সুখময় সংসারের পাথেয়
শায়খ ড. ফয়সাল বিন জামিল গাজ্জাবি
প্রকাশ : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
পরিবার ইসলামি সমাজব্যবস্থার মূলভিত্তি। ইসলাম পারিবারিক বন্ধন দৃঢ়করণে সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। পারিবারিক বন্ধন ধ্বংস করা, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মনোমালিন্য সৃষ্টি করা, তাদের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটানো- শয়তানের গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনার অংশ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘ইবলিস পানির ওপর তার সিংহাসন স্থাপন করে। এরপর চারদিকে তার দলবল পাঠায়। সবচেয়ে ছোট শয়তানও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে অনেক বড় ভূমিকা রাখে। (দিন শেষে) একেকজন আসে, আর বলে- আমি এই করেছি, আমি ওই করেছি। শয়তান বলতে থাকে, তুমি কিছুই করোনি, তুমি কিছুই করোনি। এরপর বিশেষ একজন এসে বলে, আমি এক দম্পতির মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে এসেছি। শয়তান তাকে কাছে টেনে বলে, শাবাশ! শাবাশ!’ (মুসলিম : ২৮১৩)। স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদে শয়তান খুশি হয়। কারণ, এতে বংশধারা বন্ধ হয়ে যায়, বাচ্চাদের শিক্ষাদীক্ষায় বিঘ্ন ঘটে, সন্তানরা বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়; উপরন্তু মানুষের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা সৃষ্টি হয়।
সমস্যা হলে দ্রুতই সমাধান : আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা নিজেদের বিবাদ মিটিয়ে নাও।’ (সুরা আনফাল : ১)। অর্থাৎ তোমাদের মধ্যকার সমস্যাগুলো সমাধান করে নাও; যাতে পারস্পরিক প্রেম-ভালোবাসা ও মতৈক্যের সৃষ্টি হয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি কি তোমাদের নামাজ-রোজা ও সদকার চেয়ে উত্তম কিছুর সংবাদ দেব না?’ সাহাবিরা বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! অবশ্যই।’ তিনি বললেন, ‘তা হলো, পারস্পরিক মনোমালিন্য সমাধান করা। মনোমালিন্য সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে দেয়।’ (সুনানে আবি দাউদ : ৪৯১৯)। আমাদের নিজেদের ও অধীনস্থদের সংশোধন করে নিতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘হে ঈমানদাররা! তোমরা নিজেদের ও পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।’ (সুরা তাহরিম : ৬)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘পুরুষ তার পরিবারের দায়িত্বশীল। সে তার অধীনস্থদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (বোখারি : ২৪০৯)।
সর্বোত্তম পুরুষ : পরিবারের কাছে সেরা হওয়ার দিক দিয়ে রাসুল (সা.)-ই ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। স্ত্রীদের জন্য সঙ্গী হিসেবেও তিনি ছিলেন সর্বোত্তম। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সে-ই সবচেয়ে ভালো, যে তার পরিবারের কাছে ভালো। আমি নিজ পরিবারের কাছে সবচেয়ে ভালো।’ (তিরমিজি : ৩৮৯৫)। স্বামী-স্ত্রী পরস্পর সৎভাবে জীবনযাপন করবে। একে অন্যের কল্যাণকামী হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা স্ত্রীদের সঙ্গে সৎভাবে জীবনযাপন করো।’ (সুরা নিসা : ১৯)। তিনি আরো বলেন, ‘নারীদের তেমনই ন্যায়সঙ্গত অধিকার রয়েছে, যেমন রয়েছে পুরুষদের।’ (সুরা বাকারা : ২২৮)। স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে ভালো কাজে সাহায্য করবে। পরস্পর কল্যাণকামী হবে। ভালোবাসার মধ্য দিয়ে একে অন্যের হক আদায়ে আগ্রহী হবে। ঝগড়া-বিবাদ থেকে দূরে থাকবে। পরস্পর গালাগালি করবে না। কেউ কাউকে মন্দ নামে ডাকবে না। কেউ কারো মন ভাঙবে না। অনুভূতিতে আঘাত হানবে না। একে অন্যের প্রেমী হবে। ভালোটা মনে রাখবে। মহৎ কাজের প্রশংসা করবে। ভুল হলে স্বীকার করবে। ভুল স্বীকার বা ওজর-আপত্তি করলে মেনে নেবে।
স্বামীদের প্রতি নবীজি (সা.)-এর উপদেশ : রাসুল (সা.) স্ত্রীর সঙ্গে উত্তম আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘খবরদার! নারীদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করো। তারা তোমাদের অধীনস্থ।’ (তিরমিজি : ৩০৮৭)। প্রত্যেক স্বামীকেই স্ত্রীর ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করতে হবে। আল্লাহতায়ালা স্ত্রীকে স্বামীর অধীন করেছেন। স্বামীকে স্ত্রীর হেফাজতের দায়িত্ব দিয়েছেন। অতএব, তাকে স্ত্রীর প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। তার ইজ্জত-আব্রু সংরক্ষণ করতে হবে। সার্বিক উপকার ও কল্যাণ সাধনে ব্রতী হতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘পুরুষরা নারীদের পরিচালক।’ (সুরা নিসা : ২৪)।
তারা নারীর খেয়াল রাখবে। ভুল শুধরে দেবে। পরিচালনা করবে। ভরণ-পোষণ দেবে। তবে এটি কোনো জবরদস্তিমূলক পরিচালনা নয়; এ পরিচালনা করতে গিয়ে পুরুষ যেন জুলুম না করে, নারীকে কষ্ট না দেয়, তার মনে ঘৃণা সৃষ্টি না করে। স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গে কোমল ও দয়াদ্র আচরণ করবে। তাকে ক্ষমা করবে। দোষ-ত্রুটি এড়িয়ে যাবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোনো মোমিন স্বামী যেন তার মোমিন স্ত্রীর প্রতি রাগ না করে। তার কোনো আচরণ অপছন্দ হলে, অন্য কোনো আচরণ তো পছন্দনীয়ও হতে পারে।’ (মুসলিম : ১৪৬৯)।
তবে স্ত্রীকে খুশি করতে গিয়ে কেউ যেন আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত না হয়। স্ত্রীর কোনো আচরণ ভালো না-ও লাগতে পারে, তবু তার সঙ্গে উত্তম আচরণ করতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা তাদের সঙ্গে ন্যায়ানুগভাবে সংসার করো। তাদের অপছন্দ হলেও; হতে পারে আল্লাহতায়ালা তোমাদের অপছন্দের ভেতরে প্রভূত কল্যাণ নিহিত রেখেছেন!’ (সুরা নিসা : ১৯)। স্ত্রী অবাধ্যতা করলে তাকে এমনভাবে সংশোধন করতে হবে, যাতে তার ভবিষ্যৎ চলার পথ শুদ্ধ হয় এবং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বন্ধন দৃঢ় হয়। আর এটি করতে হবে সম্পূর্ণ শরিয়ত নির্দেশিত পন্থায়।
