বই মানবজীবনের বিশ্বস্ত সঙ্গী
আবদুল্লাহ নোমান
প্রকাশ : ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বই মানবজীবনের অকৃত্রিম বন্ধু, বিশ্বস্ত সঙ্গী। যে সুখে-দুঃখে মানুষের পাশে থাকে। কখনো অনির্বচনীয় আনন্দে উদ্বেলিত করে; আবার কখনো সান্ত¡নার শীতল পরশে আশাবাদী করে তোলে। বইয়ের পাতার সোঁদা গন্ধে রয়েছে জ্ঞানের সৌরভ, প্রজ্ঞার সুবাস। বর্ণমালার দীপক আলো মেলে ধরে স্বপ্নের আগামীর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। সত্য, সুন্দর ও নির্মাণের অঙ্গীকারে মুখরিত করে তোলে চারপাশ। দেহমন-চিন্তা-স্বপ্ন ক্রমাগত সমৃদ্ধ হয় আলোকিত জ্ঞানের পরশে। মানব মনে বিপ্লব সৃষ্টির, আদর্শ সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব নির্মাণের অব্যর্থ হাতিয়ার জ্ঞানদীপ্ত বই। এর বর্ণে বর্ণে ফুটে ওঠে মিথ্যার জঘন্য ছবি আর সত্যের জলজ্যান্ত পয়গাম। অন্যায়-অবিচার, অশিক্ষা-কুশিক্ষা ও অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে রোষায়িত ঘৃণা ঝরে পড়ে বইয়ের ছত্রে ছত্রে। বই পাঠের ভেতর দিয়ে চৌকস পাঠক খুঁজে পায় প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার সরল পথ। শুধু চিত্তবিনোদনের জন্য নয়, বই জীবনকে জানার, বোঝার ও কাজে লাগানোর বিশ্বস্ত গাইড।
বই মানবতার বিশ্বস্ত কণ্ঠস্বর : বই সৈনিকদের টার্গেটভেদী অস্ত্র। নাবিকদের দূরপাল্লার লাইট হাউজ। পূর্ণাঙ্গ মানবজীবনের বিশ্বস্ত কণ্ঠস্বর। ইহ-পরকালীন সুখ-শান্তি লাভের স্ফটিক স্বচ্ছ দর্পণ। বাতিলের বিরুদ্ধে সাহসী হুংকার। হকের পক্ষে অনুপম ঝংকার। বই উচ্চকণ্ঠিত মুয়াজ্জিনের মায়াভরা ডাক। কল্যাণকামী আহ্বায়কের মধুঝরা আহ্বান। বই শারীরিক অসুস্থদের যেমন রোমাঞ্চকর প্রেসক্রিপশন, তেমনি আত্মার রোগীদের কার্যকরী প্রতিষেধক। বই পাঠকের চোখে-মুখে সৃষ্টি করে অন্যরকম উৎসব। তৈরি করে বুকমাতানো আমেজ। পাঠনেশা লাগিয়ে দেয় প্রজন্মের সিনায়-সিনায়, শিরায়-শিরায়। শব্দের অলংকার, অর্থের ঝংকার এবং ভাবের প্রাণিত ছোঁয়ায় দারুণ এক মিতালী গড়ে তোলে পাঠকের সঙ্গে। সমাজের রক্তচোষা মুনাফাখোর ব্যবসায়ী, ধাপ্পাবাজ নির্লজ্জ রাজনীতিক, ঘুষখোর বেহায়া অফিসার, ক্ষমতার অপব্যবহারকারী জালিমগোষ্ঠীর ভেতরের রূপগুলো দগদগে হয়ে ওঠে শব্দমালার রক্তিম বুকে। কুশিক্ষা ও অপসংস্কৃতির বর্ণচোরা বেপারিদের মুখোশ উন্মোচিত হয় বর্ণমালার দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে। সত্যান্বেষী চিন্তা, সৃষ্টিমুখর চেষ্টা এবং সৌন্দর্যপ্রবণ নিষ্ঠার অধিকারী যে ঈমানদীপ্ত সোনালি উম্মাহর আমরা স্বপ্ন বুনি, যে প্রজ্ঞাদীপ্ত গৌরবময় পৃথিবীর প্রহর গুনি, সে উম্মাহ ও পৃথিবী নির্মাণে বইপাঠ এক অনুপেক্ষ উপাদান। তাইতো তাবৎ পৃথিবীর মানব সভ্যতার অব্যর্থ গাইড লাইন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ কোরআনুল কারিমে এসেছে, ‘বল, যারা জানে এবং যারা জানে না, তারা কি সমান?’ (সুরা যুমার : ৯)। অন্য আয়াতে এসেছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের ইলম দান করা হয়েছে, আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদায় উন্নত করবেন।’ (সুরা মুজাদালা : ১১)। বিশ্বমানবতার অনুপম রূপকার নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা যার কল্যাণ চান, তাকে দ্বীনের সহিহ সমঝ দান করেন।’ (বোখারি : ৭১, মুসলিম : ১০৩৭)।
