মুখের যত্নে সচেতন হোন
ইলিয়াস মশহুদ
প্রকাশ : ১৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ইসলাম পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে বেশ গুরুত্বারোপ করেছে। বলা হয়েছে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অংশ। কারণ, ইসলামের মৌলিক ইবাদতগুলো পালন করতে হলে পবিত্র হতে হয়। পাশাপাশি দৈহিক পরিচ্ছন্নতা অর্জনও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দৈহিক পরিচ্ছন্নতার যে ব্যাপারগুলো রয়েছে, সেগুলোকে ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত এবং মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে। তা ছাড়া অপরিচ্ছন্ন জীবনযাপন ইসলামের শিক্ষা নয়। মোমিনকে যেমন অবস্তুগত অপরিচ্ছন্নতা বা হাদাস থেকে পবিত্র হতে হয় অজু বা গোসলের মাধ্যমে, তেমনি বস্তুগত অপরিচ্ছন্নতা বা খুবুস থেকেও পবিত্র হতে হয় দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, বস্ত্র ও স্থান ইত্যাদি পরিষ্কারের মাধ্যমে। তা ছাড়া প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য পবিত্রতা তো অর্জন করতেই হয়।
মুখের পরিচ্ছন্নতা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত : আমাদের শরীরে বিভিন্ন ফটক রয়েছে, যেমন- কান। কান দিয়ে আমরা অন্যের কথা বা আওয়াজ শুনি। এটা হচ্ছে শোনার ফটক। ঠিক তেমনি নাক হচ্ছে সুগন্ধ-দুর্গন্ধ অনুভবের ফটক। আর মুখ হচ্ছে খাদ্য-পানীয় প্রবেশের ফটক। আবার কথার এক্সিট পথও হচ্ছে মুখ। তাই মুখ শরীরের সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটা অঙ্গ। মুখহীন মানুষ কেউ কল্পনা করতে পারে না। মুখ দিয়ে যেহেতু খাবার-পানীয় খেতে হয়, অন্যের সামনে কথা বলতে হয়, তাই মুখের পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। দৈহিক অপরিচ্ছন্নতার একটি অন্যতম অংশ এই ‘মুখ’। মুখের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। মুখে দুর্গন্ধ হলে তা যেমন পরিবেশ নষ্ট করে, তেমনি মানুষের জন্য কষ্টের কারণ হয়। তাই রাসুল (সা.) কাঁচা পেঁয়াজ-রসুন খেয়ে মসজিদে যেতে বারণ করেছেন। এমনকি এভাবে মুখে দুর্গন্ধ নিয়ে কেউ মসজিদে প্রবেশ করলে তাকে বের করে দিতে বলেছেন। (মুসলিম : ৫৬৭)।
দুর্গন্ধের কারণ ও প্রতিকার : মুখে মূলত দুর্গন্ধ হয় নানা কারণে। কারও খাবার থেকে, কারও অসুস্থতার কারণে, কারও আবার অলসতার কারণে। তবে আমাদের আশপাশে অনেকেই আছেন, যারা নিজেদের মুখের এ দুর্গন্ধ নিজেরা অনুভব করেন না, ফলে দিব্যি মানুষের মুখের সামনে কথা বলে যান। পরিণতিতে অনেক সময় তাকে বিব্রত হতে হয়। লজ্জার মুখে পড়তে হয়। আবার অনেকে অনুভব করেন; কিন্তু দূর করতে পারেন না। ফলে কারও সঙ্গে মন খুলে কথাও বলতে পারেন না। কথা বলতে ভয় লাগে। মুখ চেপে ধরে অথবা বাঁকা করে অথবা দূর থেকে কথা বলতে হয়। কারণ, দুর্গন্ধের কারণে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন এমনকি প্রিয়জনও ঘৃণা করে। ছোট হতে হয় অনেকের কাছে। মুখে দুর্গন্ধ হলে করণীয় সম্পর্কে ইসলাম যে পদ্ধতি অবলম্বন করতে বলেছে, অর্থাৎ মেসওয়াকের সঠিক ব্যবহার করার পাশাপাশি উল্লিখিত পদ্ধতিগুলো প্রয়োগ করুন। আশা করা যায়, এগুলো প্রয়োগের ফলে মুখের দুর্গন্ধ দূর হয়ে যাবে।
মুখের দুর্গন্ধে কথায় বিব্রতবোধ : মুখ ঢেকে কথা বলা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। কারও সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলতে গেলে বিব্রত লাগে। হাসাও যায় না প্রাণ খুলে। আমাকে নিয়ে কে কী ভাবছে? এসব চিন্তা করে সবসময় মনে একটি চাপা ভয় যেন থেকেই যায়। কোনো ভদ্রলোক জরুরি কথা বলছেন, আর আপনি বিব্রত হচ্ছেন। না, এ বিব্রতবোধ তার গুরুত্বহীনতার কারণে নয়; বরং বেখেয়াল অথবা নিজের সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণে। বিব্রতবোধের কারণ হলো, ভদ্রলোকের মুখ থেকে ধেয়ে আসা বিশ্রী দুর্গন্ধ। আবার এমনও হয়, আপনি কারও সঙ্গে কথা বলছেন। তখন লক্ষ্য করলেন, ওপাশের ভদ্রলোক আপনার থেকে তার মুখ কিছুটা সরিয়ে নিচ্ছেন। আপনি তখন আরও সামনে এগিয়ে গেলেন। এমন অবস্থায় যদি আমরা সবাই কমবেশ পড়ে থাকি, তখন হয়তো ওপাশের ব্যক্তি সম্মানের কারণে অথবা ভদ্রতা দেখিয়ে দুর্গন্ধ সয়ে যাই। মুখের ওপর বলতে পারি না, ‘আপনার মুখ থেকে শুধু কথা না, বুর বুর করে দুর্গন্ধও বেরুচ্ছে।’
ভালোভাবে মুখ পরিষ্কার করুন : অনেকদিন পর বন্ধুর সাথে দেখা। আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন। আবেগী কথা বলছেন বন্ধু। এদিকে আপনার বমি আসার উপক্রম। কারণ, তার মুখ থেকে বিশ্রী অসহ্য দুর্গন্ধ বেরুচ্ছে। আর আপনি না পারছেন সইতে, ছাড়িয়ে নিতে অথবা না পারছেন বলতে। কী আর করা! আপনি ছাত্র অথবা শিক্ষক; বাধ্য হয়েই আপনাকে আরেকজনের মুখোমুখি বসতে হয়। শিক্ষকের লেকচার অথবা ছাত্রের পড়া শুনতে হয়। এমতাবস্থায় আপনি ছাত্র হলে শিক্ষকের মুখ থেকে, আর শিক্ষক হলে ছাত্রের মুখ থেকে ধেয়ে আসা উৎকট গন্ধময় সময় পার করতে হয়। ছাত্র হলে তো অনেক সময় সংশোধনের নিয়তে বলে দেওয়া যায়, কিন্তু আপনিই যদি শিক্ষক হন, তাহলে ছাত্রের সেই সাহস কোথায়? মুখে দুর্গন্ধ হতেই পারে। প্রতিদিন সকালে মুখের সামনে হাত নিয়ে শ্বাস নিয়ে দেখুন, আপনার মুখে দুর্গন্ধ আছে কি না। থাকলে দূর করার চেষ্টা করুন। ভালো করে মুখ পরিষ্কার করুন। বাসায় থাকতে ব্রাশ করুন। বেরুনোর সময় পকেটে মেসওয়াক রাখুন। যখনই সুযোগ পাবেন, মেসওয়াক করে কুলি করুন। বিশেষত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময়। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যদি আমার উম্মতের ওপর কষ্ট মনে না করতাম, তবে প্রতিদিন পাঁচবার মেসওয়াক করার নির্দেশ দিতাম!’ (সহিহুল জামে : ৫৩১৬)।