উত্তম স্ত্রীর গুণ : সদ্বংশজাত ও ভালো মেয়েরা আল্লাহকে ভয় করে। বৈবাহিক সম্পর্কের দায়কে গুরুত্ব দেয়। আইউব (আ.)-এর স্ত্রী ছিলেন ধৈর্যশীলা, সতী, আল্লাহভীরু ও বিশ্বস্ত নারী। আইউব (আ.) একসময় আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষার সম্মুখীন হলেন। তার শরীর পচে গেল। সন্তানরা মারা গেল। সম্পদ ডাকাতি হয়ে গেল। ১৮ বছর চলল এ পরীক্ষা। এ দীর্ঘ সময় তিনি স্বামীর পাশে থেকেছেন। তার সেবা করেছেন। সহমর্মিতা দেখিয়েছেন। তাকে ছেড়ে যাননি। তার ব্যাপারে অনাগ্রহী হননি। তিনি ছিলেন ত্যাগ, বিশ্বস্ততা ও মহত্বের অনন্য উপমা।
ওমর (রা.) রাতে প্রজাদের খোঁজখবর নিতে বেরুতেন। এক রাতের ঘটনা। তিনি মদিনায় বেরিয়েছেন। হঠাৎ এক নারীর আওয়াজ কানে এলো। তার স্বামী বাড়ি নেই। সে কবিতা আবৃত্তি করছে, ‘রাত অনেক দীর্ঘ হয়েছে। আঁধারে ছেয়ে গেছে সর্বত্র। আমার ঘুম নেই। নেই ক্রীড়া করার মতো কোনো সঙ্গীও। আল্লাহর শপথ! তার ভয় যদি আমার মনোজগতে বিরাজ না করত, এই খাটের প্রান্তগুলো অবশ্যই আন্দোলিত হতো।’ আল্লাহর ভয় তাকে ধৈর্য ধরতে উৎসাহিত করেছে। স্বামীর অনুপস্থিতিতে সে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। নিজের সতীত্ব রক্ষা করেছে। সংসার ভাঙার কাজ থেকে বিরত থেকেছে।
বুদ্ধিমতী নারী স্বামীর হক আদায়ে যত্নবান হয়। রাসুল (সা.)-কে সর্বোত্তম নারীর পরিচয় জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘যে নারী স্বামীর আদেশ পালন করে, যাকে দেখলে স্বামীর খুশি লাগে, যে নিজের সম্ভ্রম ও স্বামীর সম্পদ রক্ষা করে; সে-ই সর্বোত্তম নারী।’ (সুনানে সাইদ ইবনে মানসুর : ৫০১)। রাসুল (সা.) এক নারীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি বিবাহিতা?’ সে বলল, ‘জ্বী।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তুমি স্বামীর কাছে কেমন স্ত্রী?’ সে বলল, ‘আমি তার হক আদায়ে কোনো ত্রুটি করি না; তবে অক্ষম হলে ভিন্ন কথা।’ রাসুল (সা.) বললেন, ‘তুমি তার হৃদয়জুড়ে কতটা থাকতে পারছ, সেটা লক্ষ্য রাখবে; সে-ই তোমার জান্নাত, সে-ই তোমার জাহান্নাম।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৯০০৩)। অর্থাৎ তাকে সন্তুষ্ট রাখলে, সে তোমার জান্নাত লাভের কারণ হবে। আর অসন্তুষ্ট করলে, সে হবে তোমার জাহান্নামে প্রবেশের কারণ। তাকে সুন্দরভাবে সঙ্গ দাও। পাপ নয়, এমন কোনো কাজে তার অবাধ্যতা কোরো না। স্রষ্টার অবাধ্যতা করে, সৃষ্টির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের অবকাশ নেই। স্বামীর আনুগত্য স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আন্তরিক ভালোবাসা সুদৃঢ় করে, দাম্পত্য জীবনের ভাঙন ঠেকিয়ে রাখে। ইবনুল জাওজি (রহ.) বলেন, ‘ভালো ও মনমতো স্বামী পেলে বুদ্ধিমান নারীর তাকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করা উচিত। সে কষ্ট পায়, এমন কিছু না করা চাই। কারণ, যখনই সে তাকে কষ্ট দেবে বা তার অপছন্দনীয় কোনো কাজ করবে; এটা তার মধ্যে বিরক্তির উদ্রেক করবে, এর ক্রিয়া তার হৃদয়ে থেকে যাবে।’