বইয়ের উৎস অহি : অভিধান মতে দুই বর্ণের বই শব্দটি এসেছে আরবি ‘অহি’ শব্দ থেকে। আর ‘অহি’ হচ্ছে আল্লাহতায়ালা কর্তৃক তাঁর নির্বাচিত নবী-রাসুলদের ওপর বিশেষ প্রত্যাদেশ। আরবি ‘ওয়াও’ হরফের বাংলা উচ্চারণ হয় ‘ব’। তাই ‘অহি’র বাংলা উচ্চারণ হয় ‘বহি’। কাল পরিক্রমায় ভাষার পরিবর্তনে ‘বহি’ শব্দটি ‘বই’ রূপ ধারণ করেছে। তার মানে অহি থেকে বহি; বহি থেকে বই। তাইতো আমাদের ভাষায় বহি শব্দের ব্যবহার অপ্রতুল হলেও এখনো হারিয়ে যায়নি। এভাবে বইয়ের সঙ্গে অহির জ্ঞানের রয়েছে শেকড়ের সম্পর্ক। আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে বিশ্বনবী (সা.)-এর ওপর প্রেরিত ‘অহি’ পবিত্র কোরআন অবতরণের সূচনাই হয়েছে ‘পড়ুন’ অনুজ্ঞাসূচক ক্রিয়া দিয়ে। মানবজাতির সংবিধান এ ঐশীগ্রন্থে সর্বপ্রথম অবতীর্ণ হয়েছে সুরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত। যেখানে আলোচনা হয়েছে পাঠ করা কিংবা জ্ঞানার্জন সম্পর্কে। রাব্বুল আলামিন তার প্রিয়তম হাবিব মুহাম্মদ (সা.)-কে আদেশ করে বলেন, ‘পড়ুন! আপনার প্রতিপালকের নামে, যিনি মানুষকে রক্তপি- থেকে সৃষ্টি করেছেন। পড়ুন, আপনার প্রতিপালক মহিমান্বিত; যিনি কলম দ্বারা শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে, শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না।’ (সুরা আলাক : ১-৫)। শুধু তা-ই নয়, আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনের অন্তত ৯২ জায়গায় জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার প্রসঙ্গ এনেছেন। ‘আল কোরআন’ শব্দটির একটি অর্থও ‘অধ্যয়ন’। সুতরাং, বলতে দ্বিধা নেই, অহি থেকে উৎসারিত বই-ই প্রকৃত বই এবং আলোর উৎস। এর দ্বারাই গঠিত হয় আলোকিত মানুষ, বিকশিত হয় মানবতা, সুসংঘটিত হয় সমাজব্যবস্থা। আর অহিবঞ্চিত কালো কালির হরফে লিখিত চমকপ্রদ প্রচ্ছদের পাণ্ডুলিপিগুলো দেখতে বই হলেও তা আসলে ‘ভয়’; আতঙ্কের বিষয়। অহির দীপক আলো থেকে বঞ্চিত শেকড়হীন ওসব বই মানবজাতির জন্য কালসাপ। রোগ-জীবাণু ছড়ানো ভাইরাস। এ জাতীয় বিষাক্ত বইয়ের দূষিত বাতাসে ধ্বংস হয় মানব সভ্যতা। এতে আক্ষরিক অর্থে মিস্টার ইবলিশকেই খুশি করা হয়। অথচ মহান আল্লাহ দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছেন, ‘হে মোমিনগণ! তোমরা ইসলামে পূর্ণরূপে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের সুস্পষ্ট শত্রু।’ (সুরা বাকারা : ২০৮)।
নষ্ট বইয়ের দুষ্ট প্রভাব : অহির আলোয় আলোকিত বইয়ের সৌরভ যেমন সুবিদিত, তেমনি অহিবঞ্চিত বইয়ের বিষক্রিয়া অনস্বীকার্য। দুষ্ট মানসিকতার লোকের আঙুলের ডগায় প্রসবিত বইগুলো সমাজে পাপাচার-অনাচার এবং কদাচারের জীবাণু ছড়ায়। ছড়ায় ফষ্টিনষ্টির মাতাল তালে আন্দোলিত দুর্গন্ধময় বিষাক্ত বাতাস। চরিত্র ও সভ্যতার চির দুশমনদের হাতে রচিত তথাকথিত বইগুলো তরুণ-তরুণীদের উদ্বুদ্ধ করে বিয়েবহির্ভূত রিলেশনশিপের প্রতি। ইয়াং জেনারেশনের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় মা-বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, নির্লজ্জতা এবং উলঙ্গপনার অভয়ারণ্যে হারিয়ে যাওয়ার পথ। বখাটে যুবকদের মন-মুকুরে সৃষ্টি করে কালো সন্ধ্যা যাপনের রঙিলা তৃষ্ণা। সভ্যতার নামে উচ্ছৃঙ্খলতাই কথিত বইগুলোর শাণিত বার্তা। সৃষ্টির নামে অনাসৃষ্টির আকর পশ্চিমা প্রেতাত্মাদের এসব গুদামপঁচা বই। যেখানে গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ডের বাঁধনহারা অপসংস্কৃতিকেই প্রমোট করা হয় খুব জোরালোভাবে। তাইতো তরুণ-তরুণীর রসালো প্রেমালাপ, হাত ধরাধরি করে হাঁটা, একান্ত নির্জন বাস, পরিণতিতে টয়লেটে-ডাস্টবিনে খণ্ডিত ভ্রূণ বা নবজাতক দেখা। এসবই কি আধুনিক বইয়ের আলো? এ পতনের শেষ কোথায়! এ লজ্জা কোথায় লুকাই!
অহি উৎসারিত বই ও অহিবঞ্চিত বই : পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনো সর্বাধিক বিক্রিত বই নেই, যার লেখক দাবি করতে সক্ষম হয়েছে, এর প্রতিটি অধ্যায় ও অনুচ্ছেদ, প্রতিটি তথ্য ও তত্ত্ব সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত; এর কোনো বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই বিন্দুমাত্র। শুধু অহি থেকে উৎসারিত বইয়ের ক্ষেত্রেই এর প্রতিটি কথা সন্দেহাতীত বলে দাবি করা সম্ভব। কোরআন মানবজাতির সব সমস্যার সমাধান এবং যাবতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের আধার। মহান রাব্বুল আলামিন পাঠিয়েছেন পরিপূর্ণ জীবনবিধান হিসেবে আমাদের জন্য। সৃষ্টির পরতে পরতে স্রষ্টার যে অপার মহিমা ও অফুরান জ্ঞানভান্ডার রয়েছে, সেখান থেকে মণিমুক্তা আহরণ করতে হলে পবিত্র কোরআনের ধারস্থ হতে হবে। শিখতে হবে এর বিশুদ্ধ তেলাওয়াত। পড়তে হবে সুমধুর কণ্ঠে। দেখতে হবে এর তাফসির। ভাবতে হবে এর প্রতিটি আয়াত নিয়ে গভীরভাবে, তন্ময়চিত্তে, আত্মসমাহিত হয়ে। প্রিয়তম রবের কালাম, জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক পঠিত এ মহান বইটিই মুসলিম উম্মাহর কেন্দ্রীয় আশ্রয়। যাকে আঁকড়ে ধরে মোমিনগণ আলোয় ভরিয়ে তুলতে পারে জীবনের প্রতিটি অধ্যায়। বাঁচতে পারে গোনাহের রকমারি হাতছানি, শয়তানের সূক্ষ্ম কুমন্ত্রণা এবং ধ্বংস ও পতনের চোরাবালিতে তলিয়ে যাওয়া থেকে। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘আমি তোমাদের মাঝে এমন দুটি বিষয় রেখে যাচ্ছি, যা আঁকড়ে থাকলে তোমরা কোনোদিন পথহারা হবে না। তা হলো- আল্লাহর কিতাব ও তার নবীর হাদিস।’ (মুয়াত্তায়ে মালেক : ১৬০৪)।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক