বিয়ের সময় কখন?
গোলাম রাজ্জাক কাসেমি
প্রকাশ : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বিয়ে মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়; চারিত্রিক পবিত্রতা ও নির্মলতা অর্জনের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। হালাল সম্পর্ক ও পবিত্র বংশধারা টিকিয়ে রাখতে বিয়ের বিকল্প নেই। এটি আল্লাহর বিধান, সুন্নতে নববি। মূলত সৃষ্টিগতভাবেই নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। নারী ছাড়া পুরুষ এবং পুরুষ ছাড়া নারীর জীবন অসম্পূর্ণ। বিয়ের মাধ্যমে মানুষের নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্ব দূর হয়। জীবনে সুখ-শান্তি ও আনন্দের ফল্গুধারা বয়ে যায়। শরিয়তসম্মত উপায়ে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে যেমন অসংখ্য গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা যায়, তেমনি খুব সহজেই রাসুল (সা.)-এর অনন্য একটি সুন্নতও আদায় হয়ে যায়। আল্লাহতায়ালা আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করার পর হাওয়া (আ.)-কে তার জীবনসঙ্গীরূপে সৃষ্টি করেন। তাদের ভালোবাসার বন্ধনে গেঁথে দেন। সেই ধারাবাহিকতা এখনও পৃথিবীতে চলমান। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তার (আল্লাহ)-এর নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের থেকেই স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন; যেন তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও। আর তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও মায়া সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা রুম : ২১)।
বিয়ে কখন করবেন : এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘হে যুবক সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে, তারা যেন বিয়ে করে নেয়। কেন না, বিয়ে তার দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং লজ্জাস্থানের হেফাজত করে। আর যার বিয়ে করার সামর্থ্য নেই, সে যেন রোজা রাখে। কেন না, রোজা তার যৌনতা দমনকারী।’ (বোখারি : ৫০৬৬)। অন্য হাদিসে এসেছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হলো, সে যেন তার অর্ধেক দ্বীন পূর্ণ করল।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ : ২৯৬২)। এ হাদিসে ‘যুবক সম্প্রদায়’-এর ব্যাখ্যায় ইমাম নববি (রহ.) লিখেছেন, ‘যুবক-যুবতী বলতে বোঝানো হয়েছে, যারা বালেগ (পূর্ণ বয়স্ক) হয়েছে এবং যাদের ত্রিশ বছর পেরোয়নি।’ আর এ যুবক-যুবতীদের বিয়ের জন্য রাসুল (সা.) গুরুত্বারোপের কারণ সম্পর্কে আল্লামা বদরুদ্দীন আইনি (রহ.) রচিত বোখারির বিখ্যাত ভাষ্যগ্রন্থ উমদাতুল কারিতে লিখেছেন, হাদিসে শুধু যুবক-যুবতীদের বিয়ে করতে বলার কারণ হলো, বুড়ো অপেক্ষা এ বয়সের লোকদের মধ্যেই বিয়ে করার প্রবণতা ও দাবি অনেক বেশি থাকে। শরিয়তের দৃষ্টিতে বিয়ে না করলে যাদের ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার দৃঢ় আশঙ্কা হয়, তাদের জন্য বিয়ে করা ফরজ। আর প্রবল আশঙ্কা না হলে বিয়ে করা ওয়াজিব। বিয়ে না করলে গোনাহের আশঙ্কা না থাকলে বিয়ে করা সুন্নত। তবে কেউ যদি স্ত্রীর ভরণ-পোষণে সক্ষম না হয় কিংবা শারীরিকভাবে অক্ষম হয়, তাহলে বিয়ে করা জায়েজ হবে না।