সোশ্যাল মিডিয়ার কুপ্রভাব থেকে সাবধান : বর্তমানে মুসলিম পরিবারগুলো ধ্বংসের অন্যতম কারণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিছু সেলিব্রেটি কর্তৃক শেয়ারকৃত ঘরভাঙার বার্তা আর ধর্মীয় মূল্যবোধবিরোধী প্রচারণাসম্বলিত ভিডিও ক্লিপে প্রভাবিত হওয়া। এগুলো থেকে পরিপূর্ণ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। দাম্পত্য সম্পর্ক নষ্টের আরেকটি ভয়ংকর কারণ, কুটনামি করা। এটা কবিরা গোনাহ। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো নারীকে স্বামীর বিরুদ্ধে বিদ্বিষ্ট করে, সে আমার উম্মত নয়।’ (সুনানে আবি দাউদ : ২১৭৫)। যারা কুটনামি করে, তারা নির্দোষের দোষ খোঁজে, অন্তরঙ্গ বন্ধুত্বের মাঝে বিবাদ সৃষ্টি করে।
এ নিকৃষ্ট পাপের চর্চায় কত যে সুখের সংসার নষ্ট হয়েছে, কত মানুষের যে সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে, তার হিসেব নেই। সংসার নষ্ট হয়, এমন কাজ থেকে স্বামী-স্ত্রী দু’জনকেই সতর্ক থাকতে হবে। আত্মীয় হোক বা অনাত্মীয়- যারাই দু’জনের মাঝে ভাঙন সৃষ্টির চেষ্টা করবে, তাদের কথায় কান দেওয়া যাবে না। পারস্পরিক বিভেদ সৃষ্টিকারীরা ইবলিসের চেলা। তারা স্বামী-স্ত্রীর মাঝে শত্রুতা সৃষ্টি করে, তারই মিশন বাস্তবায়ন করে। তারা স্বামীর কাছে স্ত্রীর দোষ বর্ণনা করা ও স্ত্রীকে স্বামীর কাছে হেয় করার মাধ্যমে স্ত্রীর প্রতি স্বামীকে নিরাসক্ত করে তোলে। অন্যদিকে স্ত্রীর কাছেও একই চেষ্টা চালিয়ে তাকেও স্বামীর প্রতি বিদ্বিষ্ট ও নিরাসক্ত করে। একপর্যায়ে স্ত্রী স্বামীকে ঘৃণা করতে শুরু করে ও কষ্ট দিতে থাকে।
কিছু ভালো মানুষও আছেন : এর বিপরীতে কিছু ভালো মানুষও আছেন, তারা মুসলমানদের পরিবারে শান্তি ও স্থিতি চান। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক মজবুত ও স্থায়ী হোক, তুচ্ছ কারণে দুর্বল না হয়ে যাক, সামান্য মতবিরোধে ভেঙে না যাক, এটাই হয় তাদের চেষ্টা-প্রচেষ্টার লক্ষ্য। রাসুল (সা.) স্বামী-স্ত্রীর মতভেদ নিরসনে সচেষ্ট ছিলেন। ফাতেমা ও আলী (রা.)-এর মাঝে মনোমালিন্য হলে তিনি তা মিটিয়ে দিয়েছেন। তিনি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য সুপারিশও করতেন। বারিরা (রা.) যেন তার স্বামীকে পুনরায় গ্রহণ করেন, সেজন্য বারিরা তার কাছে সুপারিশ করেছিলেন।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সামান্য মতবিরোধে অনেক সংসারই ভেঙে পড়ে। স্বামী-স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার উপক্রম হয়। তখনই কোনো সংশোধনকামী আসেন। তাদের সুন্দর কোনো কথা বলেন, মূল্যবান উপদেশ দেন; আল্লাহর রহমতে এর মাধ্যমে তাদের সমস্যা সমাধান হয়ে যায়। পরিবারের বিচ্ছিন্নতা ও তার পরিণতিতে সন্তানদের ধ্বংস হতে দেখে তাদের ঘুম হারাম হয়ে যায়, মন অস্থির হয়ে ওঠে। ফলে তারা পরিবারের বিচ্ছিন্ন সদস্যদের মধ্যে সম্পর্কজুড়ে দেন। তাদের মধ্যকার মতভেদ দূর করার চেষ্টা করেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি যথাসম্ভব সমাধানেরই চেষ্টা করি।’ (সুরা হুদ : ৮৮)। আয়াতের এ মর্মই হয় তাদের পরিচয়চিহ্ন।
মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন মুইনুল ইসলাম