন্ডারবাদের মধ্যেই শয়তানের প্রতিজ্ঞা প্রতিফলিত হয়েছে। স্পষ্ট যে, তারা মানুষরূপী শয়তান বলেই বিবেচিত হচ্ছে। আবার হাদিস থেকে জানতে পারি, আল্লাহ সেসব মানুষের ওপর অভিসম্পাত করেছেন, যারা তার সৃষ্টিকে বিকৃত করে। (বোখারি : ৪৮৮৬)। হাদিসের বাণী অনুযায়ী তারা অভিশপ্ত জাতি। এদের উদ্ভব ইহুদি-খ্রিষ্টান থেকে। এ অভিশপ্ত জাতির সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। কাজেই এদের ব্যাপারে শরিয়তের নির্দেশনা হলো, এদের এসব কার্যকলাপ সম্পূর্ণ হারাম।

সতর্কতা ও সচেতনতার প্রয়োজন : অনেকেই মনে করছেন, ট্রান্সজেন্ডারবাদ মানে তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়াদের অধিকার নিয়ে কোনো আন্দোলন বা শারীরিক সমস্যার কারণে লিঙ্গ পরিবর্তন করার বিপ্লব। না, বাস্তবতা হলো, সরাসরি সমকামিতার পক্ষে কর্মকাণ্ড চালানো কঠিন। তাই এখানে ট্রান্সজেন্ডার নামের আড়ালে এলজিবিটি এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। উভয়ের পার্থক্যটা এককথায় বুঝে নিই, হিজড়া হলো এমন মানুষ, যাদের জন্মগতভাবে প্রজননব্যবস্থা এবং যৌন বিকাশের ত্রুটি থাকে। এ ত্রুটি যৌনাঙ্গের গঠনগত, জিনগত বা অন্য ধরনের হয়ে থাকতে পারে। এরা সন্তান জন্ম দিতে পারে না। অপরদিকে ট্রান্সজেন্ডার হলো জন্মগত লিঙ্গের কোনো সম্পর্ক নেই। একজন ছেলে বা একজন মেয়ে নিজেকে ভুল দেহে আটকা পড়েছে, তাই তার ইচ্ছেমতো ছেলে-মেয়ে হওয়ার অধিকার রাখে। সুতরাং দুটি সম্পূর্ণ বিপরীত। ট্রান্সজেন্ডার পুরোটাই ভিত্তিহীন একটি মতবাদ। আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে এ ভয়াবহ ফেতনা থেকে হেফাজত করুন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত