ঢাকা ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মক্কা শরিফের জুমার খুতবা

আত্মবিচার ও আমলে ধারাবাহিকতার তাগিদ

শায়খ ড. সালেহ বিন আবদুল্লাহ বিন হুমাইদ
আত্মবিচার ও আমলে ধারাবাহিকতার তাগিদ

দ্বীন ঠিক তো দুনিয়া ঠিক। ইখলাস ও রাসুল (সা.)-এর অনুসরণ ছাড়া দ্বীন ঠিক হবে না। আল্লাহর সামনে অবনত হওয়ায় প্রকৃত সম্মান। আত্মবিচারই আল্লাহওয়ালাদের কর্মপন্থা। আল্লাহভীতিই মোমিনদের পাথেয়। সৎকাজই সফল ব্যক্তিদের পুঁজি। যে পার্থিব জীবনে আত্মবিচার করবে, পরকালে তার বিচার হালকা হবে। রবের সামনে তার প্রশ্নগুলোর উত্তর সঠিক হবে। তার পরকালীন নিবাস মনোরম হবে, সুন্দর হবে। যে পার্থিব জীবনে আত্মবিচারী না হবে, সে দীর্ঘস্থায়ী পরিতাপ করবে। বিচারের মাঠে তার অবস্থান প্রলম্বিত হবে। ভুলভ্রান্তি তাকে বেষ্টন করে নেবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘সেদিন লোকেরা দলে দলে বের হবে; তাদের তাদের কর্মসগুলো দেখানো হবে। যে অণু পরিমাণ সৎকাজ করবে, সে তা দেখতে পাবে। যে অণু পরিমাণ অসৎ কাজ করবে, সেও তা দেখতে পাবে।’ (সুরা যিলযাল : ৬-৮)।

সময় থেমে থাকে না : একেকটা বছর কেটে যায় আর পার্থিব জগৎ থেকে মানুষের দূরত্ব বাড়তে থাকে। মানুষ কবর ও পরকালের কাছাকাছি হতে থাকে। পরিবার, সন্তান ও সম্পদসহ ভোগ-বিলাসে নিমগ্নতা থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্ব। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘বলো, যে মৃত্যু থেকে তোমরা পলায়ন করো, তার সঙ্গে তোমাদের সাক্ষাৎ ঘটবেই। এরপর তোমাদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে দৃশ-অদৃশ্যের জ্ঞাতার কাছে। তিনি তোমাদের কর্মগুলো সম্পর্কে অবগত করবেন।’ (সুরা জুমা : ৮)।

আত্মবিচার করতেই হবে : যে নিজের কল্যাণ কামনা করে, সে যেন নিজেকে নিজের সামনে দাঁড় করায়। আত্মবিচার ও আত্মজিজ্ঞাসায় লিপ্ত হয়। আল্লাহর শপথ! ঘুমিয়ে পড়ার মতো করেই একদিন মৃত্যু চলে আসবে। জাগ্রত হওয়ার মতো চলে আসবে পুনরুত্থান দিবস। সবাইকে নিজ নিজ কর্মের প্রতিদান দেওয়া হবে। অনুগতরা জান্নাতি হবে, অবাধ্যরা জাহান্নামি। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘কে ভালো- যাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হয় নাকি কেয়ামতের দিন যে নিরাপদে উপস্থিত হতে পারে? তোমরা যা ইচ্ছে করো, তিনি তোমাদের কর্মগুলো দেখছেন।’ (সুরা ফুসসিলাত : ৪০)।