দুর্গন্ধে ভালোবাসায় ভাটা পড়ে : কেউ সাহস করে আপনার এ দোষ বা অসুখটির কথা বলে ফেললে নিঃসংকোচে গ্রহণ করুন। তাকে সাধুবাদ জানান। বলুন, ভাই! চেষ্ট করছি। হচ্ছে না। আরও চেষ্টা করব। আপনি কষ্ট পেয়ে থাকলে ক্ষমা করে দিন। এমনটা করতে লজ্জা নেই। আপনার সম্মান আরও বাড়বে। তা ছাড়া আপনি যদি বিবাহিত হন, তবে স্ত্রীর মুখে এ দুর্গন্ধ লাগবে, এটা স্বাভাবিক। তখন স্ত্রীর আদর-ভালোবাসায় ভাটা পড়বে। বিশেষ মুহূর্ত পানসে হয়ে যাবে। কেননা, সেটা রোমান্টিকতায় বিঘ্ন ঘটনায়। তাই অসুখ বা এমনিতেই মুখে যদি দুর্গন্ধ না থাকে, আর আপনি অদিরিক্ত পানখাদক হন অথবা ধূমপায়ী, তাহলে তো কথাই নেই। আপনার ওপর দাঁত-মুখ পরিষ্কার করা ফরজের পর্যায়ে পড়ে। নারীরা যেহেতু সাধারণত ধূমপায়ী হন না, তাই এখানে শুধু পুরুষের কথা বলা হয়েছে। তবে নারীদেরও বিছানায় যাওয়ার আগে নিজেদের দাঁত-মুখ পরিষ্কার করতে হবে। মুখে র্দ্গুন্ধ অনেকেরই হয়। এ ছাড়া কিছু মানুষ আছেন, যাদের ১২ মাসই মুখে দুর্গন্ধ লেগে থাকে। কারও কারও আবার মৌসুমভেদে মুখে দুর্গন্ধ হয়। ধরুন, কর্মক্ষেত্রে আপনার সহকর্মীর একেবারে পাশঘেঁষে আপনাকে সারাদিন বসে থাকতে হয়। সহকর্মীর মুখে কিন্তু দুর্গন্ধের আড়ৎ! কথা বলার সময় ক্ষণে ক্ষণে বেরিয়ে আসে বিষাক্ত গন্ধ।
দুর্গন্ধ এড়ানোর কৌশল : মুখের দুর্গন্ধ বিব্রতকর একটি সমস্যা। প্রতিটি মানুষের মুখ, দাঁত ও জিহ্বায় স্বাভাবিকভাবেই কিছু জীবাণু থাকে। এগুলো নিজের সুস্থতার জন্যই প্রয়োজনীয়। তাই নিয়মিত সঠিক উপায়ে দাঁত ব্রাশ, খাওয়ার পরে কুলকুচি, প্রয়োজনে ফ্লস ব্যবহার, মাউথওয়াশ ব্যবহার করার মাধ্যমে সহজেই এমন সমস্যা এড়ানো যায়। এ ছাড়া খাবারদাবার বিশেষত পেঁয়াজ, রসুন, কমলালেবুর রস এবং কিছু মসলার কারণে মুখে দুর্গন্ধ হতে পারে। এ ছাড়া যে কোনো খাবার দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকলে মুখে দুর্গন্ধ হয়। দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকলেও কিন্তু মুখে দুর্গন্ধ হয়। যারা অ্যালকোহল কিংবা ধূমপান করেন, তাদের মুখেও দুর্গন্ধ হয়। পান, সুপারি, জর্দা, গুল ইত্যাদিও দুর্গন্ধের কারণ। মুখ যাদের শুকনো হয়ে থাকে, তাদেরও মুখে দুর্গন্ধ হওয়ার প্রবণতা বেশি। মুখ খোলা রেখে যারা ঘুমান, তাদের মুখ শুকনো হয়ে থাকে। আবার কিছু ওষুধ সেবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবেও মুখ শুকনো হয়ে যায়। মুখ পরিষ্কার করার সময় জিহ্বাও পরিষ্কার করুন। ঘুমের আগে মাউথওয়াশ ব্যবহারের অভ্যাস করুন। চিনিবিহীন চুইংগাম চিবাতে পারেন। মুখ শুকনো বোধ করলে একটু পানি খেয়ে নিন; যাতে অন্তত গলাটা ভেজে। পান, সুপারি, জর্দা, গুল, সিগারেট ও অ্যালকোহল গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন। চিকিৎসা নিন। এ ছাড়া ভাজা ধনিয়া, কালোজিরা অথবা স্রেফ পান-সুপারিও মুখে রাখতে পারেন।