বিয়েতে বিলম্ব করা অনুচিত : হাদিসে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধীরস্থিরতা অবলম্বনের কথা বলা হলেও কিছু কিছু কাজ তাড়াতাড়ি করার কথা এসেছে। মহানবী (সা.) স্বীয় জামাতা ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলী (রা.)-কে উপদেশ দিয়ে বলেন, ‘হে আলী! তিন কাজে দেরি করবে না। সময় হয়ে গেলে নামাজ আদায়ে, জানাজা এসে গেলে জানাজার নামাজ পড়তে এবং সমতা মিলে গেলে বিয়ে বিলম্ব করবে না।’ (তিরমিজি : ১৭১)। বর্তমানে যুবকদের অন্যতম সমস্যা হলো, সময়মতো বিয়ে না করা। এটি একটি মারাত্মক ব্যাধি। ফলে যুবসমাজ আজ ধ্বংসের মুখে। মূলত তারা বিভিন্ন ছুতোয় বিয়েতে বিলম্ব করে। যেমন- বিয়ে করলে খরচ বেড়ে যাবে। আমি তো নিজেই চলতে পারি না; বউকে চালাব কীভাবে! চাকরি-বাকরি করে আগে স্ট্যাবলিশ হতে হবে, তারপর বিয়ের প্রসঙ্গ। বিয়ের জন্য আগে বিপুল ধনসম্পদ জমাতে হবে, তারপর মহাড়ম্বরে বিয়ে সম্পন্ন করতে হবে। বিয়ে স্বাধীন লাইফস্টাইলের পথে অন্তরায়। তাই বিলম্বিত বিয়েতেই মুক্তি। আমি তো বেকার কিংবা আমার তো একটা ভালো জব নেই। অথচ গ্রহণযোগ্য কারণ ছাড়া ইসলামে বিলম্বিত বিয়ে নিষেধ।
অভিভাবকের দায়িত্ব-কর্তব্য : ছেলে-মেয়ে বিয়ের বয়সে উপনীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের বিয়ে করিয়ে দেওয়া অভিভাবকের গুরুদায়িত্ব। কারণ, পরিণত বয়সে পদার্পণ করার পরও ছেলের নিজের পায়ে দাঁড়ানো এবং মেয়ের পড়াশোনা শেষ করার অজুহাতে বিয়েতে বিলম্ব করা অনুচিত। অন্যথায় বিয়েবহির্ভুত অবৈধ মেলামেশার কারণে তারা গোনাহগার হবে। যথাসময়ে বিয়ে না দেওয়ার অপরাধে তাদের এ গোনাহের অংশ অভিভাবকদের ওপর বর্তাবে। ইসলাম ছেলে-মেয়েকে সময়মতো বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে। এ ব্যাপারে আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে বিশেষ অনুগ্রহের ঘোষণা এসেছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা বিয়েহীন, তাদের বিয়ে সম্পাদন কর এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা সৎ, তাদেরও। তারা অভাবগ্রস্ত হলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের অভাবমুক্ত করে দেবেন। আল্লাহ তো প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।’ (সুরা নুর : ৩২)। আফসোসের বিষয়, আল্লাহতায়ালা বিয়ের মাধ্যমে রিজিকে প্রশস্ততা বাড়িয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তা দিয়েছেন। অথচ আমরা রিজিকের ভয়ে বিয়ে করতেই টালবাহানা করি। মনে রাখতে হবে, রিজিকের মালিক একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘জমিনে বিচরণকারী প্রতিটি প্রাণীর রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহরই। তিনি জানেন তাদের আবাসস্থল ও সমাধিস্থল।’ (সুরা হুদ : ৬)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যে এবং চারিত্রিক পবিত্রতা রক্ষার উদ্দেশ্যে বিয়ে করে, তাকে সাহায্য করা আল্লাহর জন্য কর্তব্য হয়ে পড়ে।’ (মিশকাতুল মাসাবিহ : ১৯৫৫)। সুতরাং আল্লাহতায়ালা যাকে বিয়ে করার তৌফিক দেন, তার এবং তার স্ত্রী-সন্তানের রিজিকের ব্যবস্থা তিনিই করবেন।
সামাজিক কুসংস্কার ভেঙে বিয়ে করুন : আমাদের সমাজে বিয়ে নিয়ে প্রচলিত অনেক রেওয়াজ ও কুসংস্কার বিলম্বিত বিয়ের প্রধান দায়ী। এসব রেওয়াজ কিংবা সংস্কৃতিরকরণে বিয়েকে আমরা জটিল করে তুলেছি। যার সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। ভালো চাকরি কিংবা উচ্চ ডিগ্রি অর্জনের সঙ্গে বিয়ের কোনো যোগসূত্র নেই। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের উচিত, সমাজকে ভয় না করে আল্লাহকে ভয় করা। মূলত স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র সম্পর্ক কোনো ডিগ্রির ওপর নির্ভর করে না। সত্যিকারের সুখী দাম্পত্যজীবন তো তাদের, যারা একে অপরকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসবে। স্ত্রীর কাছে স্বামীর পরিচয় ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার নয়; বরং ইসলামে স্বামী-স্ত্রীকে একে অপরের পোশাক বলা হয়েছে। যেখানে ডিগ্রি কিংবা অর্থনৈতিক কোনো পার্থক্য নেই। রাসুল (সা.) বিয়ের ক্ষেত্রে দ্বীনদারিকে প্রাধান্য দেওয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘তোমরা দ্বীনদারিকে প্রাধান্য দাও। নয়তো ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ (বোখারি : ৫০৯০)। বলার অপেক্ষা রাখে না, চরিত্রহীন বদস্বভাবের মানুষের সঙ্গে যেমন সংসার সুখের হয় না, তেমনি শুধু বিত্তশালী হলেই তার সঙ্গে সংসার সুখের হয় না। টাকা-পয়সা, অর্থকড়ি এবং বাহ্যিক সৌন্দর্য এই আছে, এই নেই; কিন্তু মানুষের দ্বীনদারি, সৎচরিত্র, সুন্দর আখলাক আমৃত্যু অমূল্য সম্পদ।
ইসলামে সহজ বিয়ের সংজ্ঞা : বর্তমানে বিয়ে অহেতুক খরচ করা এবং জমকালো আয়োজন করে বিয়ে সম্পন্ন করা যেন এক ধরনের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঋণ করে কিংবা ভিক্ষা করে হলেও যেন অহেতুক খরচ বাড়িয়ে মহাসমারোহে বিয়ে সম্পন্ন করতে হবে। যার ফলে আজ বিয়ের মতো সহজ কাজটি অনেকের জীবনে জটিল হয়ে গেছে। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে যে বিয়েতে খরচ যত কম হয়, সে বিয়ে তত বরকতপূর্ণ হয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘সর্বোত্তম বিয়ে হলো, যা খরচের দিক থেকে সহজসাধ্য হয়।’ (সুনানে আবি দাউদ : ২১৯)।
সত্যি বলতে, সামাজিক মায়াজালে আটকে আমরা কতভাবে যে জীবনে হেরে যাই, তা হয়তো টেরই পাই না। ক্যারিয়ার গড়ার ভূত মাথায় চাপিয়ে বিলম্বে বিয়ে করে আমরা দাম্পত্য ক্যারিয়ার নষ্ট করছি না তো! লাইফ সেটেল করতে করতে শেষে যদি লাইফটাই ফুরিয়ে যায়, ফুরিয়ে যায় যৌবনের বসন্তকাল, তবে সেটেল-সাকসেস-ক্যারিয়ার ইত্যাদি শব্দের মর্মটা আসলে কী? সমাজের অংকে জীবন কষা বড় কঠিন! সুতরাং সামাজিক কুসংস্কার থেকে বিরত থেকে ইসলামের সুমহান আদর্শে নিজেকে সাজানোই প্রতিটি মোমিনের লাইফস্টাইল হওয়া উচিত। এতেই নিহিত সত্যিকারের সুখ-শান্তি-সফলতা।
লেখক : মুহাদ্দিস ও বিভাগীয় প্রধান, আরবি ভাষা বিভাগ, মাহমুদিয়া মাদরাসা, নারায়ণগঞ্জ