সময় সর্বোত্তম উপদেশদাতা : সময় সচেতনদের জন্য সর্বোত্তম উপদেশদাতা। কালের দুর্বিপাকের চেয়ে সুস্পষ্ট ভাষী বক্তা আর নেই। সতর্ক হওয়া চাই। সময়ের ভাষা বোঝার চেষ্টা করা দরকার। হাদিসে এসেছে, ‘চারটি বিষয় দুর্ভাগ্যের প্রতীক- চোখ অশ্রুহীন হওয়া, মন শক্ত হওয়া, আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি পাওয়া, পার্থিব জগতের প্রতি লালসাগ্রস্ত হওয়া।’ (মুসনাদে বাজ্জার)। যৌবনকাল অনেককে ধোঁকায় ফেলে দেয়। বন্ধুদের বিদায়কে সে ভুলে যায়। আকস্মিকতা সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়ে। নানা আশায় বুক বাঁধে। আকাঙ্ক্ষা অলসদের কল্পনা বিলাস। দূরবর্তী আকাঙ্ক্ষার ওপর নির্ভরতা বোকাদের পুঁজি ও চিন্তা দৈন্যে আক্রান্তদের মূলধন। অলীক আশা যেমন বর্তমানকে নিষ্ফল করে, তদ্রুপ ভবিষ্যতকেও নষ্ট করে দেয়।

জানতে হবে, মানতেও হবে : অনেক মানুষ আছে, খুব জানতে চায়, কিন্তু মানতে চায় না। অনেক জ্ঞান লাভ করে; তবে সে জ্ঞান ব্যয় করে অহেতুক তর্ক-বিতর্কে, অন্যদের ওপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায়। পার্থিব স্বার্থসিদ্ধির জন্য তারা নিজেদের দ্বীনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। পরদোষ চর্চা করে। হিংসায় লিপ্ত হয়। দুনিয়াদারদের অনেকে নিজের সম্পদ খরচ করে প্রবৃত্তি-পুজায়, অবৈধ কর্মকাণ্ডে। তাদের মাঝে সবচেয়ে আফসোস হয় তাকে নিয়ে, যে সম্পদ উপার্জন করে; কিন্তু তার সম্পদ তাকে জাহান্নামের দিকে টেনে নিয়ে যায়। অথচ যাদের জন্য সম্পদ রেখে যায়, তারা সৎ হওয়ায় এবং আল্লাহর নির্দেশিত পথে সে সম্পদ ব্যয় করায় জান্নাতি হয়ে যায়।

মৃত্যুকে স্মরণ করতে হবে : যে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তা ভুলে বসে আছে, তাকে দেখলে আশ্চর্য লাগে। নিজের নিশ্চিত ক্ষতি দেখেও তা থেকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। সে মানুষকে ভয় করে; অথচ আল্লাহতায়ালাকে ভয় করাই অধিকতর সঙ্গত। সে সুস্থতা দেখে প্রবঞ্চিত হয়ে অসুস্থতাকে ভুলে যায়। সুস্বাস্থ্যে আনন্দিত হয়ে ব্যথা-বেদনা বিস্মৃত হয়। যৌবনের অহংকারে বার্ধক্য সম্পর্কে উদাসীন থাকে। জানাকে গুরুত্ব দেয়; কিন্তু মানার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করে না। নগদ যা পায়, হাত পেতে নেয়; ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবে না। বয়স বাড়ে, সঙ্গে ভারী হতে থাকে পাপের বোঝাও। কেশরাশি শুভ্র হয়; কিন্তু হৃদয় হয়ে যায় কৃষ্ণ, অন্ধকার। হৃদয় একবার অসুস্থ হয়ে পড়লে তা সুস্থ হয়ে ওঠা বেশ কঠিন। যে চোখ অবৈধতার সুরমায় দীপ্তিমান হয়, তার ক্রন্দন কমে যায়। যার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কুণ্ডবাসনায় নিমজ্জিত হয়, তাকে প্রবোধ দেওয়া ছাড়া কিছু করার থাকে না। দুর্দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিকে নিজ চেষ্টায় নিজের জন্য পাথেয় সংগ্রহ করতে হবে- জীবিতাবস্থায় মৃত্যুর জন্য, যৌবনে বার্ধক্যের জন্য, সুস্থ অবস্থায় অসুস্থ অবস্থার জন্য। মৃত্যুর পর কারও তওবা কাজে আসবে না। পার্থিব জীবনের পর হয় জান্নাত, নয় জাহান্নাম। যে ব্যক্তি রবের সঙ্গে নিজের লেনদেন পরিশুদ্ধ করে নেয়, মানুষের সঙ্গে তার লেনদেনে তিনি যথেষ্ট হয়ে যান। যার ভেতরটা সৎ হয়, তার বাইর সুন্দর হয়ে যায়। যে পরকালের জন্য কাজ করে, ইহকালে আল্লাহ তার সব বিষয়ের দায়িত্ব নিয়ে নেন।

প্রকৃত আত্মবিচার : প্রকৃত আত্মবিচার মানুষকে আমলে উদ্বুদ্ধ করে। যা অবশিষ্ট আছে, তা দিয়েই অতীতের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হবে। বর্তমানের প্রতিটি দিন প্রতিটি ক্ষণের সদ্ব্যবহার করতে হবে। আমল থেকে বিরত রাখে, এমন অনুতাপ ও পরিতাপে নিমগ্নতা অবাঞ্ছনীয়। যা আছে, তার যথাযথ ব্যবহার অতীত বিচ্যুতির ক্ষমা বয়ে আনে। এর অপব্যবহার হলে (বিনষ্ট-অবশিষ্ট) উভয়টির জন্যই জবাবদিহি করতে হবে। মৃত্যু হঠাৎ এসে পড়বে। প্রতিটি মুহূর্তকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে হবে। প্রতিটি নিঃশ্বাসকে তার মূল্য চুকিয়ে দেওয়া চাই। দিনগুলো বাহন। শ্বাস-প্রশ্বাসগুলো পদক্ষেপ। সৎকর্মই মূল পুঁজি। লাভ, চিরস্থায়ী জান্নাত। লোকসান, প্রজ্জ্বলিত অগ্নি- জাহান্নাম। একমাত্র দুর্ভাগারাই তাতে প্রবেশ করবে। নিজেকেই নিজের হিসাব গ্রহণকারী হতে হবে। আসুন, আল্লাহকে ভয় করি। পরকালের জন্য পাথেয় সংগ্রহ করি। যে আল্লাহকে ভয় করে, সে নিজেকে নিজে উপদেশ দেয়, তওবাকে প্রাধান্য দেয়, কুপ্রবৃত্তি দমন করে।

আমলে ধারাবাহিকতা থাকতে হবে : আমল অল্প হোক, কিন্তু তাতে ধারাবাহিকতা থাকা চাই। আয়েশা (রা.) বলেন, একবার রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় আমল কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘যেটি ধারাবাহিকতার সঙ্গে করা হয়, যদিও তা পরিমাণে কম হয়।’ (বোখারি : ৬৪৬৫)। রাসুল (সা.)-এরও আমলে ধারাবাহিকতা বজায় থাকত। ইমাম নববি (রহ.) বলেন, ‘ধারাবাহিকতা থাকলে অল্প আমলও অনেকদিন ধরে চলতে থাকে। চলতে থাকে আল্লাহর জিকির, মোরাকাবা, ইখলাস। বান্দা আল্লাহর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এতে দীর্ঘদিন চলতে থাকা এ আমলে প্রবৃদ্ধি আসে। ফলে তা বিচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকা অধিক আমল থেকে পরিমাণে বহুগুণে বেড়ে যায়।’ (আল মিনহাজ : ৬/৭১)। ইবনুল জাওজি (রহ.) বলেন, ‘ধারাবাহিকতার সঙ্গে সৎকর্ম সম্পাদনকারী মূলত আল্লাহর ইবাদতে অবিচ্ছিন্নভাবে যুক্ত থাকে। যে প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে কারও দরবারে হাজিরা দেয়, সে ওই ব্যক্তির মতো নয়, যে পূর্ণ একদিন হাজির থাকে, এরপর আর আসে না।’ (ফাতহুল বারি : ১/১০৩)।

মক্কার মসজিদে হারামে প্রদত্ত জুমার খুতবার সংক্ষেপিত অনুবাদ করেছেন মুইনুল ইসলাম

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত